ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

নিয়োগ পরীক্ষায় নজিরবিহীন দুর্নীতি

  আসিফ কাজল

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫৪  
আপডেট :
 ০৭ এপ্রিল ২০২২, ১৭:১৩

নিয়োগ পরীক্ষায় নজিরবিহীন দুর্নীতি

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে মাস্টাররোলে চাকরি করেন হাসিব। সম্প্রতি অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপানো থেকে শুরু করে আইসিটির যাবতীয় কাজ করেছেন তিনি। একইসঙ্গে শিক্ষা প্রকৌশল নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শেষমেষ মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি নিয়োগ পরীক্ষায় এমন সংবেদনশীল কার্যক্রমে সম্পৃক্ত কেউ যখন নিয়োগ পরীক্ষায় নিজেই অংশ নেন, তা চরম অনৈতিক।

এ অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদ হাসিব প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। বাংলাদেশ জার্নালকে তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র টাইপিং আর আইসিটির কাজ করার সঙ্গে আমার পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি আসলে কর্তৃপক্ষ বুঝবে। তিনি বলেন, প্রশ্ন প্রণয়ণের আগের রাতে মিটিং ছিল। ওই রাতে বই থেকে প্রশ্ন তৈরি করা হত। কিন্তু যেদিন আমার পরীক্ষা ছিল সেদিন আমি ওখানে ছিলাম না।

অন্যদিকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আসাদুজ্জামানের পিয়ন মো. রায়হান। অভিযোগ রয়েছে কর্মকর্তার আশীর্বাদ পেয়ে তার আত্মীয় শালা-শালিও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন। এসব চাকরি প্রার্থীর সরকারি চাকরি হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা। নিজের আত্মীয় স্বজনের চাকরি দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে মো. রায়হান বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পাবে। নিজের আত্মীয়দের চাকরি দিকে দুর্নীতির প্রশ্নেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

২০১৫ সালের বিজ্ঞপ্তি ও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদপ্তরে ১১-২০ তম গ্রেড পদে ১২৫০ পদে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা চলছে। এই নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র কওে অর্থ লেনদেন, স্বজনপ্রীতিসহ নিয়োগে ভয়াবহ দুর্নীতিও কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ জার্নালের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন যারা লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন মৌখিক পরীক্ষায় তারা এক থেকে ২০ পর্যন্ত লিখতে পারেনি। অথচ তাদের ভাগ্যেই স্বজন-প্রীতির মাধ্যমে জুটছে সরকারি চাকরি। অথচ মাস্টার্স পাস করেও অনেক প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় পাস করেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদস্য সচিবের অ্যাডমিন আইডি ব্যবহার করে টেলিটকের মাধ্যমে যে প্রবেশপত্র সরবরাহ করা হয়েছে, সেখানে ভুয়া ছবি বসিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো পরীক্ষার্থীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ২০১৫ সালের নিয়োগ পরীক্ষায় অনেক পরীক্ষার্থী আবেদন না করেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এই ঘটনার সত্যতা মিলেছে মৌখিক পরীক্ষায়। এমন চার পরীক্ষার্থীকে শনাক্ত করা হয়েছে যাদের লিখিত পরীক্ষার স্বাক্ষরের সঙ্গে মিল নেই।

জানা যায়, শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমানের পিয়ন জসিম। সে রাজস্বভুক্ত কর্মচারী। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে একাধিক ব্যক্তিকে সিন্ডিকেট করে চাকরি দিচ্ছেন। প্রধান প্রকৌশলীর আরেক পিয়নের নাম হিমেল। তবে তিনি মাস্টাররোলে কর্মরত। এবার তিনি রাজস্বভুক্ত হবেন। কারণ নিয়োগ পরীক্ষায় এবার তিনি পাস করেছেন।

এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমানকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে শিক্ষাপ্রকৌশলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, উপপরিচালক মো. আসাদুজ্জামান নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতি করেছেন কি না তা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। এই ঘটনায় এখনো লিখিত অভিযোগ বা সংবাদ প্রকাশ হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, যা নজিরবিহীন। অর্থাৎ তিনি দুর্নীতি করে পদত্যাগের মাধ্যমে পার পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

আসাদুজ্জামানের পদত্যাগপত্রের কপি বাংলাদেশ জার্নালের হাতে রয়েছে। এই পত্রে তিনি লিখেছেন, এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও সংরক্ষণসহ সকল কার্যক্রম বিভাগীয় পদোন্নতি/নির্বাচন কমিটির সভাপতি হিসেবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরিচালকের (প্রশাসন) নিয়ন্ত্রাধীন ছিল। এ ছাড়া, এমসিকিউ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, ব্যবহারিক পরীক্ষা গ্রহণপূর্বক ফলাফল সংরক্ষণসহ মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে নম্বর প্রদান ও তার ফলাফল সংরক্ষণও একই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ফলে, আমার পক্ষে কোনো ধরনের অনিয়ম করার প্রশ্নই আসে না। এ বিষয় সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি এবং একই সাথে এ নিয়োগ কার্যক্রম বা অন্য কোনো দাপ্তরিক কাজে আমার কোনো প্রকার শৈথল্য, অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমার বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ারও অনুরোধ করছি। এছাড়াও নিয়োগ কার্যক্রম বিতর্কমুক্ত রাখতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব হিসেবে অব্যাহতি চেয়েছেন তিনি।

নিয়োগ পরীক্ষায় অফিস সহকারী পদে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন আবু হানিফ। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষাপ্রকৌশলে মাস্টাররোলে কাজ করেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে নিয়োগ কমিটি। বাংলাদেশ জার্নালকে তিনি বলেন, মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে ধমক ও পুলিশে দেয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। আবার একই নিয়োগ পরীক্ষায় আমি দুজন প্রার্থীকে ছবি পরিবর্তনের কারণে আটকে রাখার মত ঘটনা ঘটেছে। তিনি জানান, ডিডির আত্নীয় শামীম, আবিদ, তারাও চাকরি পাচ্ছেন।

জানতে চাইলে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও শিক্ষা প্রকৌশলের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. রাহেদ হোসেন বলেন, শিক্ষাপ্রকৌশলের কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজনের চাকরির বিষয়টি আমার নজরেও এসেছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়া হচ্ছে না যে তদন্ত করবো। তিনি আরো বলেন, আমি যে নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা নিয়েছি। এর মধ্যেও যদি কোনো কিছু হয় তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

রায়হান ও হাসিবের বিষয়ে তিনি বলেন, যে যেই কাজই করেছেন, তার আগেই সবার মোবাইল জব্দ করা হয়েছিল। পিয়নরা সিলগালা ও অন্যান্য কাজ করেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁসের সুযোগ আমি দেখি না।

আসাদুজ্জামানের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, যে নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

এমন অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদপ্তরের আসাদুজ্জামানের অফিস কক্ষে একাধিক দিন গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি মুঠোফোনে একাধিক এমএমএস ও কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এমন দুর্নীতি ও অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দিককে জানানো হলে বাংলাদেশ জার্নালকে তিনি বলেন, এমন ঘটনা আমার জানা ছিল না। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

বাংলাদেশ জার্নাল/একে/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত