ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

থমকে আছে জেলা পরিষদ নির্বাচন, বঞ্চিত পাহাড়িরা

  হিমেল চাকমা, রাঙামাটি

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৪

থমকে আছে জেলা পরিষদ নির্বাচন, বঞ্চিত পাহাড়িরা

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এ চুক্তির কারণে তিন পার্বত্য জেলা শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। ১৯৮৯ সালে গঠন হওয়া স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনটি পার্বত্য চুক্তিতে আরো ক্ষমতা যুক্ত হয়ে নাম হয় পার্বত্য (রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) জেলা পরিষদ। পরিষদগুলোর সমন্বয়, অর্থায়ন, তদারকি করতে ১৯৯৮ সালে ১৫ জুলাই গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

১৯৮৯ সালে গঠন হওয়া স্থানীয় সরকার পরিষদের প্রথম বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর আর নির্বাচন হয়নি পরিষদগুলোতে। সে হিসেবে প্রায় ৩০ বছর নির্বাচনবিহীন অবস্থায় চলছে জেলা পরিষদগুলো।

পরিষদের আইনমতে, উপজাতীরা তাদের স্ব স্ব জনগোষ্ঠীর প্রার্থীকে প্রত্যক্ষ ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। এ নির্বাচনে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, খুমি লুসাই, মুরং, বম খিয়াং, চাক এর একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। এসব নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের স্ব স্ব জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবে। কিন্তু পরিষদগুলোতে নির্বাচন না হওয়ায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি। ফলে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত আছেন পাহাড়িরা।

তিন পার্বত্য জেলা আদিবাসী ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে ১৩টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। তাদের জনসংখ্যা প্রায় ১১ লাখ।

এসব জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করলেও সরকার এ স্বীকৃতি দেয়নি। বিপরীতে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে আদিবাসী হোক বা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী হোক, এদের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে তিন পার্বত্য জেলায় তৈরি হয়েছে বিশেষ আইন। তার মধ্যে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অন্যতম।

এ আইন মতে, প্রতিটি জেলায় ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট জেলা পরিষদ গঠন হবার কথা। এ পরিষদে রাঙামাটি জেলা পরিষদে ১ জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ও ২০ সদস্যের মধ্যে ১০ জন চাকমা, ৪ জন মারমা, ২ জন তঞ্চঙ্গ্যা, ১ জন ত্রিপুরা, ১ জন লুসাই, ১ জন পাংখোয়া, ১ জন খিয়াং জনগোষ্ঠীর।

এছাড়াও ২ জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সংরক্ষিত নারী সদস্য নির্বাচিত হবার কথা। বাকী সদস্যদের মধ্যে ১০ জন বাঙালী সদস্য এবং ১ জন বাঙালী নারী সদস্য।

৩৪ সদস্য খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে ১ জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ও ২১ সদস্যের মধ্যে ৯ জন চাকমা, ৬ জন ত্রিপুরা, ৬ জন মারমা। এছাড়াও ২ জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সংরক্ষিত নারী সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। বাকী সদস্যদের মধ্যে ৯ জন বাঙালি সদস্য ১ জন বাঙালি নারী সদস্য।

৩৪ সদস্যের বান্দরবান জেলা পরিষদের ১ জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ও ১৯ জন সদস্যের মধ্যে ১০ জন মারমা ও খিয়াং, ৩ জন ম্রো (মুরং), ১ জন ত্রিপুরা, ১ জন তঞ্চঙ্গ্যা, ১ জন (বম/লুসাই/পাংখো), ১ জন চাকমা, ১ জন খুমী জনগোষ্ঠীর। এছাড়াও ২ জন ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর নারী সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। বাকী সদস্যদের মধ্যে ১১ জন বাঙালি সদস্য এবং ১ জন বাঙালি নারী সদস্য।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তিতে জেলা পরিষদ আইনটি শক্তিশালী করা হয়। কিন্তু এ চুক্তির ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে নিজেদের প্রতিনিধি পায়নি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর জনগণ।

এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সরকার বদল হওয়ার পর পরিষদগুলো পুনর্গঠন হয়। কিন্তু যে সরকার ক্ষমতায় আসে সে সরকারের মনোনীত লোক বসানো হয় পরিষদগুলোতে। এতে পরিষদের কাছে জনগণের দাবির চেয়ে দলীয় দাবি প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

এ বিষয়ে প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিজয় কেতন চাকমা বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘পাহাড়ের আদিবাসীরা অধিকারবিহীন অবস্থায় অনিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করছে। যারা অধিকার দেবে তারা তালবাহনা করছে। এজন্য রাষ্ট্র দায়ী। কে আগে আসল কে পরে আসল এ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে। পাহাড়ের আদিবাসীরা কাউকে উচ্ছেদ করে বসতি স্থাপন করেনি। বরং পাহাড় জঙ্গলের মাঝে বাঘ ভালুকের ভয় উপেক্ষা করে এ পাহাড়ে মানুষের বসবাস যোগ্য করে তুলেছে। এখন আমাদের বলা হচ্ছে বহিরাগত। এখন আমাদের ভূমির, ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার নেই। এখানে সিভিল প্রশাসন অথর্ব অবস্থায় আছে। এটি নিরসন হওয়া দরকার। মানুষের ভূমির অধিকার, ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া দরকার।’

পাংখোয়া ওয়েলফেয়ার সোসিয়েল অর্গানাইজেশনের সভাপতি লাল ছোয়াক লিয়ানা পাংখোয়া বলেন, ‘দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করা আদিবাসীদের অবস্থা আরো করুন। তাদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। তাদের ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি হুমকির মুখে। তাদের সংস্কৃতি বিকাশের কাজ যথাযত হচ্ছে না। তাদের সংস্কৃতি এখন নকল করে অন্যরা চর্চা করছে যা করা ঠিক নয়। জেলা পরিষদে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হলে আদিবাসীরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে। তারা অধিকারের চর্চা করতে পারবে।’

রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মুনিরুজ্জামান মহসীন রানা বলেন, ‘জেলা পরিষদগুলো যেভাবে চলছে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এখানে শুধু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীরা নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এখানে জনপ্রতিনিধি না থাকায় পরিষদে নেয়া প্রকল্পগুলো জনমুখী নয়। এখানে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলের কল্যাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এটি নির্বাচন হলে সবাই নিজেদের অধিকার ফিরে পাবে।’

প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে জেলা পরিষদের নির্বাচনের বিকল্প নেই। অচিরেই এর নির্বাচন হওয়া দরকার। এটি না হওয়ার কারণে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘জেলা পরিষদের অবস্থা হতাশা জনক। জনগণের প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন বিহীন অবস্থায় রাখা হয়েছে এত বছর। মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। এটি শুধু ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর বেলায় নয় স্থায়ী বাঙালীরাও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সত্যিকারে গণতন্ত্র চর্চা করতে হলে এ প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন দরকার। নির্বাচিত পরিষদ হলে এখানকার মানুষ তাদের দাবি দাওয়া পরিষদের কাছে উত্থাপন করতে পারবে। তখন এটি গণমুখী হবে।’

চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মানে জেলা পরিষদের আইনগুলো যথাযত বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। জেলা পরিষদের মূল বিষয়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। অর্থাৎ হস্তান্তর করা হয়নি। হাজার হাজার ভূমি বিরোধের মধ্যে একটি ভূমির বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি। স্থানীয়দের নিয়ে ভোটার তালিকার তৈরির কাজ হয়নি। ভারত প্রত্যাগতদের পুনর্বাসন করা হয়নি। আভ্যন্তরীন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা হয়নি। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি দ্রুত বাস্তত্মবায়ন করা দরকার। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ের মানুষ তাদের অধিকার অনেকাংশে ফিরে পাবে।’

রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বলেন, ‘পরিষদের সুফল পেতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন না হওয়ায় কাজ করতে অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে। নির্বাচন হলে পাহাড়ের মানুষ সুফল পাবে।’

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ/ওয়াইএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত