ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো

  জোবায়ের আহমেদ নবীন

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়য়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক/ এসো এসো...বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান এখন বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। নতুন বছরের প্রথম দিন আজ বাঙালির প্রাণের আর মনের মিলন ঘটার দিন। পুরনো সব বিভেদ, জরা আর দুঃখকে ভুলে আজ বাংলা ১৪২৬ সালকে বরণ করে নেয়ার দিন।

জীর্ণতাকে বাদ দিয়ে প্রকৃতি গাইছে নতুনের গান। মাঠে মাঠে ফসলের সমারোহ, প্রাণে প্রাণে লেগেছে আনন্দের দোলা। প্রকৃতিতে মাতাল সমীরণ। নতুন বছরে প্রার্থনা একটাই- বৈশাখের শক্তিতে মঙ্গল আর শুভ যেন ভরিয়ে দেয় সবার জীবন। একই শক্তিতে বাঙালি যেন পরাভূত করতে পারে সব অশুভ শক্তিকে। প্রার্থণা যা কিছু গ্লানিময়-জীর্ণ ও যা কিছু পুরনো- তা বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে হোক ছাই। গ্রীষ্মের এই তাপস-নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় উড়ে যাক দূরে, যাক দূর-দিগন্তে মিলিয়ে। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।’

সব না পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে মুছে, আকাশ বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে সূচি করে তুলতেই আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। নতুন স্বপ্ন, উদ্যম ও প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো নতুন বাংলা বছর। স্বাগত ১৪২৬। শুভ হোক নববর্ষ।

বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত আজ চারদিক। গ্রীষ্মের তীব্রতাপে আজ হয়তো বাতাসে নেচে উঠবে কালবৈখাশী অথবা এক পশলা বৃষ্টি ছুঁয়ে যাবে চারপাশ। এরপরেও এই সব উপেক্ষা করে সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবে মিলবে পুরো জাতি। দেশের প্রতিটি পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য আর উৎসব। কারণ আজ বাঙালির আনন্দের দিন, পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কুপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা নেবে এবং হবে ঐক্যবদ্ধ। নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। আমাদের এই দেশটি ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান আমাদের জীবনকে করেছে বর্ণাঢ্য। বহুধা পার্বণের মেলবন্ধনে আমাদের জীবন হয়েছে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ। বাংলা নববর্ষে বাঙালি জীবনে কয়েকশ’ বছর ধরে চলা ‘হালখাতা’ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে পান্তা ইলিশ।

মূলত মুঘল আমলেই বৈশাখে বর্ষবরণ রীতির প্রচলন শুরু হয়। বহুল জনশ্রুতি মতে, সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা সন প্রবর্তন হয়। কিন্তু এর আগেও তিনজনের নাম পাওয়া যায়, যারা বাংলা নববর্ষ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছেন। তারা হলেন-গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, তিব্বতের রাজা স্রংসন (তিনি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে রাজা হন এবং মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করে দুই দশক রাজত্ব করেন) এবং সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ।

বলা হয়ে থাকে, রাজা শশাঙ্কের আমল ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই ‘শক পঞ্জিকা’র প্রচলন ছিল। তখন বাংলা সনকে বলা হতো ‘শকাব্দ’। ইতিহাসে শশাঙ্ক প্রথম সার্বভৌম রাজা হিসেবে বিবেচিত। তার রাজ্যের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণে। তিনি গৌড়বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেছিলেন ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল। ওইদিন থেকে বঙ্গাব্দ শুরু হয় বলে অনেকে দাবি করে থাকেন। তবে তিনিই যে বাংলা সনের প্রচলন করেন- এ কথা অনেকে স্বীকার করতে চান না।

এটাও সত্যি, রাজা শশাঙ্কই যে ‘শকাব্দ’ তথা বাংলা সনের উদ্ভাবক- তারও কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। এ কারণে এ নিয়ে বিতর্ক চলছে যুগের পর যুগ। তবে অপর একটি পক্ষের দাবি, ৬০০ খিস্টাব্দের কিছু আগে স্রংসন নামে এক তিব্বতি রাজা মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করেন। তিনি তিব্বতের কৃষিকাজে প্রচলিত মৌসুমভিত্তিক দিন গণনা ভারতবর্ষে চালু করেন। তাদের দাবি, স্রংসনের নামের শেষাংশ থেকে ‘সন’ শব্দটি এসেছে।

কারও কারও মতে, স্রংসনেরও ৯০০ বছর পর তথা ১৪৯৪-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে বাংলা সনের প্রচলন শুরু হয়। সুলতান হোসেন শাহ নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। ‘শাহ-এ-বাঙালিয়ান’ বলে নিজের পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। তার আমলেই প্রথম কৃষকদের ‘ফসলি সন’ শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য পায়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সনের প্রবর্তক, সেটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। দালিলিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়, ‘বাংলা সনের’ প্রবর্তক ‘মুঘল-এ-আজম’- সম্রাট আকবর। তিনি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ হিজরি সনের (চাঁদ) সঙ্গে মিল রেখে ‘ইলাহি সন’ নামে নতুন এক সনের প্রচলন করেন। তখন কৃষকের কাছে এ সনটি ‘ফসলি সন’ হিসিবে পরিচিতি পায়। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যবহূত তথা রাজা শশাঙ্কের সময়কার ‘শক পঞ্জিকা’র নামগুলোকে সংস্কারের নির্দেশ দেন সম্রাট আকবর। এ আদেশমতে, তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি খ্রিস্টাব্দ (সৌর পঞ্জিকা) এবং আরবি হিজরির (চন্দ্র পঞ্জিকা) ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম চালু করেন, যা ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে গণনা শুরু হয়।

এদিকে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে আজকের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক রূপ দেয়ার কৃতিত্ব অবশ্য বাংলা একাডেমির। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা নির্ণয় করে। বাংলা সন গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির প্রতি চার বছরের ফেব্রিরুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যুক্ত রয়েছে, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এ দিনটি রাখা হয়নি। এ কারণে যাপিত জীবনে কিছুটা সমস্যা দেখা দিত। পরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলা একাডেমি বাংলা সনকে বিজ্ঞানসম্মত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখানে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, বাংলা সনের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ-ভাদ্র) ৩১ দিন, এর পরের ছয় মাস (আশ্বিন-চৈত্র) ৩০ দিন এবং প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে ৩১ দিন করা হয়।

অন্যদিকে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে পহেলা বৈশাখ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হতো। সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তি থেকে এ উৎসবের শুরু হতো। এ উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলে মেলার আয়োজন করা হত। তখনকার দিনে গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে একে ‘বান্নি’ বলা হত। তবে সে সময় এসব আয়োজন শহরবাসীর মধ্যে দেখা যেত না। ১৯১৭ সালের দিকে কলকাতা ও ঢাকায় পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় কিছুটা আনুষ্ঠানিকভাবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত