ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১২ মিনিট আগে
শিরোনাম

মসজিদে হামলায় বাংলাদেশি শিক্ষক দম্পতি নিহত, ছেলে নিখোঁজ

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০১৯, ১৭:১৬  
আপডেট :
 ১৫ মার্চ ২০১৯, ১৭:১৮

হামলায় বাংলাদেশি শিক্ষক দম্পতি নিহত, ছেলে নিখোঁজ
শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় দুই মসজিদে বন্দুকধারীর হামলায় নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান ভুইয়া।

তিনি বলেন, নিহতদের মধ্যে দুজন হলেন- স্থানীয় লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুস সামাদ ও তার স্ত্রী। নিহত আরেকজন হলেন- গৃহবধূ হোসনে আরা ফরিদ।

নিহত ড. সামাদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অনুষদের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। ছেলেসহ এই দম্পতি নামাজে গিয়েছিলেন। হামলার পর থেকে ছেলে নিখোঁজ।

শফিকুর রহমান ভুইয়া আরো জানান, মসজিদে হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই জনের অবস্থা গুরুতর। এছাড়া গোলাগুলির ঘটনার পর থেকে তিন বাংলাদেশি নিখোঁজ রয়েছেন।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. জহির উদ্দিন বলেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুস সামাদ কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ছিলেন। তার তিন ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। তিনি নিউজিল্যান্ডে সিটিজেনশিপ নিয়ে দুই ছেলে ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করতেন। আরেক ছেলে বাংলাদেশেই থাকতেন। তার সহকর্মী কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুস সামাদ পাঁচ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি ছেড়ে নিউজিল্যান্ডের পাড়ি জমান। ক্রাইস্টচার্চের হামলার ঘটনায় ড. মুহাম্মদ আবদুস সামাদ ও তার স্ত্রী নিহত হয়েছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. জহির উদ্দিন বলেন, 'অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুস সামাদ কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ছিলেন। তার তিন ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। তিনি নিউজিল্যান্ডে সিটিজেনশিপ নিয়ে দুই পুত্র ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করতেন। আরেক পুত্র বাংলাদেশেই থাকতেন।

শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা দেড়টার দিকে ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসলমানদের ওপর হামলা চালান ওই বন্দুকধারী। পরে কাছাকাছি শহরতলি লিনউডের মসজিদে হামলা চালানো হয়। তবে দ্বিতীয় মসজিদে হামলাকারী একই ব্যক্তি কি না, তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শী কারও কারও মতে, হামলাকারী একাধিক ছিলেন।

হামলাকারী অস্ট্রেলীয় নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হামলাকারীর পরিচয় নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, হামলাকারী কট্টর ডানপন্থী। তবে তার নাম প্রকাশ করেননি তিনি। স্কট মরিসন বলেন, ক্রাইস্টচার্চে একজন উগ্র মনোভাবের অধিকারী ডানপন্থী উন্মত্ত জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া নাগরিক। তবে তিনি বিস্তারিত আর কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি তদন্ত করছে।

অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীর নাম ব্রেনটন ট্যারেন্ট। বয়স ২৮ বছর। তিনি অভিবাসীবিরোধী কট্টরপন্থী। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন জানিয়েছেন, হামলাকারী নিরাপত্তা নজরদারির তালিকায় ছিল না।

হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ চারজনকে আটক করেছে নিউজিল্যান্ড পুলিশ। বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে একটি গাড়ি থেকে। নিউজিল্যান্ডের কোথাও কোনো মসজিদে মুসলিমদের যেতে নিষেধ করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে মসজিদগুলো আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। শহরজুড়ে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ্যারডের্ন এ ঘটনার নিন্দা প্রকাশ করে বলেছেন, এ ঘটনা নিউজিল্যান্ডের জন্য ঘোর অমানিশা। জেসিন্ডা অ্যারডের্ন টুইটে বলেছেন, ‘ক্রাইস্টচার্চে নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার জায়গা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী সম্প্রদায়ের। নিউজিল্যান্ডেই তাদের বাড়ি। তারা আমাদের লোক।’

মসজিদটি হ্যাগলি ওভাল মাঠের কাছাকাছি হওয়ায় জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা অনুশীলন শেষে সেখানে নামাজ আদায়ের জন্য যাচ্ছিলেন। শুক্রবার অনুশীলনে লিটন দাস ও নাঈম হাসান ছাড়া দলের অন্য সবাই ছিলেন। ক্রিকেট দল মসজিদে প্রবেশের মুহূর্তে সেখানে হামলার ঘটনা ঘটে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হামলা হয়েছে জানিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে ক্রিকেট দলকে নিষেধ করলে খেলোয়াড়রা দ্রুত সেখানে থেকে ফিরে আসেন।

এ ঘটনার পর ক্রিকেটার তামিম ইকবাল টুইটে জানান, এটা তাদের জন্য ‘ভীতিকর অভিজ্ঞতা’ ছিল, বন্দুকধারী সেখানে হামলা চালিয়েছিল। তামিম টুইটে লেখেন, ‘পুরো দল বন্দুকধারীর হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। এটা ভীতিকর অভিজ্ঞতা। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জানান, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব খেলোয়াড়দের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মুখপাত্র জালাল ইউনুস বলেছেন, দলের বেশির ভাগ সদস্য মসজিদে যাওয়ার জন্য বাসে চড়েছিলেন। মসজিদে প্রবেশের মুহূর্তে হামলার ঘটনাটি ঘটে। হামলার পর ক্রিকেট দলের সদস্যদের হোটেল থেকে বের না হতে বলা হয়েছে। ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল মাঠে শনিবার বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। পরে ম্যাচটি বাতিল করা হয়।

ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পরপর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। এতে দেখা গেছে, ভিডিও গেমের মতো একজন বন্দুকধারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করছেন। হামলার ভিডিও দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বন্দুকধারী হামলার আগে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। হয়তো তার মাথায় ভিডিও ক্যামেরা বসানো ছিল। একটি ওয়েবসাইট জানায়, হামলাকারী হামলাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করেছেন।

ভিডিওতে দেখা গেছে, হামলাকারী স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। মসজিদের প্রবেশকক্ষ থেকেই মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করেন। মসজিদের ভেতর ছোটোছুটিরত মুসল্লিদের প্রতি টানা গুলি করতে থাকেন। এরপর মসজিদের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরে ঘুরে গুলি করতে থাকেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা মসজিদের মেঝেতে পড়েছিলেন, তাদের দিকে ফিরে ফিরে গুলি করছিলেন তিনি।

ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর তা ভয়াবহ উল্লেখ করে অনলাইনে না ছড়াতে লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছে নিউজিল্যান্ড পুলিশ।

দুই মসজিদে হামলার ঘটনার ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া গেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী ফিলিস্তিনি জানান, তিনি একজনকে মাথায় গুলি করতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি পরপর দ্রুত তিনটি গুলির আওয়াজ পাই। ১০ সেকেন্ড পর আবার গুলি শুরু হয়। এটা অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হবে। তা না হলে কোনো মানুষের পক্ষে এত দ্রুত ট্রিগার টানা সম্ভব নয়। লোকজন দৌড়াতে শুরু করে। কারও কারও দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।’ তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালিয়ে তিনি প্রাণে রক্ষা পান।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নামাজ আদায়রত অবস্থায় তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। তিনি দৌড়ে মসজিদ থেকে পালিয়ে এসে দেখেন তার স্ত্রী ফুটপাতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন।

আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি শিশুদের গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন। তিনি বলেন, চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ।

অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গুলির শব্দ শোনার পর তিনি দেখেন চারজন মেঝেতে পড়ে আছেন। চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।

মোহান ইব্রাহিম নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম কোনো বৈদ্যুতিক ঝটকা। পরে সব লোক দৌড়ানো শুরু করে।’ তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধুরা ভেতরে রয়ে গেছে। আমি তাদের নাম ধরে চিৎকার করছিলাম। কিন্তু হট্টগোলে আমি তাদের কাছ থেকে কিছু শুনতে পাইনি। বন্ধুদের জীবন নিয়ে আমি ভীত।’

নিউজিল্যান্ডে এভাবে বন্দুক হামলার ঘটনা বিরল। ১৯৯০ সালে সাউথ আইল্যান্ডের আরামোয়ানা শহরে মানসিকভাবে অসুস্থ এক ব্যক্তি গুলি করে ১৩ জনকে হত্যার পর দেশটির অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন কড়া করা হয়। ১৯৯২ সালে আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের ব্যাপারে দেশটির আইনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপরও ১৬ বছরের বেশি বয়সী কেউ নিরাপত্তা কোর্স সম্পন্ন করার পর নির্ধারিত মানের অস্ত্র নিবন্ধনের সুযোগ পান।

এই হামলার আগে আরেকবারও বিশ্ব শিরোনামে উঠে এসেছিল নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণের শহর ক্রাইস্টচার্চের নাম। ছোট্ট এই শহরটিতে ২০১১ সালে আঘাত এনেছিল ভূমিকম্প। ওই সময় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শহরের ঐতিহ্যবাহী ক্যাথেড্রাল (গির্জা) ভূমিকম্পে ধসে পড়ে।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত