চলনবিলে সৌদি খেজুর চাষে সফল স্কুলশিক্ষক জলিল
পাবনা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০১৯, ০৮:৫৯
সৌদি মরুভূমির ধু- ধু বালিকারাশি আর পাবনার নদী বিধৌত চলনবিলের আবহাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। তারপরও দুর আরবের স্বপ্নের খেজুর ফলছে চলনবিলের পলিমিশ্রিত মাটিতে। আর এ অসাধ্য সাধন করেছেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হান্ডিয়াল ইউনিয়নের বল্লভপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আবদুল জলিল।
তার ছয় বছরের পরিশ্রম সার্থক করে এবার বাড়ির অঙিনার গাছগুলোয় ধরেছে বাহারি রঙ ও স্বাদের খেজুর। তার খেজুরে স্বপ্ন সফল হয়েছে জেনে তা দেখতে বহু আগ্রহী মানুষ তার বাড়ি যাচ্ছেন খেজুর কিনতে, দেখতে বা চারা কিনতে। তিনিও চান এ খেজুরের জাত ছড়িয়ে পড়ুক চলনবিলের পাড় জুড়ে।
সম্প্রতি কথা হয় বল্লভপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আবদুল জলিলের সঙ্গে তার বাগানে। তিনি জানান তার হার না মানা কাহিনী। কেমন সে কাহিনী? চলুন তাহলে শুনে নেয়া যাক।
তিনিবলেন, ‘২০১২ সালে শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে যাই। পেনশনের টাকায় যাই হজ্ব করতে। সেখানে তিনি বেশ কিছু খেজুরের বাগান ঘুরে দেখি। সারাজীবন শিক্ষকতা করলেও সে সব বাগানে গিয়ে ছাত্র হিসেবে চাষ পদ্ধতি জানি। মনের ভিতর দোলা দেয়- আহা, যদি এমন ফলন্ত খেজুরের কাদি আমার বাগানে দোল খায়!’
শিক্ষক আবদুল জলিল জানান, সৌদি খেজুরের বাগান থেকে তিনি বেশ কিছু বীজ সংগ্রহ করেন। হজ্ব শেষে দেশে ফিরে আসেন। তিনি বাড়ির সামনের আঙিনায় বীজ থেকে উৎপাদিত ৩৪টি চারা লাগান। কিন্তু সবগুলো চারা মরে যায়। আব্দুল জলিল বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মনের দিক থেকে ছিলেন সবল। তাই হাল ছাড়েননি।
পরের বছর ২০১৩ সালে প্রতিবেশী প্রবাসী একজনকে দিয়ে আবার খেজুর বীজ সংগ্রহ করেন। মরিয়ম জাতের এসব বীজ এনে বাড়ির আঙিনায় রোপন করেন। শেষ পর্যন্ত ১৬টি গাছ বেঁচে থাকে। গত ছয় বছর ধরে নিজেই পরিচর্যা করে গেছেন। গাছ তো নয়, যেন তার স্বপ্নরা বড় হতে থাকে। অর্ধযুগ পরে এসে এবার সেই গাছগুলোতে খেজুর ধরেছে। গাছে গাছে শোভা পাচ্ছে খেজুরের কাঁদি।
শিক্ষক আবদুল জলিল জানালেন এখন তার আরও বড় পরিকল্পনা। এবার তিনি পুরো চলনবিল জুড়ে খেজুর চাষ ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন। ইতিমধ্যে তার মালিকানাধীন বেশ কিছু জমি খেজুর চাষের জন্য প্রস্তুত করছেন বলে জানান।
খেজুরচারা রোপণ করার নিয়ম সম্বন্ধে আবদুল জলিল জানান, ৩ ফুট দীর্ঘ, ৩ ফুট প্রস্ত এবং ৩ ফুট গভীর করে গর্ত করতে হয়। ওই গর্তের অর্ধেক মাটির সাথে অর্ধেক লোকাল বালু এবং ৩০ কেজি শুকনা গোবর মিশিয়ে ওই গর্ত ভরাট করতে হবে। এরপর পানি দিতে হবে। পরে মাটি বসে যাওয়ার পর খেজুর চারা সঠিকভাবে রোপন করতে হয়। রোপনের ৩ মাস পর থেকে বছরে ৪বার রাসায়নিক সার ও মাল্টিমিক্স (ঔষধ) প্রয়োগ করতে হবে। বর্ষার আগে ও পরে জৈব সার দিতে হবে।
যে কোনো মাটিতে খেজুর বাগান করা সম্ভব। বৃষ্টির পানি যাতে না জমে এমন স্থানে চারা লাগাতে হবে। তবে রোদ থাকতে হবে। প্রতিবছর বাগানে একটি চারার পেছনে প্রায় ৫-৬ শ’ টাকা খরচ হয়। তার এ পর্যন্ত ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান।
অনেক আগ্রহী ব্যক্তি দেখতে যাচ্ছেন তার বাগান। কেউ শখে, কেউ বাগান করার প্রত্যয়ে। কথা হয় সাঁথিয়া উপজেলা থেকে আসা গাঙ্গহাটি গ্রামের আব্দুল খালেকের সাথে। জানান, তিনিও এমন বাগান করতে চান। এজন্য ওই চাষির কাছ থেকে অনেক কলা কৌশল জেনে নিয়েছেন। একই কথা বললেন আটঘরিয়ার উত্তরচক গ্রামের চাষি বিপ্লব সেন। অনেকে এসে শখ করে ছবি বা সেলফি তুলছেন।
খেজুরবাগান মালিক শিক্ষক আবদুল জলিল জানান, সৌদি আরবের খেজুর বাংলাদেশে চাষ করা সম্ভব জেনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে খেজুরবাগান করেছিলাম। একদিন আমার বাগানে মধ্যপ্রাচ্যের সুস্বাদু খেজুর থাকবে এমন স্বপ্ন আজ সফল। এখন ১৬টি গাছে খেজুর এসেছে। খেজুর পাকতে সময় লাগবে ৫/৬ মাস।
টিস্যু কালচার নিয়ে গবেষণা করা পাবনার মিয়াপুর হাইস্কুল এন্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. শাহনাজ পারভীন জানান, টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে এর চারা করার উদ্যোগ নেয়া গেলে সৌদি জাতের খেজুর গাছ খুব সহজে সব জায়গায় সম্প্রসারণ সম্ভব হবে। অন্তত এসব খেজুরগাছ থেকে সাকার চারা (কলম চারা) হলেও সেখান থেকেও দ্রুত বাগান সম্প্রসারণ সম্ভব। এতে স্বাদ ও গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকবে।
চাটমোহর উপজেলা কৃষি অফিসার হাসান রশীদ হোসাইনী বলেন, চলনবিল এলাকায় এই প্রথম কোন ব্যক্তি সৌদি খেজুর চাষ করছেন। ইতিমধ্যে গাছগুলোতে ফল আসতে শুরু করেছে। উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হবে।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ- পরিচালক কৃষিবিদ আজাহার আলী জানান, আবদুল জলিলের এই উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। এভাবে বাগান বাড়তে থাকলে খেজুর গাছ চাষের মাধ্যমে দেশে খেজুরের আমদানি নির্ভরতা কমবে। তিনি জানান, ওই চাষি যদি চারা গাছের নার্সারি করেন তবে আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা সহযোগিতা করব।
এমএ/