ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩২ মিনিট আগে
শিরোনাম

সাড়ে তিন মাসে পাবনায় ১৭ খুন

  পাবনা প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৬:১১

সাড়ে তিন মাসে পাবনায় ১৭ খুন

‘আমার আব্বুকে যখন হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রাখা হয়, তখন আমি আব্বুর পা নাড়া দিচ্ছিলাম। তখন আব্বু আমাকে বলেছেন, মা আমি আর পারছি না। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। পেট দেখিয়ে আব্বু বলছিলেন, আমার পেট-বুক তো জ্বলে যাচ্ছে। আমি আর পারছি না। এরপরে যখন দেখলাম, তখন ওরা আমার আব্বুর মুখের উপর কম্বল দিয়ে দিলো। তারপর আব্বু আর আমার সাথে কথা বলেনি।

কথাগুলো বলেন হু হু করে কেঁদে উঠেন সানজানা রহমান ত্রপা।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণাকাতর মুক্তিযোদ্ধা বাবা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমের সাথে এটাই ছিল তার মেয়ে সানজানা রহমান ত্রপার শেষ কথা। বাবা আর কথা বলেননি। কিন্তু বাবার সেই যন্ত্রণাই যেন কুরে কুরে খাচ্ছে মেয়েকে। গত ৬ ফ্রেবুয়ারি রাতে পাবনার রুপপুরে বাড়ির গেটে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা সেলিমই নন। তার মতো অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন দুর্বৃত্তদের হামলায়। পাবনায় হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে খুনের ঘটনা। গেলো সাড়ে তিন মাসে (১০০ দিনে) জেলায় খুন হয়েছে ১৭ জন।

এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ১০ দিনে ৩ জন, জানুয়ারি মাসে ৪ জন, ডিসেম্বর মাসে ৬ জন এবং নভেম্বর মাসে খুন হয়েছেন ৪ জন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক বিরোধসহ নানা কারণে ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। একের পর এক এসব খুনের ঘটনায় শঙ্কিত পাবনাবাসী। জেলা পুলিশের তথ্য মতে, পাবনায় গত ১০০ দিনে খুন হয়েছে ১৭ জন। এর মধ্যে মামলা হয়েছে ১৭টি, আর এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ১১ জন।

মুক্তিযোদ্ধা সেলিম হত্যার পরদিন গত ৭ ফেব্রুয়ারি দিনেদুপুরে জলাশয়ে মাছ ধরা নিয়ে বিরোধের জেরে পাবনার চর শিবরামপুর গ্রামে কৃষকলীগ নেতা খাইরুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। তার আগে ২ ফেব্রুয়ারি পাবনার বেড়া পৌর সদরের বনগ্রাম উত্তরপাড়া মহল্লায় পারিবারিক কলহের জেরে স্বামীর নির্যাতনে মারা যান স্ত্রী আদুরী খাতুন (২২)।

জানুয়ারি মাসে খুন হয় ৪ জন। ১৬ জানুয়ারি ভোরে চাটমোহর উপজেলার রামনগর গ্রামে মহিষ চুরি করে পালানোর সময় চোর দলকে ধরতে গেলে কাভার্ডভ্যান চাপা দিয়ে রব্বান আলী (৬৫) নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে চোরের দল। ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জলাশয়ে মাছ ধরা নিয়ে বিরোধের জেরে আতাইকুলা থানার শ্রীপুর বাজারে হাফিজুর রহমান (৩২) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

২০ জানুয়ারি সদর উপজেলার রুপপুর গ্রামে কম্বল দেয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে নজরুল ইসলাম (৩৮) নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করে অপরপক্ষের লোকজন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়। ২২ জানুয়ারি পাবনা শহরের পৈলানপুরে অটোবাইক স্ট্যান্ডের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে যুবলীগ কর্মী অরিনকে (১৮) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ডিসেম্বর মাসে খুনের শিকার হন ৬ জন। ২ ডিসেম্বর রাতে সুজানগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে সুদের টাকা না পেয়ে কাশিনাথ হালদার (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় সুদ ব্যবসায়ীর স্বজনরা। ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সদর উপজেলার ভাড়ারা গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে লস্কর খাঁ (৬৫) ও মালেক শেখ (৪৫) নামের দুইজন নিহত হয়।

৭ ডিসেম্বর দুপুরে সদর উপজেলার চর ঘোষপুর গ্রামে ক্রিকেট খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে হামিম হোসেন মীম (১৫) নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে সহপাঠি বন্ধুরা। ১০ ডিসেম্বর রাতে ঈশ্বরদী উপজেলার দিয়ার বাঘইল গ্রামে স্বামীর নির্যাতনে মারা যান গৃহবধূ সীমা আক্তার (২৬)। হাসপাতালে মরদেহ ফেলে পালিয়ে যায় স্বামী।

১২ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি গ্রামে নিখোঁজের দু’দিন পর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসবেকলীগ নেতা আসাদুল ইসলামের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুর্ববিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে হত্যা করে।

নভেম্বর মাসেও খুন হয় ৪ জন। ৬ নভেম্বর রাতে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র আহমেদ মিশকাত মিশুকে (২৪) মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৮ নভেম্বর রাতে আতাইকুলা থানার মধুপুর গ্রামে সোহেল হোসেন (২২) নামের এক যুবককে পূর্ব বিরোধের জেরে শ্বাসরোধ ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০ নভেম্বর বিকেলে বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া গ্রামে শিশুদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে অভিভাবকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে বাবলু শেখ (৪৫) নামের একজনকে পিটিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। ৩০ নভেম্বর সকালে আতাইকুলা থানার দুবলিয়া গ্রামে নিখোঁজের তিনদিন পর মাটিতে পুঁতে রাখা স্কুলছাত্র আবির মাহমুদ অনির (১৪) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বন্ধুরা তাকে হত্যা করে।

এভাবে একের পর এক খুনের ঘটনায় জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। হত্যার পর বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবরোধ কর্মসূচিতে প্রতিবাদ করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না স্বজন ও এলাকাবাসীর। খুন-খারাবি বৃদ্ধির আতঙ্কজনক এ অবস্থা থেকে পরিত্রণ চায় শান্তিপ্রিয় এলাকাবাসী।

গবেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক শিক্ষার অভাব ও বিচারহীনতার কারণে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এ কে এম শওকত আলী খান বলেন, হত্যার পেছনের কারণ হিসেবে সামাজিক অস্থিরতা দায়ী। সেইসাথে সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে, পারিবারিক শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা দেখা দিয়েছে। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিকভাবে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিশিষ্ট গবেষক ড. নরেশ মধু বলেন, মানুষের মস্তিষ্কের উপরি অংশে মানুষের বিবেক থাকে, আর নিচের অংশে থাকে হিংসা। মানুষের অনুভুতি যখন বেড়ে যায়, তখন নিচ স্তরে যাওয়ার ফলে তার হিংসাত্মক মনোভাব বেড়ে যায়। তখন মানুষ খুন করে। সেইসাথে বিচারহীনতা একটি বড় সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে হত্যার সঠিক বিচার না হওয়ার কারণেও মানুষের মধ্যে খুনের প্রবণতা বাড়ে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে পরস্পরের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করতে হবে। আরেকটি বিষয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। হত্যাকারীরা সাজা পেলে খুন প্রবণতা কমতে পারে।

এ বিষয়ে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, সাম্প্রতিককালের হত্যাকণ্ডগুলো পারিবারিক কলহ ও স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটেছে। পুলিশ এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। হত্যার পরপরই মামলা নিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেক হত্যা মামলার ক্লু উদঘাটনেও সফল হয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ধরতেও চিরুনী অভিযান চলছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত