ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

৪ বছরে ১০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক মেয়র নজরুল

  লুৎফল কবীর সোহাগ

  সিরাজগঞ্জ

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:১৯  
আপডেট :
 ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ২০:৩৪

৪ বছরে ১০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক মেয়র নজরুল

নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পৌরসভা। পৌর এলাকায় নানা প্রকল্প, ২০১৫-১৬, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এডিপি থেকে মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থান, মন্দির ও শ্মশানের নামে বরাদ্দকৃত অর্থও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে উল্লাপাড়ায় ৩ বিঘা জমি প্রায় ৫ কোটি টাকার জায়গা ক্রয় করে প্রায় ১০ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র নজরুল ইসলাম।

গত অক্টোবরে মেয়রের দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দুদকের নজরে আসলে তদন্তের স্বার্থে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত পাবনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে মেয়রের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির রেকর্ড পাঠাতে উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘটনাটি উল্লাপাড়া উপজেলা জুড়ে টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৪ সালে উল্লাপাড়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নজরুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ দলীয় সমর্থন নিয়ে নৌকা প্রতীকে মেয়র নির্বাচিত পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম নজরুল ইসলাম। দায়িত্ব নেওয়ার চার বছরের মধ্যে দুর্নীতির টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন উল্লাপাড়া পৌরসভার মেয়র এস. এম নজরুল ইসলাম। উন্নয়ন খাতের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়ে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। পৌরসভার আইনকানুনের কোনো ধরনের তোয়াক্কা না করে মেয়র ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কাউন্সিলরের সঙ্গে কোনো বিষয়ে আলোচনা না করে মেয়র একাই সব কাজ করেন। চার বছর আগে সাধারণ জীবনযাপন করলেও বর্তমানে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত জমিতে গড়ে তুলছেন নানা প্রকল্প, ঢাকার মাদারকেট, বাসাবো ও আমিন বাজারে কিনেছেন প্লট, চার বছরে নিজ পরিবারের নামে-বেনামে কিনেছেন অসংখ্য জায়গা-জমি ও ফ্ল্যাট। যুক্ত হয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়।

মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নজরুল ইসলামের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। পৌরসভাসহ বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠানে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাচল শুরু করেন।এদের ভয়েই পৌরসভার কাউন্সিলররা মুখ খুলতে সাহস পায় না। একসময় অভাব থাকলেও বর্তমানে চালচলন আচার-আচরণে রাজকীয় ভাব দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন উল্লাপাড়ার মানুষ।

স্থানীয়দের অভিযোগে জানা যায়, উল্লাপাড়া পৌরসভার মেয়র এসএম নজরুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সকল কাজে অনিয়ম দুর্নীতি করে পৌরসভাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। সকল কাজে সে অনিয়ম দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এডিবি কর্তৃক পৌর এলাকার চর ঘাটিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাটি ভরাট বাবদ ৫০ হাজার টাকা, ঘাটিনা পশ্চিমপাড়া আজাদ মসজিদের উন্নয়নের ৫০ হাজার টাকা, চর ঘাটিনা দক্ষিণপাড়া মসজিদের উন্নয়নে ৫০ হাজার টাকা ও চর ত্রিফলগাঁতি পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের উন্নয়নের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দসহ অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থান, শ্মশান ও মন্দিরে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। গত ৩/৪ বছরে বরাদ্দকৃত অধিকাংশ টাকাই পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম পৌরসভার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তুলে নিয়েছেন। এ জন্যই প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা বার বার ঘুরে বরাদ্দকৃত অর্থ তুলতে পারেননি। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে উল্লাপাড়ার ঘোষগাতি মৃধাবাড়ী জামে মসজিদের নামে ৫০ হাজার টাকা এডিপি থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু ২ বছর অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত মসজিদের টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জন্য এডিপি থেকে ঘোষগাঁতি মহাশ্মশানের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় ও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে এডিপি থেকে ঘোষগাতি শিব মন্দিরের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও দুই তিন বছর অতিবাহিত হলেও বরাদ্দকৃত টাকা পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও মেয়র কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পৌরসভার কাউন্সিলরদের অন্ধকারে রেখে যাবতীয় অপকর্ম করছেন। তার ইচ্ছেমতো রেজুলেশন তৈরি করে যাবতীয় অপকর্ম করছেন। পৌরসভার রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ তিনি গোপনে দরপত্র করে নিজের লাইসেন্স ছোট ভাই বা অনুগত ঠিকাদারদের দিয়ে নিম্নমানের কাজ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ কারণেই পৌরসভায় সরকারের সব উন্নয়ন জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়েই মেয়র নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ১৬ মে উল্লাপাড়া উপজেলার বাখুয়া মৌজায় আব্দুল জলিল সরকারের প্রায় ৩ কোটি টাকার মূল্যের জমি সরকারি ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য গোপনে দলিলে ১ কোটি টাকা ক্রয় দেখিয়েছেন। যার দলিল নং-২৮৭৩। একই বছরের ১৬ মে বাখুয়া মৌজায় আল মাহমুদের নিকট থেকে (অর্ধ ডিসিমাল) জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম ৮০ হাজার টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নম্বর-২৮০৩, একই বছরের ১১ জুলাই মো. আব্দুল হান্নান সরকারের নিকট থেকে বাখুয়া মৌজায় জেসমিন আরার নামে ৪৩ একর জায়গা ১০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নম্বর-৩৪৭২। মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালের ২৫ জুন বাখুয়া মৌজা থেকে আশরাফ আলীর নিকট থেকে ৫ শতক জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম তার পিতা চাঁদ আলীর নামে ২০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নং-৩১৯৯। একই মাসের ১৯ জুন বাখুয়া গ্রামের আশরাফ আলীর নিকট থেকে ৫ শতক জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম তার পিতা চাঁদ আলীর নামে ২০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নং-৩০৬৩। একই বছরের ২৮ আগস্ট নেওয়ারগছা মৌজার জাহাঙ্গীর হোসেন খানের নিকট থেকে ৭৮ শতক জায়গা ৫০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন মেয়র নজরুল ইসলাম। যার দলিল নম্বর-৪১৯৫। একই বছরের ১১ জুন বাখুয়া মৌজার রিমন হাসানের নিকট থেকে ২ শতক জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম ১২ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নম্বর-২৮৯১। একই বছরের ২০ জুন ভট্টকাওয়াক মৌজায় আব্দুল মোমিন গংয়ের নিকট থেকে ১০ শতক জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম তার স্ত্রী জেসমিন আরার নামে ৭০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নং-৩২৭৯।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মেয়র নজরুল ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার পর পৌর কার্যালয়ে শুরু হয় লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। নির্বাচনের সময় হলফনামায় মেয়র নজরুল ইসলাম বসতভিটা, স্ত্রীর গহনা, ব্যাংক ব্যালেন্সসহ স্বল্পমূল্য কিছু টাকার সম্পদের হিসেব জমা দিলেও বর্তমানে তার স্ত্রীসহ নিজ নামে ৮টি দলিলে ৩ বিঘা (১০১ ডিসিমাল) জমির মালিক। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থ আয় ও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো তদন্ত করে মেয়র এসএম নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন উল্লাপাড়াবাসী।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী উল্লাপাড়া পৌর এলাকার চর ঘাটিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মসজিদের মাটি ভরাটের জন্য ১৬-১৭ অর্থ বছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছরেও বরাদ্দকৃত অর্থ পাইনি।

ঘাটিনা পশ্চিমপাড়া আজাদ মসজিদের সভাপতি আব্দুল মান্নান, চর ঘাটিনা দক্ষিণপাড়া মসজিদের সভাপতি মঈনুল হক ও চর ত্রিফলগাঁতি পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মসজিদ উন্নয়নের জন্য এডিপি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। দীর্ঘ দুই বছর একাধিকবার পৌর মেয়রের কাছে ঘুরে ঘুরে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলন করতে পারিনি। পরে শুনেছি টাকাগুলো আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঘোষগাতি মৃধাবাড়ী জামে মসজিদের সভাপতি ফজলুল হক মৃধা জানান, অনেকবার পৌরসভায় ঘুরেও আমাদের বরাদ্দকৃত টাকা পাইনি। এখন শুনছি মেয়র নজরুল ইসলাম আমাদের মসজিদের টাকা নিজেই তুলে নিয়েছেন।

ঘোষগাতি শিব মন্দিরের কমিটির সভাপতি মদন কুমার কর্মকার জানান, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে এডিপি থেকে ৫০ হাজার মন্দিরের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই টাকা মেয়র নজরুল ইসলাম নিজেই গোপনে তুলে আত্মসাৎ করেছেন। টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মেয়র নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দেবেন বলেও তিনি জানান।

ঘোষগাঁতি মহাশ্মশান কমিটির সেক্রেটারি বাবলু কুমার ভৌমিক জানান, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জন্য এডিপি থেকে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় আমাদের মন্দিরে। যথারীতি টেন্ডারও হয়। কিন্তু মেয়র নজরুল ইসলাম গোপনে মহাশ্মশান কমিটিকে না জানিয়ে ৫০ হাজার টাকা নিজেই তুলে আত্মসাৎ করেছেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা আমাদের মহাশ্মশানের নামে না দিলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মহোদয়ের নিকট অভিযোগটি তুলে ধরবো।

দুদকের তথ্য চাওয়ার বিষয়ে উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফুজ্জামান জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাতের যে রেকর্ডপত্রসহ নির্বাচনী হলফনামা চাওয়া হয়েছিল তা ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা তদন্তপূর্বক যা করণীয় তা করবে।

এ বিষয়ে উল্লাপাড়া পৌরসভার মেয়র এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, এডিপির বরাদ্দে কিছু সমস্যা হয়। তবে বরাদ্দকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুদানের অর্থ দেয়া হয়েছে। তবে ঘোষগাঁতি মহাশ্মশান, ঘোষগাতি শিব মন্দির ও ঘোষগাতি মৃধাবাড়ী জামে মসজিদের নামে বরাদ্দকৃত দেড় লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পায়নি এমন প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

তিনি আরো বলেন, আমি কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত নই। চার বছরের ব্যবধানে ৮টি জায়গা ক্রয় করেছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমার নামে কোন জায়গা-জমি নেই। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।

এনএইচ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত