ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫২ মিনিট আগে
শিরোনাম

উপকূলীয় জনপদের সর্বনাশ, লোভী ঠিকাদারের পৌষ মাস

  লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০১৯, ২২:০০  
আপডেট :
 ১২ অক্টোবর ২০১৯, ২২:০১

উপকূলীয় জনপদের সর্বনাশ, লোভী ঠিকাদারের পৌষ মাস

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতিতে সম্প্রতী মেঘনার তীর রক্ষায় আপদৎকালিন জরুরি মেরামত কাজ (ডিপিএম) বাস্তবায়নে মনোনীত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। ওই কাজে নিযুক্ত একাধিক ঠিকাদারের মধ্যে কেউ ক্ষেত্র বিশেষে নামমাত্র কাজ করেছেন। কেউ কোনো প্রকার কাজই করেননি বলে জানা গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, ওই কাজের জন্য মৌখিকভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ অভিযুক্ত ঠিকাদাররা সম্পূর্ণ উত্তোলন করে নেয়ার পাঁয়তারা করছেন। অভিযুক্ত ঠিকাদারদের লুটের কারসাজিতে স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ চলছে বলে জানা যায়।

এদিকে লুটের কবলে পড়ে কাজ না হওয়ায় ভাঙনে আক্রান্ত জনপদে সর্বনাশের প্রত্যাশিত রক্ষা তো হয়নি; বরং সর্বগ্রাসের মুখে অরক্ষিত হয়েই রয়েছে ওই জনপদ। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। স্থানীয়রা অভিযুক্ত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ বরাদ্দকৃত অর্থ পরিশোধের সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কমলনগর ও রামগতিতে একের পর এক জনপদ ভেঙেই চলছে উত্তাল মেঘনা। কয়েক যুগ ধরে মেঘনা নদীর এমন বৈরিতার কবলে থাকায় আতংক আর উৎকন্ঠা এই উপকূলীয় জনজীবনের পিছু ছাড়ছে না। ইতোমধ্যে নদীর আগ্রাসনে জমি-জিরাত, জিবন-সংসার, হাট-বাজার সহ ভাঙনের অসংখ্য বেদনার গল্পস্তুপে ভার হয়ে উঠেছে এখানকার জনমন। তার উপর চলতি বর্ষায় চরফলকনের লুধুয়া ও রামগতির সবুজগ্রাম এলাকায় সেই ভাঙনের তীব্রতা সীমাহীন আকার ধারণ করেছে। বুঝে উঠার আগেই বিস্তীর্ণ ভূমিসহ ভেঙে পড়ছে বাড়ি-ঘর সাজানো পরিবার। স্থানাস্তরের সুযোগতো পাচ্ছেই না; বরং রাত না পোহাতেই মানুষ দেখে অনেক দূরের নদী গিলে খেয়েছে তার কাছের সীমানা। এত দ্রুত তীরে ধেয়ে আসা ভাঙন পরিস্থিতিতে হতবিহবল হয়ে পড়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলরা।

ধেয়ে আসা ভাঙনের তান্ডবলীলা কিছুটা দমানোর প্রচেষ্টায় তাৎক্ষণিক উদ্যোগ গৃহীত হয়। মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনের মুখে এ অঞ্চলের উপকূলীয় জনপদকে সর্বনাশের কবল থেকে রক্ষার্থে স্থানীয় এমপি ও সচেতনমহলের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেয় পানি উন্নয়নবোর্ড কর্তৃপক্ষ। এর আলোকে সম্প্রতি আপৎকালিন জরুরি মেরামত কাজ (ডিপিএম) প্রকল্পের আওতায় মৌখিক সম্ভাব্য ব্যায় বরাদ্দ দিয়ে তা বাস্তবায়নে ঠিকাদার মনোনয়ন দেয় স্থানীয় পানি উন্নয়নবোর্ড কর্তৃপক্ষ।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে জরুরি ভাঙন দমনের কাজ পাওয়া নিযুক্ত ঠিকাদাররা নিজেদের লোভ দমনে ব্যর্থ হন। ফলে ভেস্তে গেছে ভাঙন দমনের প্রত্যাশিত প্রচেষ্টা। সেই সাথে সরকারের কয়েক কোটি টাকা গচ্ছা গিয়ে লোভী ঠিকাদারের পকেট ভারী হয়েছে। ওই স্থানে ৪০০ মিটার কাজের মধ্যে ৩০০ মিটার কাজের জন্য কবির ও ইমতিয়াজ নামের নিযুক্ত ঠিকাদার দায়সারাভাবে কাজ শেষ করেন। কাজের ক্ষেত্রে তারা কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি বলেও জানায় প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এলাকাবাসী। এমনকি এই স্থানের কয়েকটি অংশে জিও ব্যাগের পরিবর্তে লবনের বস্তায় বালু ভর্তি করে ফেলা হয়েছে।

এছাড়া বস্তা ফেলার নীতিগত কৌশল না মেনে অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্তভাবে নিক্ষেপ করা হয়েছে। একই স্থানে বাকি ১০০ মিটার কাজের জন্য আলমগীর নামের নিযুক্ত ঠিকাদার নির্ধারিত স্থানে কোনো কাজ করেননি বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। এছাড়া রামগতির সবুজগ্রামের ১০০ মিটার কাজের জন্য নিযুক্ত সেই আলমগির নামক ঠিকাদার নির্ধারিত কাজে একইভাবে অনিয়ম করেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগে জানা যায়।

অথচ কাজ শুরু না করেই সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন নিযুক্ত ওই ঠিকাদারগণ। ঠিকাদারদের এমন কারসাজির লুটপাটে লুধুয়া এলাকার বাসিন্দা জনৈক ব্যাক্তির আঁতাত ও সহযোগিতা রয়েছে বলে জানা যায়। ওই ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধি বলেও জানিয়েছে স্থানীয়রা। এতে আক্রান্ত এলাকাবাসী অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকাবাসী জানান, কাজে উদ্দেশ্যমূলক ফাঁকিবাজির কারণে জরুরি তীর রক্ষার উদ্দেশ্য প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে কাজ সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণার পরই ইতিমধ্যে ওই এলাকায় অবস্থিত একটি বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মসজিদ, মাদ্রাসা, বসতবাড়ি ও ফসলি জমিসহ বিস্তৃীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মূখে রয়েছে ২০১৪ সালে নির্মাণ হওয়া চরফলকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বসতভিটা।

এলাকাবাসী আরও জানান, লোভী ঠিকাদারদের কাজে অনিয়মের নেপথ্য সহযোগী রাজনৈতিক ওই প্রভাবশালীর বাড়ি ভাঙনকবলিত ওইস্থানেই। অথচ অনিয়মের কারণে তার বাড়িটিও বর্তমানে ভাঙনের খুব কাছাকাছি।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়নবোর্ড কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মেঘনা নদীর তীর রক্ষায় আপৎকালিন জরুরি মেরামত কাজের (ডিপিএম) আওতায় কমলনগরের লুধুয়ায় ৪০০ মিটার ও রামগতির সবুজগ্রামে ১০০ মিটার কাজের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়েছে। মৌখিকভাবে বরাদ্দকৃত উক্ত কাজে বালুভর্তি জিও ব্যাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি জিও ব্যাগ এর সিডিউল মূল্য হিসেবে প্রায় ৪৫২ টাকা ধরা হয়েছে। এ কাজে মোট কত ব্যাগ জিও ব্যাগ ফেলার নির্দেশনা ছিল সেই ব্যাপারে জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ।

তবে সম্ভাব্য ব্যয় হিসেবে প্রতি মিটারের জন্য ১ কোটি টাকা করে মোট ৫ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যায় ধরা হয়েছে বলে জানা যায়। ওই কাজের জন্য আলমগির, ইমতিয়াজ ও কবির নামের ৩ জন ঠিকাদারকে মৌখিকভাবে নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া ওই কাজের তদারকির জন্য একটি নির্ধারিত কমিটি রয়েছে বলে জানা যায়। ওই কমিটিতে স্থানীয় এমপি’র ১ জন প্রতিনিধি, ডিসি বা ইউএনও’র ১ জন প্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও একই কার্যালয়ের ১ জন এসডি অথবা এসও এর সমন্বয়ে মোট ৪ জনের তদারকি কমিটি রয়েছে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতি. দায়িত্ব) ফারুক আহম্মদ উক্ত কাজ বাস্তবায়নে অনিয়মের ব্যাপারে স্থানীয়দের উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, লিখিত কোনো অভিযোগ না পেয়েও মৌখিক অভিযোগে সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে অভিযোগের আংশিক সত্যতা পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, লুধুয়া এলাকায় আলমগির নামের নিযুক্ত ঠিকাদারের নির্ধারিত ১০০ মিটার কাজ দায়সারাভাবে হয়েছে বলে প্রমানিত হয়। ওইস্থানে ডন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ফের একইভাবে পুনঃকাজের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। বাকি ৩০০ মিটার কাজ আশানুরুপ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, নির্ধারিত মনিটরিং কমিটির আপত্তি না থাকলে ঠিকারদের বিল আটকানো যাবে না। এক্ষেত্রে তিনি নিজের কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ বিষয়ক অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত