কাপড় সেলাই করে বিসিএস উত্তীর্ণ শিল্পীর পড়াশোনার খরচ জোগাতেন মা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৪১
ক্লাস এইট পর্যন্ত কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়েননি শিল্পী মোদক। মা-ই ছিলেন তার শিক্ষক। হবিগঞ্জের রামকৃষ্ণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে তিনি জুনিয়র বৃত্তি লাভ করেন। সে সময়কার প্রধান শিক্ষক শিল্পীর নাম স্কুলের দেয়ালে লিখে রাখেন। সেই প্রধান শিক্ষক আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তার প্রিয় ছাত্রী শিল্পীর নাম আজও স্কুলের দেয়ালে আছে। সেই মেধাবী শিল্পীই ৩৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
স্কুলের পরীক্ষায় সবসময় প্রথম হয়েছেন শিল্পী। পরিবারে আর্থিক অনটন ছিল, কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে মা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন, কিন্তু ভালো ফলাফলের জন্যই শিল্পীকে স্কুলে বেতন দিতে হতো না; এমনকি শিক্ষকরাই তাকে বই দিতেন। স্কুলে সবসময় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা ও গানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ২০০৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় দারিদ্র্যকে খুব ভালোভাবে বুঝতে শেখেন। তখন থেকেই টিউশনি শুরু। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তির পর প্রতিদিন মেহেন্দীবাগ এলাকার বাসা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে কলেজে আসতেন। কলেজের শিক্ষকরা আন্তরিক ছিলেন, এদের মধ্যে বিনাবেতনে প্রাইভেট পড়িয়েছেন কয়েকজন।
২০০৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হন শিল্পী। তবে যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন, তাই বাংলা ছেড়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ও বীজবিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতিদিনই বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত টিউশনি করাতেন নিজের খরচ জোগাড়ের জন্য। অনার্স ও মাস্টার্স, দুটোতেই সিজিপিএ ৩.৯ পেয়ে পড়াশোনা শেষ করেন, আর এই অসাধারণ ফলাফলের জন্য অর্জন করেন রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন, কিন্তু সার্কুলার না হওয়াতে শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। মাঝে শাহজালাল সিটি কলেজে এক বছর শিক্ষকতা করেছেন।
৩৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার একমাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দিনরাত পড়াশোনা শুরু করেন। সারাক্ষণ বইয়ে ডুবে থাকতেন দেখে মা-ই তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। বিসিএসে ধাপে ধাপে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর অবশেষে ফলাফলে তিনি সুপারিশপ্রাপ্ত হলেন প্রশাসন ক্যাডারে। শিল্পী চান তার মতো মেয়েদেরকে সাহায্য করতে, যারা দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি দেশসেবা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। প্রশাসন ক্যাডার তাকে সেই সুযোগ দেবে বলে বিশ্বাস তার।
আরো পড়ুন:
ফারজানার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প
নৌবাহিনী কর্মকর্তা বাবার হাত ধরে ১৯৯৫ সালে প্রথম স্কুলে যান উম্মে হাবিবা ফারজানা। ভর্তি হন চট্টগ্রামের বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল ও কলেজে। সেখান থেকে বেরিয়েছেন ১২ বছর পর, ২০০৭ সালে। তবে তার এই এক যুগের শিক্ষা জীবনে শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন তার বাবা। পড়াশোনা আর জানার প্রতি আগ্রহ তৈরিতে বাবার অবদান বেশি। এটিই ছিল ফারজানার সাফল্যের মূলমন্ত্র, যে কারণে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েও তিনি ৩৭তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
এস এম মাহবুবুর রহমান ও বিলকিস খানম দম্পতির বড় সন্তান ফারজানা। বরিশালের পিরোজপুরে পৈত্রিক বাড়ি হলেও বাবার চাকরিসূত্রে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।
পরিবারের স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পর ফারজানা তেমন পড়াশোনাই করেননি। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না। যেহেতু সাধারণ জ্ঞান ও বাংলা-ইংরেজি ভালোই পারতেন, তাই সুযোগ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় মাত্র ১৯ বছর বয়সেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেল। শুরুতে এ নিয়ে অনেকরকম জল্পনা-কল্পনা থাকলেও বাস্তবে সংসার সামলানোর পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন—এটা উপলব্ধি করলেন।
মাঝে মাঝে বিষণ্নতা অনুভব করলেও তা কাটিয়ে উঠে নিজেই নিজেকে অনুপ্রেরণা দিতেন। মাস্টার্স ফাইনালের সময় সন্তান গর্ভে। আসল সংগ্রাম শুরু হলো তখন থেকে। পারিবারিক ব্যস্ততায় মাও সময় দিতে পারেননি। পুরোটা সময় নিজেই নিজেকে সামলেছেন। মেয়ের জন্মের পর দু’বছর পোস্ট-ন্যাটাল ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, তবে এর প্রভাব মেয়ের ওপর পড়তে দেননি। এভাবেই চার বছর কাটল, মেয়ে কিছুটা বড় হলো। এই চার বছরে ফারজানা কোনো পড়াশোনা করেননি। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন, কিন্তু সংগ্রাম করে বিসিএস ক্যাডার হওয়া অন্যদের গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের মনে শক্তি সঞ্চার করলেন। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলেন। সারাদিন বিরামহীনভাবে সংসার সামলে বই ধরার ফুসরত মিলত যখন, তখন অন্যরা ঘুমের রাজ্যে।
ফারজানা ভাবলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণের করের টাকায় পড়াশোনা করে তিনি ঋণী হয়েছেন, সেই ঋণ তাকে শোধ করতে হবে। সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আছে। ৩৭তম বিসিএসে আবেদন করার পর যখন প্রিলিমিনারির প্রস্তুতি শুরু করলেন, তখন পরীক্ষার মাত্র ২ মাস বাকি। পরীক্ষার আগে হঠাৎ জলবসন্ত হল, এ অবস্থাতেই পরীক্ষা দিলেন। উত্তীর্ণ হলেন এই ধাপে। পরে দেড়মাস দিনরাত পড়াশোনা করে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এসময় তার স্বামী, মা ও বোন সহযোগিতা করেছেন। এই ধাপেও উত্তীর্ণ হলেন ফারজানা। রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে পড়তে বসতেন। এভাবেই পরিক্ষার ভাইভা’র সময় এসে গেল। অবশেষে ফলাফল প্রকাশের পর ফারজানা দেখলেন তিনি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এটি যে তার প্রথম বিসিএস ছিল তাই নয়, এটি ছিল প্রথম চাকরির পরীক্ষাও!
ফারজানা বললেন, ‘আমি নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছি। শুরুতে আমাকে নিয়ে কেউ তেমন আশাবাদী ছিলেন না। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর আমার বাবা-মা, স্বামী, শ্বশুরসহ সবাই সহযোগিতা করেছেন, উত্সাহ দিয়েছেন, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
তিনি বলেন, ‘সফলতার জন্য নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। আমি মানুষ, আমি একটা আলাদা সত্ত্বা। আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আর এজন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো পরিশ্রম। সে বিষয়ে কখনোই পিছপা হওয়া যাবে না।’
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ফারজানা বলেন, ‘থেমে গেলে চলবে না। ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে। যে সময়টা পাওয়া যায় তার পুরোটা সঠিক ব্যবহার করতে হবে। কাজে লাগাতে হবে। আর পড়াশোনা চলাকালে সব রকম ডিভাইস থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে যতটুকু সময় পড়ার, সে সময়টা পুরোপুরি পড়লে সফলতা আসবেই।