ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

চা বিক্রি করে জীবন সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কন্যা

  জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:১২  
আপডেট :
 ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:১৭

চা বিক্রি করে জীবন সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কন্যা

চা বিক্রি করে জীবন চলছে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীর মেয়ে শাহনাজ বেগমের। কাজের ফাঁকে কামালপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের শহীদ স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর, শহীদ মিনার, মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেন স্বেচ্ছাশ্রমে। স্মৃতিসৌধের বেদীতে শহীদের নাম রোদ বৃষ্টিতে উঠে গেলে নাম স্পষ্ট করতে রং তুলি হাতে কখনো হয়ে উঠেন শিল্পী। তিনি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে রং তুলি কিনে শ্বেত পাথরে খোদাই করা নামে তুলির আঁচড়ে রং বসিয়ে শহীদের নাম স্পষ্ট করে তোলেন।

রং তুলি হাতে কাজের ফাঁকে কথা হয় শাহনাজে পারভীনের সাথে। তিনি বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে কামালপুর স্মৃতিসৌধে আসেন বাবার নামটি এক নজর দেখার জন্য। রোদ বৃষ্টিতে বেদীতে শহীদদের নামতালিকার রং উঠে অস্পষ্ট হওয়ায় বাবার নামটি দেখতে না পেয়ে তাদের চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ে। তাদের কান্না দেখে আমিও পানি ধরে রাখেতে পারিনা। আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তাদের বাবা হারানোর ব্যথা আমাকে কাঁদায়। আমার বাবাও যদি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হতেন তাহলে ওদের জায়গায় আমিও বাবার নাম না দেখতে পেয়ে কাঁদতাম। চা বিক্রির টাকা থেকে রং তুলি কিনে শহীদদের নাম স্পষ্ট করার কাজটি করি। কোন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে বাবার নাম না দেখতে পেয়ে চোখের জল ফেলে যেন বাড়ি ফিরে যেতে না হয়।

তিনি আরো বলেন, নিজ তাগিদেই চা বিক্রির ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সকল স্থাপনার ধোয়ামোছার কাজ করি। আমার বাবার মতো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকাতর জায়গাটিতে কাজ করতে ভালই লাগে।

এসব কথা বলতে বলতে শুরু করলেন কষ্টমাখা জীবনের গল্প। শাহনাজদের আদি বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার চর চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে। তার বাবা শাহজাহান আলী ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দেন। চাকুরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৯ নং সেক্টরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ রাইফেলসে যোগ দেন তিনি। কিছুদিন কামালপুর বিডিআর ক্যাম্পে চাকরি করার পর ঢাকায় পিলখানাতে বদলি হন। পিলখানাতে চাকরিরত অবস্থায় এরশাদের আমলে মার্শাল আইনের সময় চাকরি চলে যায় তার।চাকরি হারানোর পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি। মামলা করে র্দীঘদিন আদালতের বারান্দায় ঘোরাফেরার পর অর্ধেক পেনশনে প্রতিমাসে ৪’শ টাকা করে পান। এ টাকায় ৪ ছেলেমেয়েসহ ছয়জনের ভরণপোষন করাই দায়, সেখানে বাসা ভাড়া দেবেন কিভাবে। তাই পূর্বের কর্মস্থল জামালপুরের ধানুয়া কামালপুরে পরিচিতজনদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের কোনায় খাস জমিতে চালাঘর তুলে বসবাস শুরু করেন তারা।

শাহনাজ ও তার বড়বোন দুজনে পাহাড় থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে এনে বাজারে বিক্রি করে এবং ধানের মিলে কাজ নেন তার মা। যা আয় করে তা দিয়েই ৬ জনের মুখে আহার জোটে। এসব করে টেনেটুনে সংসার চলার পাশাপাশি ভাইবোনের লেখাপড়া খরচ চলার পাশাপাশি নিজেও লেখাপড়া করতেন। ধানুয়া কামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি। টাকার অভাবে ফরম ফিলাপ করতে না পারায় এসএসসি পরিক্ষা দিতে পারেননি। ভেঙে যায় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন। তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ে হয় জামালপুর সদর উপজেলার তিতপল্লা গ্রামের এনামুল হকের সাথে। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখেন এনামুল হকের প্রথম স্ত্রী রয়েছে।

সতীনের সংসারে বছর দুয়েকের বেশী টিকতে পারেননি। ভেঙে যায় স্বপ্নের সংসার। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ২ বছর বয়সী কন্যা সন্তান আয়শাকে নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। মুক্তি বার্তাসহ সকল কাগজপত্র থাকলেও বাবা মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান আলীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতে সময় লেগেছে ২৬ বছর। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতে শুরু করেন তিনি। অসহায় বাবার ঘাড়ে বোঝা হয়ে না থেকে শাহনাজ তার বড় বোনকে সাথে নিয়ে ঢাকায় পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন।

সেখানে কাজ করে স্বল্প বেতনে নিজে চলে পরিবারে টাকা পাঠাতে না পেরে ফের কামালপুরে চলে আসেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের কোনায় খুলে বসেন চায়ের দোকান। এরপর থেকে চা বিক্রি করে চলছে তাদের জীবন। ৩৮ বছর সংসারের ঘানি টেনে হাঁপিয়ে উঠেছেন শাহনাজ বেগম। বার বার ভেঙেছে শাহনাজের স্বপ্ন। তবুও দমে যাননি তিনি। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন আজও।

শাহনাজ আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে। মেয়ে আয়শার বয়সও আঠারো বছর পেরিয়ে গেছে। মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। এই নিয়েও রয়েছে টেনশন। যখন মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধে অনুষ্ঠান হয় তখন বেচাবিক্রি বেশী হয়। এছাড়া বছরের অন্য দিনগুলোতে তেমন একটা চা বিক্রি হয়না।

শাহনাজ বেগমের আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অনেকেই তো সরকারি-বেসরকারি নানা পদে চাকরি পাচ্ছে, আমরা গরিব মানুষ, লোকজনও নাই চাকরিও পাইনা। ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারসহ এমপি মন্ত্রী অনেকে স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে এলে আমার চাকরির কথা বলেছি, তারা আশ্বাসই দিয়েছেন, কিন্তু আমার কপালে চাকরি জোটেনি। সরকারি অফিস-আদালতে একটা পিয়নের অথবা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে চাকরি হলেও বাকি জীবনটা চালিয়ে নিতে পারতাম। কে শুনবে আমাদের কথা?

কামালপুর মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান বলেন, চা দোকানি শাহনাজ বেগম স্মৃতিসৌধসহ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ধোয়া-মোছাসহ সকল কাজ করেন। আমরা তাকে কোন বেতনও দিতে পারিনা। তারপরও কাজ নিয়ে কোন অনীহা নেই তার। এই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে তার চাকরির ব্যবস্থা করা দরকার। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে এই নিয়ে কথাও বলেছি। তবে কোন কাজ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসবি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত