ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

মাউশির ডিডির বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ

মুখে মধু অন্তরে কী

  আসিফ কাজল

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২২, ১৮:৪০  
আপডেট :
 ১৩ আগস্ট ২০২২, ১৯:১৮

মুখে মধু অন্তরে কী

‘আমার এখানে সেবা নিতে এক কাপ চা খাওয়াতে হয় না। এখন থেকে তদবির করতে এখানে আসতে হবে না। ইমেইলে আবেদন করবেন, তাতেই কাজ হবে।’

সর্বদাই শিক্ষকদের এমন মধুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজ উদ্দিন।

কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বাস্তবে তার ওখানে নাম সংশোধন থেকে বদলি কোনো কিছুই তদবির ছাড়া হয়নি। মুখে মিষ্টি কথায় আশ্বাস দেন তিনি। কিন্তু কর্মে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই।

জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অ্যাকাডেমিতে (নায়েম) দুজন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য একটি কামরা বরাদ্দ আছে। প্রশিক্ষণার্থী না হওয়ার পরও দীর্ঘদিন নায়েমের একটি কামরা দখল করে ছিলেন তিনি। নোটিশ দেয়ার পর নায়েম ছেড়ে উঠেছেন খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টারে। সেখানে ব্যবহার করছেন বিদ্যালয়ের সোফা, ফ্রিজ। এমনকি দুজন কর্মচারী সর্বদাই তার দেখভালে ব্যস্ত। এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজ উদ্দিন।

শিক্ষকরা বলছেন যার কক্ষে গেলে শুধুই দুর্নীতিবিরোধী গল্প শোনাতেন, তার এহেন কর্মকাণ্ড যেন এখন বিষের মতো লাগছে।

জানতে চাইলে খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুন্নেছা বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, এই বিষয়ে আমি মোবাইলে কোনো কথা বলবো না। আপনি শনিবার স্কুলে আসেন। শনিবার সরেজমিন স্কুলে গেলে প্রতিবেদককে প্রধান শিক্ষিকা বলেন, বিদ্যালয়টিতে প্রধানশিক্ষিকার জন্য যে কোয়ার্টার বরাদ্দ ছিল, তা বসবাসের অনুপোযোগী বিধায় আমি থাকি না। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কেউ যদি বলেন, আমি থাকবো তখন আর কিছু বলার থাকে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই কোয়ার্টারে প্রধান শিক্ষক মেহেরুন্নেছা না থাকলেও তিনি সরকারকে নিয়মিত বেতন থেকে ৩৫ হাজার টাকা দিচ্ছেন। কার স্বার্থে বেতনের টাকা দিচ্ছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি নারায়ণগঞ্জ থাকতেও কোয়ার্টারে ছিলাম না। অথচ সরকারকে টাকা দিতাম। আমার স্বামী চিকিৎসক বিধায় আমার তেমন কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা নেই।

অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি স্কুলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকা তিন বছরের বেশি সময় না থাকার বিধান থাকলেও এই প্রধান শিক্ষক একটানা ৭ বছর এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে রয়েছেন ডিডি আজিজের ছত্রছায়ায়।

খিলগাঁও সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, এই ঘটনার কারণে মাউশির অর্ডার নিয়ে এসেছেন তিনি। আপনারা পারলে মাউশিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। সবাই শুধু শিক্ষকদের সঙ্গেই পারেন।

অন্যদিকে এই উপ-পরিচালকের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে ধর্ম পিতা বানিয়ে একটানা সাতবছর ডিডি পদে কর্মরত ছিলেন এই উপপরিচালক আজিজ। নানা কেলেংকারী ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে লিয়েনে ৫ বছরের জন্য তাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয়। এত দিন লিয়েনে বিদেশ থাকার অনুমতি নজীরবিহীন বলে জানান শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এরপর বিদেশ থেকে তাকে মাউশিতে আবার একই পদে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সত্যিই বিস্ময়কর। সেসিপের ১৮৫ কোটি টাকা লোপাটের সাথে জড়িত দুদকের মামলা চলছে মাউশির সাবেক ডিজির বিরুদ্ধে। অনেকের মতে এই কাণ্ডে ডিডি আজিজের সখ্যতা থাকায় বিদেশ থেকে এনে এই পদে বসানো হয়েছে।

জানতে চাইলে, মাউশির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একজন সরকারি চাকরে যদি সরকারি কোয়ার্টার ব্যবহার করেন তবে তিনি সরকারি বেতনের ৪০ হাজার টাকা নিতে পারেন না। অথচ তিনি সরকারি আবাসনও ফ্রিতে ব্যবহার করছেন অন্যদিকে সরকারের টাকাও নিচ্ছেন। যা একজন উর্ধ্বতন শিক্ষা কর্মকর্তার জন্য অত্যন্ত অনৈতিক।

সম্প্রতি মাউশি বিদ্যালয় শাখার এই উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মাউশি প্রশ্নফাঁসের মত ঘটনায় ডিডি আজিজের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এছাড়াও টাইমস্কেল সংক্রান্ত ঘটনায় এককোটি তিরাশি লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয় শিক্ষকদের থেকে। এই ঘটনায় চাঁদা তুলেন শিক্ষক সালাম। অবৈধ এ কাজে সহোযোগিতা করেন আজিজ উদ্দিন। এই কাজ বাস্তবায়নে সিনিয়র শিক্ষক পদোন্নতির গোপনীয় প্রেডেশন তালিকার বিএড শর্তের কলাম মুছে দিতে তালিকার সফট কপি ঢাকার নীলক্ষেতের একটি বাণিজ্যিক দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে পদোন্নতির যোগ্য তেরো শতাধিক শিক্ষক পদোন্নতি তালিকায় বৈষম্যের স্বীকার হয়। নন-ক্যাডার কর্মচারী জ্যেষ্ঠতা বিধিমালা-২০১১ এর নির্দেশনা অনুযায়ী চুড়ান্ত গ্রেডেশন তালিকা প্রকাশ না করে পরদিন এই ত্রুটিপূর্ণ গ্রেডেশন তালিকা ডিপিসি সভায় হাজির করেন তিনি। এছাড়াও একইভাবে অনৈতিক লেনদেনের কারণে সন্তোষজনক চাকরিকাল না থাকলেও ১৬৭৮ জন নিয়োগ শর্ত ভঙ্গকারীকে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদায়নের জন্য আজিজ উদ্দিনের পরামর্শে শিক্ষক সালাম নিজেদের সিন্ডিকেটের ৫৬জনকে গোপনে তড়িঘড়ি করে পদায়নের জন্য একটি নোটিশ করেন। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষকরা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর করলে মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড আজিজ উদ্দিনকে ডেকে ভর্ৎসনা ও সতর্ক করে।

অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, প্রধান শিক্ষক পদোন্নতি দিতে প্রমার্জনের আবেদনপত্রে সমিতির সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর জাল করেন সালাম। আবেদনে সমিতির দপ্তর সম্পাদকের স্বাক্ষর ও স্মারক নম্বর ছিল না। সমিতির দপ্তরে এর কোনো অনুলিপি পর্যন্ত নেই। সিনিয়র শিক্ষক পদোন্নতির সময় প্যাডকান্ড করে যে বিতর্ক করেছিল সেই একই কাজ মামলা সালাম অব্যাহত রাখে। যার নেপথ্য কারিগর এই আজিজ উদ্দিন।

মাউশির বিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক আজিজ উদ্দিন প্রথমে এমন অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানেন না বললেও পরে তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, নায়েম থেকে চলে আসার পর আমি ডিজি মহোদয়ের কাছে এই কোয়ার্টারে থাকার আবেদন করি। এই বিষয়ে চলতি মাসের ৭ তারিখ ডিজি মহোদয় অর্ডারও দিয়েছেন।

শিক্ষক সালামের তার সখ্যতার বিষয়ে বলেন, তিনি মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আমার কক্ষে আসেন। কিন্ত কেউ এলে তো কাউকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করা যায় না। সেসিপের দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, সেসিপের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ওখানে চাকরিও করি না।

তিনি আরো বলেন, মাধ্যমিক শাখায় আমি কোনো ফাইল ওঠায়ও না, কোনো স্বাক্ষর ও করি না। কোনো কিছু অনুমোদনও করি না। কিছু দুস্কৃতিকারী এগুলো ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক মো. বেলাল হোসাইন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টারে থাকতে যদি ডিজি স্যার অর্ডার দিয়ে থাকেন, তাহলে এ ব্যাপারে আমার বলার কোনো এখতিয়ার নেই।

এ ব্যাপারে জানতে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের মুঠোফোনে কল দেয়া হলে বন্ধ পাওয়া যায়। পরে জানা যায় তিনি দেশের বাইরে। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ জার্নাল/একে/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত