ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

জটিলতায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:০৭

জটিলতায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) দেওয়ার প্রকল্প শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) আইডি কার্ড তৈরিতে ৫৩ কোটি বাড়তি ব্যয়, প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বাড়তি বরাদ্দসহ অনেকগুলো বিষয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। প্রকল্পটি অনুমোদন করতে একনেক সভায় না তুলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পিইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে ডিজিটাল আইড কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই আইডি কার্ডের মাধ্যমে সরকারের সব সেবা দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের খাতগুলো হলো- কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ এক কোটি ৭৩ লাখ, উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ১৬ কোটি ১৭ লাখ, তথ্য সংগ্রহ ও ফরম মুদ্রণ চার কোটি ৩৪ লাখ, শিক্ষার্থীদের ছবিসহ তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই ২১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ছবিসহ অনলাইনে ডাটা এন্ট্রি ৩৬ কোটি ৮০ লাখ, লেমিনেটিং আইডি কার্ড প্রিন্টিং এক কোটি ৩০ লাখ, সরবরাহ ও সেবায় চার কোটি ৭০ লাখ, এনআইডি ভেরিফিকেশন আট কোটি টাকা, সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট ও ডাটা ক্লিনিং দুই কোটি টাকা।

‘প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল প্রণয়ন’ প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা উইং ডিপিপির যেসব বিষয়ে আপত্তি তুলেছে সেগুলো হলো, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)-এর মাধ্যমে যাচাই করার যে দাবি করা হয়েছে, ডিপিপিতে তা যুক্ত করা হয়নি। প্রকল্পের ১৪ জন কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব করা হলেও ডিপিপিতে তার তিন রকম তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে, কিন্তু ব্যয় বিভাজন নেই। ফলে ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আপত্তিতে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল আইডেন্টিফিকেশন ডিপার্টমেন্ট (এনআইডি) যাচাই করতে আট কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট দলিলাদি ডিপিপিতে নেই। প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে একটি অংশে ৪৬ কোটি ৩১ লাখ ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ক্রয় নিয়েও সঠিক বর্ণনা নেই ডিপিপিতে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে নতুন শিক্ষার্থীদের কীভাবে আইডি কার্ড দেওয়া হবে বা কার্ড হারিয়ে গেলে কীভাবে সরবরাহ করা হবে তার ব্যাখ্যা নেই। প্রকল্পের অধীন ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের দুই কোটি ১৭ লাখ শিক্ষার্থীকে আইডি কার্ড দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে চলতি বছর এ সংখ্যা আরও বাড়বে। বাড়তি শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভুক্ত করার বিষয়ে কোনো প্রস্তাব নেই। এছাড়া ইবতেদায়ির শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব করা হয়নি। ময়মনসিংহ বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভুক্ত করা হয়নি।

আপত্তিতে আরও বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় একই ধরনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। যাতে শিক্ষার্থী প্রতি আইডি কার্ড তৈরিতে সাড়ে ৫৭ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৮২ টাকা ৭০ পয়সা প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ এ খাতে বাড়তি ৫৩ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। আইসিটি বিষয়ক কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি ও টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে তার ওপর নির্ভর করে ব্যয়। কিন্তু এ প্রকল্পে আন্তঃসমন্বয় হয়নি। শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করতে ফরম ছাপানো, ফরমের মাধ্যমে ছবিসহ তথ্য সংগ্রহ করে তা অনলাইনে আপলোড করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান ওয়েসবেইজড সফটওয়ার ও ক্লাউড কম্পিউটিং যুগে এ সবের দরকার হয় না। সফটওয়ারে ফর্ম আপলোড করা যেতে পারে। ডাটা এন্ট্রির পর তা প্রিন্ট করে হার্ড কপি সংরক্ষণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে লেমিনেটিং আইডি কার্ড বিতরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ডিপিপিতে। আবার এ কাজে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রিন্টার ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও বিনোদন ব্যয় দুইবার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ব্যয় প্রস্তাবেও ব্যাপক অসঙ্গতি রয়েছে।

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এমন কোনো প্রকল্প নেই যাতে অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশ ভ্রমণের খরচ ধরা হয় না। ফিনল্যান্ডে এ ধরনের একটি প্রকল্প রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতেই প্রকল্পে বিদেশে সফরের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকার মনে করলে তা বাদ দেওয়া হবে। নতুন শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড দিতে প্রকল্পে থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় কীভাবে খরচ কম ধরেছে তাদের ডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখাব। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিগুলো ডিপিপিতে সংশোধন করে একনেকে অনুমোদন করতে পাঠানো হবে।’

ডিপিপি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকস্তরে দুই কোটি ১৭ লাখ শিক্ষার্থীকে একক ডিজিটাল আইডি দিতে ডিপিপি তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আইডি কার্ডে শিক্ষার্থীর ছবি, তার পরিবারের তথ্য, ঠিকানাসহ সব তথ্য থাকবে। এই আইডি দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে। একই আইডি দিয়ে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত সব সেবা অর্থাৎ বই বিতরণ, ভর্তি, উপবৃত্তি বিতরণ করবে। শিক্ষার্থী ঝরে গেলে তার তথ্যও সেখানে থাকবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)।

প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটার স্ট্যাটিসটিকস (সিআরভিএস) ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১৩ সালে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে সিআরভিএস গঠনে আরেকটি সভা হয়। সভায় সব নাগরিকের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ তথ্য উপাত্ত আকারে সংরক্ষণ এবং এর মাধ্যমে সরকারি সব সেবা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি সভা হয়। সভায় প্রাথমিকস্তরের সব শিক্ষার্থীকে একটি তথ্য ভাণ্ডারে নিয়ে আসতে সিআরভিএস গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের ১০ কোটি নাগরিকের ইলেকট্রনিক ডাটাবেজ তৈরি করেছে। সংস্থাটি এই তথ্যভাণ্ডারের মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিচ্ছে। স্থানীয় সরকার ১২ কোটি নাগরিকের আরেকটি ডাটাবেজ তৈরি করেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১০ কোটি নাগরিকের সময়ভিত্তিক স্বাস্থ্য শুমারি করেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ১৬ কোটি নাগরিকের জন্য একটি দারিদ্র্যভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। এ সব ডাটাবেজ পারস্পরিক সমন্বয়যোগ্য বা ক্রিয়াশীল না হওয়ায় তা হতে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কোনো তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্যা থেকেই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একক সিআরভিসি তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে ২২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ধরনের আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের একই ধরনের আইডি কার্ড দেওয়া হবে। কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্ট্রাকিং করা যাবে বলে জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে- সমন্বিত শিক্ষা তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা। ব্যানবেইস হবে সব সংস্থার ও শিক্ষা বোর্ডের তথ্য আদান-প্রদানের একক উৎস। দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকারের খরচ হবে ৫০৮ কোটি টাকা। তবে দুটি প্রকল্পের ব্যয়ের বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশোধন করে ফের ডিপিপি জমা দিলে প্রকল্প দুটি একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

/এসকে/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত