ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে স্কুল

  আসিফ কাজল

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:০১  
আপডেট :
 ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:৫৫

প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে স্কুল

ঢাকার মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয় দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে। এই অকর্মের প্রাধান কারিগর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমাদ হোসাইন। ক্লাস বাণিজ্য, নিয়োগ পরীক্ষায় অর্থ বাণিজ্য, অবৈধভাবে শিক্ষকদের এমপিও, খণ্ডকালিন শিক্ষকদের সঙ্গে অনিয়ম ও বেতন নিয়ে ছলচাতুরী, বিদ্যালয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণ ও ভাড়া এহেন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি।

অবস্থা এমন যে, শিক্ষার্থী কমতে কমতে সংকটে স্কুলটি। এই বিষয়ে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি ও জেলা শিক্ষা অফিসেও অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে স্কুল থেকে একজন প্রধান শিক্ষক অবসরে যান। এরপরই কপাল খুলে যায় আহমাদ হোসাইনের। প্রধান শিক্ষকের অবসরের পর দায়িত্ব নেন ভারপ্রাপ্ত প্রধানের চেয়ারে। অথচ তখন তিনি ছিলেন একজন এমপিওভুক্ত ধর্ম শিক্ষক। এরপর ২০১৬ সালে দেয়া হয় প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। যার মেয়াদ ছিল মাত্র ৪ দিন। নিয়োগ পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়া হয় তাকে এরপরও তিনি পাস নম্বর তুলতে পারেননি। পরে খাতা পরিবর্তন করে হয়ে যান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এরপর মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে বাংলার শিক্ষক হয়ে নিজেকে এমপিওভুক্ত করেন। এরপরই রাতকে দিন আর দিনকে রাত করতে শুরু করেন এই প্রধান শিক্ষক।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই স্কুলের খণ্ডকালিন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্কুল থেকে বের করতে উদ্যত হন তিনি। উদ্যেশ্য নতুন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের নামে লাখ-লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণ।

একাধিক খণ্ডকালিন শিক্ষক বলেন, তার এই চাপের কারণে ৩জন শিক্ষক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন। বাকি যারা ছিলেন তাদেরকে ক্লাস-রুটিনে রাখা হয় না। অবাক করার বিষয় যারা বছরের পর বছর স্কুলে আসে না তাদের বেতন নিয়মিত ব্যাংকে চলে যায়। তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনে প্রধান শিক্ষকের হাতে দিয়ে যান। এসব শিক্ষক প্রতি মাসে একবার স্কুলে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, ২০১৮ সাল থেকে আমাদের কোনো ক্লাস দেয়া হয় না। এমনকি খণ্ডকালিন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তিন- চার মাস পর পর এক মাসের বেতন দেয়া হয়। এভাবেই চলে যায় ২০১৮ সাল। এরপর ২০১৯, ২০২০ সালে রুটিনে নাম দেয়া হলেও বেতন দেয়া হয়নি।

জানা যায়, স্কুলে কোনো নিয়োগ পরীক্ষা হলেই প্রতিষ্ঠান প্রধানের পকেটে ঢোকে ৫০ হাজার টাকা। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে যেসব শিক্ষার্থীর এক বিষয়ে ফেল রয়েছে সেক্ষেত্রে নেয়া হয় ১০০০ টাকা। দুই বিষয়ে ফেল থাকলে দুই হাজার টাকা এভাবে ১১ বিষয় ফেল করলে ১১ হাজার টাকা নেয়ার ঘটনাও রয়েছে।

এসএসসি কোচিং এবং মডেল টেস্টের নামেও পরীক্ষার্থীদের থেকে টাকা নেন এই প্রধান শিক্ষক। করোনার সময় শিক্ষকদের বেতন-বোনাস দেয়ার জন্য এক কোটি টাকার এফডিআর ভেঙে ফেলেছেন তিনি। এই টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা নিজের পকেটেও নিয়েছেন। অন্যদিকে ক্লাস রুটিন নিয়ে ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। যে তাকে কোচিং থেকে প্রতি মাসে একটা টাকার অংক দিতে পারবেন সে পাবেন ভালো ক্লাস। তার আরো একটি বড় বাণিজ্য হলো লাখ-লাখ টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে নিয়োগ প্রাপ্তদের মাউশি থেকে এমপিওভুক্তি। এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে কিনেছেন প্লট ও ফ্ল্যাট।

সহকারী শিক্ষক মো. হুমায়ুন কবির জানান, জানা যায়, বিদ্যালয়টিতে ২০১৪ থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আছেন এখলাছ উদ্দিন মোল্লাহ। যার বাড়ির কবুতরের খাবারের টাকা ও স্কুল থেকে প্রতি মাসে দিতে হয়। শুধু তাই নয় স্কুলের সব দোকানপাঠ গুলো তারা নিজেদের নামে উপহার হিসেবে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন।

প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঢাকার পাশে সাভার আশুলিয়ায় তিনটি জমি কিনেছেন। এছাড়ও মণিপুর স্কুলের কাছে একটা ফ্ল্যাটও রয়েছে তার।

সরেজমিনে দেখা যায় স্কুলের সঙ্গে পূর্ণিমা রেস্তোরাঁ হোটেলটি কার্যকরি পরিষদ ৯ ফুট প্রস্থ এবং ২০ ফুট দৈর্ঘ্য বিক্রি করেছে; কিন্তু দখল দেয়া হয়েছে প্রায় ৫ কাঠা জায়গা। স্কুলের সামনেই রয়েছে একতলা একটি মার্কেট। যে দোকানগুলোও বিক্রি হয়ে গেছে। এছাড়াও স্কুলের পুরনো ভবনের দ্বিতীয় তলায় ঠিকাদারকে মালামাল রাখতে ৫টি রুম ভাড়া দিয়েছেন এই প্রধান শিক্ষক। এমনকি স্কুলের মাঠটিও প্রায় সময় ভাড়া দিয়ে সেই টাকা নিজের পকেটে রেখে দেন আহমাদ হোসাইন।

একাধিক শিক্ষক জানান, ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে বিদ্যালয়ের অর্থায়নে নিয়োগ দেয়া হয় শাহ্ আলম সরকারকে ও ২২ বছর আগে স্কুলের অর্থায়নে নিয়োগ দেয়া হয় মোস্তারী জাহান ফেরদৌসকে। এই নিয়োগের পর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এমপিও করে আনা হয়। এছাড়াও শিক্ষক মো. মোশারেফ হোসেনকে ২০২১ সালের মে মাসে এমপিওভুক্ত করা হয়। যা ছিলো সম্পূর্ণ অনৈতিক।

অভিযোগ রয়েছে জন্নাতারা মুন্নির নিবন্ধন পরীক্ষার সার্টিফিকেট নেই। জাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে তার এমপিও করতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য গৌরাঙ্গ মোহন রায় বলেন, আপনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।

তবে সব অভিযোগকে কাল্পনিক বলে জানান প্রধান শিক্ষক আহমাদ হোসাইন। তিনি বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় খাতা টেম্পারিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এছাড়াও এমপিওর বিষয়ে যে দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আমার কোনো হাত নেই। কারণ এমপিও করে মাউশির আঞ্চলিক অফিস।

স্কুলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে রাখা হয়েছে ঠিকাদারি সরঞ্জাম

স্কুল ঘর ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, স্কুল ঘরটি ভাড়া নয়, একজন কাউন্সিলর মালামাল রেখে গেছেন। এ কারণে মাসে তিনি সিকিউরিটি হিসেবে ১০ হাজার টাকা স্কুলে দেন। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে কবুতরের খাবার কিনে দেয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (বিদ্যালয়) বেলাল হোসাইন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, অভিযোগগুলো গুরুতর। আমি অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

বাংলাদেশ জার্নাল/একে/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত