ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

বিলে বসেছে ৩২ ড্রেজার, হুমকির মুখে বসতবাড়ি

  জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ২০:২৯

বিলে বসেছে ৩২ ড্রেজার, হুমকির মুখে বসতবাড়ি

সারি সারি ড্রেজারের কান ফাটা গর্জন। বালু উত্তোলনে গোলাকৃতি বামুনঝি বিল ও বংশী খালে বসেছে ছোট বড় ৩২টি ড্রেজার। বিলের পূর্বপাশে ২৯টি, পশ্চিমে ৩টি। বামুনঝি বিলের চারপাশে সুলতান নগর, পিন্ডারহাটি, রঘুনাথপুর দিঘুলী, গান্দাইল, শিলকুড়িয়া ও কাষ্টশিঙ্গা গ্রামের বাসিন্দারা ভাঙন আতংকে দিশেহারা। ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করায় ভেঙে গেছে সুলতান নগর গ্রামের একমাত্র প্রবেশপথ পাকা সড়কটি। মূল ভূখন্ড থেকে যে কোনো মুহূর্তে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বামুনঝি বিল বেষ্টিত সুলতান নগরে।

জামালপুর সদর উপজেলার দিগপাইত ও তিতপল্লা ইউনিয়নের ৫টি মৌজা রঘুনাথপুর দিঘুলী, সুলতান নগর, জোয়ানের পাড়া, গান্ধাইল ও ছোনটিয়ার ৪ শ ৩৬ একর জমির ওপর ২ শ ৯ কোটি টাকা ব্যায়ে চলছে জামালপুর শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।

শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাটি ভারাটের ঠিকাদারী কাজ করছে এমএম বিল্ডার্স। এ কাজে বামুনঝি বিল ও বংশী খাল থেকে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী ঠিকাদার ও স্থানীয় বালু লুটেরা সিন্ডিকেট। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন করে হুমকির মুখে ফেলেছে ৫টি গ্রামের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, স্কুল, মসজিদ-মাদ্রাসা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা।

ভাঙন আতঙ্কিত গ্রামবাসী অবৈধ ড্রেজার বন্ধের প্রতিবাদ করলে মামলা, হামলা পাশাপাশি পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট এমএম বিল্ডার্স সুলতান নগরের আলহাজ আব্দুল বারীসহ ১৮ জনের নামে মামলা করে বালু ও মাটি উত্তোলনের পথ সুগম করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ভাঙনের হাত থেকে ভিটেমাটি রক্ষার জন্য এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা মানববন্ধন, স্মারলিপিসহ আবেদন নিবেদন জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। ২০১৭ সালের ৭ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের বিনিয়োগ উন্নয়ন শাখায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প থেকে বামুনঝি বিলকে বাদ দিয়ে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের জীবন জীবিকাসহ জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্য আবেদন করেছিল সুলতাননগর বামুনঝি বিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি।

এছাড়া ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন বন্ধে ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সুলতান নগর এলাকায় মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী।

বামুনঝি বিল বেষ্টিত গ্রামের নাম সুলতান নগর। বড়ভিটার বামুনঝি পুল থেকে আঁকাবাঁকা পাকা সড়ক চলে গেছে সুলতান নগর গ্রামে। একমাত্র চলাচলের সড়কটিরও এক চতুর্থাংশ ভেঙে গেছে ড্রেজারে বালু উত্তেলনের প্রভাবে। বামুনঝি বিলজুড়ে গোলাকৃতি গ্রামটি সাড়ে তিন কিলোমিটার। এ গ্রামের সিংহভাগ মানুষ বামুনঝি বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। দেড় বছর ধরে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় বামুনঝি বিলের পানি নষ্ট হয়ে গেছে। মরে গেছে ছোটবড় মাছ। প্রজননের অনুকূল পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে মাছের স্বাভাবিক বংশবিস্তার। সুলতান নগর মানুষের একমাত্র জীবিকাস্থল বামুনঝি বিলের মাছের ক্ষেত্র ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে মৎস্যজীবীরা, এমনটাই জানিয়েছেন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মিয়ার উদ্দিন।

এছাড়াও জেলেসহ ৫ শ পরিবারে বসবাসরত প্রায় ৫ হাজার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। আতঙ্ক রয়েছে আশেপাশের আরো ৪টি গ্রামের মানুষের মধ্যেও।

এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় জোৎনা (৪৪) , সুজন আলী (৪৫), রফিকুল আলম (৪০), ফরহাদ আলী খান (৪৮), খোরশেদ আলম (২৯) ও আব্দুল হালিমের (৩০) সাথে।

তারা বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাটি ভরাট কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার সুলতান নগর গ্রামের চর্তুদিকে বামুনঝি বিলে ৩২টি ড্রেজার বসিয়ে দিনে-রাতে বালু ও মাটি উত্তোলন করছে। প্রায় দু’বছর ধরে লেভেলিং ছাড়াই স্থানে স্থানে কুয়ার মতো ৮০/৯০ ফুট গভীর করে এই মাটি ও বালু উত্তোলন করায় ধ্বসে যাচ্ছে বিলের পাড়সহ ফসলি জমি। ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে এ গ্রামের প্রবেশপথ ও একমাত্র রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ।

একমাত্র এ বিলই তাদের জীবিকার প্রধান ক্ষেত্র। বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে ৫ শ ৫০ জন জেলে। অধিক ড্রেজারের মাধ্যমে মাটি ও বালু তোলার কারণে পানি ঘোলা হয়ে গেছে। ড্রেজারের নির্গত তেল পানির সাথে মিশে দূষিত হচ্ছে গোটা বিলের পানি। এ বিল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ছোটবড় অনেক প্রজাতির মাছ। দু বছর আগেও যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যেত, এখন তার চার ভাগের একভাগও পাওয়া যায় না।

তাদের অভিযোগ, এ বিল থেকে অবৈধভাবে মাটি ও বালু তুলছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাটি ভরাটের কাজে টেন্ডারে ক্যারিং খরচ ও বালুর খরচ ধরা থাকলেও অধিক লাভের জন্য তারা অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘেঁষা বামুনঝি বিল থেকেই ড্রেজার বসিয়ে তুলছে মাটি ও বালু। এতে হুমকির মুখে পড়েছে সুলতান নগরসহ আশেপাশের ৬টি গ্রাম। বালু ও মাটি উত্তোলন বন্ধে একাধিকবার মানবন্ধন, মিছিল ও আবেদন করলেও বিষয়টি কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। এ বিল নির্ভর ৫ শ ৫০ জন জেলেদের সমিতি ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন চেয়ে মামলার রায় হলেও অদ্যাবধি কেউ না পেয়েছে ক্ষতিপূরণ, না পেয়েছে কেউ পুনর্বাসনের সুবিধা। উল্টো ড্রেজার বন্ধের প্রতিবাদ করায় তাদের নামে মামলা করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএম বিল্ডার্স। এই গ্রামের প্রতিবাদী জেলেদের শায়েস্তা করতে উজান এলাকা থেকে নিয়মিত আসে ক্যাডার বাহিনী। পুলিশও আসে তাদের ধরতে। প্রভাবশালী, ঠিকাদার, স্থানীয় ক্যাডারসহ অবৈধ বালু উত্তোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের হয়রানির শিকার হয়ে এখন তারা অসহায়ের মতো নীরবে দেখে যাচ্ছেন নিজেদের গ্রাম ধ্বংসের চিত্র।

জামালপুর সদরের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোজাফফর হোসেন এ বিষয়ে বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের আগে এসব এলাকার মানুষেরা আবেদন নিবেদন ও স্মারকলিপি দিয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর কোথাও কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি অর্থনৈতিক অঞ্চলের দেখভাল করছি। যেসব এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে সেসব খাস-খতিয়ানভুক্ত সরকারি জমি। বালু ও মাটি উত্তোলন করায় কোনো গ্রাম হুমকির মধ্যে পড়বে না। তবে একটু বেশি ডিপ করে মাটি ও বালু তুলছিল তারা, পরে এটা নিষেধ করে অন্যদিকে ডাইভার্ট করেছি। এছাড়া সুলতান নগর প্রবেশপথ পাকা সড়কটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ড্রেজার দিয়ে বালু ও মাটি উত্তোলনের প্রভাব এখানে পড়েনি।

জেলা প্রশাসক মো. এনামুল হক বলেছেন, ড্রেজার দিয়ে মাটি ও বালু উত্তোলনের বিষয়টি জানলাম। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অসংখ্য ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করে ৫টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের ভিটেমাটি, জীবন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন জামালপুরের সুধীজনরা।

বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত