ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

এখনকার ‘সুপারহিট’ আমার সময়ের ‘ফ্লপ’ সিনেমা

  ইমরুল নূর

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২১, ১৫:৪২  
আপডেট :
 ১৭ মে ২০২১, ১৫:৫২

এখনকার ‘সুপারহিট’ আমার সময়ের ‘ফ্লপ’ সিনেমা
চিত্রনায়িকা তামান্না

তখন বয়স চৌদ্দ কি পনেরো, মাত্র কয়েক মাসের জন্য সুইডেন থেকে দেশে এসেছিলেন। ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাবার চারদিন আগে একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সি থেকে ফোন পান। নিজের এবং পরিবারের আগ্রহে সেই বিজ্ঞাপনটি করেন। এটি প্রচারে আসতেই প্রশংসায় ভাসতে থাকেন তিনি। মুহূর্তেই প্রস্তাব পেয়ে বসেন সিনেমার। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত, গড়েন রেকর্ড। তিনি আর কেউ নন, এক সময়ের নন্দিত ও মিষ্টি হাসির চিত্রনায়িকা তামান্না।

পুরো নাম তামান্না হাসিন হুদা হলেও দর্শকমহলে তিনি তামান্না নামেই জনপ্রিয়। বেড়াতে এসে মুহূর্তের মধ্যেই বনে গেলেন নায়িকা। নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে তার আগমন ঘটে নক্ষত্রের মতো। ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা সিনেমায় অভিনয় করেন। মাত্র ৫ বছরের ক্যারিয়ারেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সিনেমা ছেড়ে দিয়ে ফিরে যান সুইডেন। এখনো সেখানেই রয়েছেন।

ঈদের পর মুঠোফোনে নানা বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সিনেমা ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আফসোস ও এখনকার জীবন; সবকিছু নিয়েই খোলামেলা কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশ জার্নালের পাঠকদের জন্য সেসব আলাপচারিতার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো...

একদম শুরুর দিকের কথা জানাতে গিয়ে তামান্না বলেন, ‘সময়টা তখন খুব সম্ভবত ১৯৯৫ সাল হবে। আমি দেশে গিয়েছিলাম কয়েক মাসের জন্য। ছুটি শেষে যখন সুইডেন ফিরবো তার ঠিক চারদিন আগে একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সি থেকে আমার কাছে ফোন আসে। তারা আমার ছবি দেখে পছন্দ করেছে, যার কারণে একটি বিজ্ঞাপনে কাজের প্রস্তাব দেন। পরে আমি জানতে পারি আমাকে না জানিয়ে আমার এক বন্ধু বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে ছবি দিয়েছিলো। সেখান থেকেই প্রস্তাব পাই। বিজ্ঞাপনটি ছিলো ‘স্টারশিপ কনডেন্সড মিল্ক’র। এটি নির্মাণ করেছিলেন আফজাল হোসেন আঙ্কেল। কাজটি করার পর আমি সুইডেনে চলে আসি। বিজ্ঞাপনটি প্রচারে আসার পর ভালো সাড়া পেতে শুরু করে। সেটা তখন বুঝেছি যখন আমার কাছে একের পর এক সিনেমার প্রস্তাব আসা শুরু করলো। তারপর ১৯৯৭ সালে আমি আবার দেশে আসি। তখন আজিজুর রহমানের ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হই। কিন্তু কিছু কারণে সে ছবিটি ফিরিয়ে দিই। আমি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই সাইফুল আজম কাশেমের ‘ত্যাজ্যপুত্র’ সিনেমার। এরপর একই বছরের ডিসেম্বর মাসে শুরু করি ‘ভণ্ড’ সিনেমার শুটিং। শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত এ ছবিটি মুক্তি পায় ৯৮ সালের ১৫ মে। ছবিটি বাম্পার হিট হয়। ছবিটি মুক্তির পরদিনই এফডিসিতে বসে আমি চারটি সিনেমার প্রস্তাব পাই এবং সাইনিং করি। কিন্তু কিছুটা সময় পর আমি ছবিগুলো ছেড়ে দিই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার ক্যারিয়ারটা ছিলো অল্প সময়ের। তবে এই অল্প সময়েই আমি অনেক অনেক সাপোর্ট ও ভালোবাসা পেয়েছি সবার থেকে। যার কারণে আজও দর্শক আমাকে মনে রেখেছে। ‘ভণ্ড’ সিনেমাটি রিলিজ হওয়ার পর থেকে আমি অনেক অনেক প্রস্তাব পেতে থাকি। নানা কারণে সে ছবিগুলো আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি কাজ করেছি খুব বেছে বেছে। ৫ বছরে অভিনয় করেছি মাত্র ১৫ টি সিনেমাতে। আর ২০১৩ সালে এসে ১টি সিনেমা করেছিলাম; মোট ১৬টি সিনেমা। আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিক থেকেই আমি অন্য কারো গাইডলাইনে ছিলাম। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারতাম না। সবকিছুই অন্যের সিদ্ধান্তে করতে হতো। যদি সে সময়টাতে আমি নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারতাম কিংবা চলতে পারতাম তাহলে আজকে আমার ক্যারিয়ার অনেক দূর থাকতো।’

ওই সময়টাতে অশ্লীলতার একটা কালোছাপ চলছিলো। তারপরও আপনাকে কোনো সিনেমাতে অশালীন পোশাকে দেখা যায়নি। এত সবকিছুর মধ্যে আপনি নিজেকে কীভাবে আলাদা রেখেছেন? কীভাবে মেইনটেইন করেছিলেন?- এমন প্রশ্নে তামান্না বলেন, ‘‘এটা সত্যি, সময়টা তখন অশ্লীলতারই ছিলো। কিন্তু আমি সেসব বিষয়ে কখনো এক চুলও ছাড় দিইনি। কস্টিউমের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন ছিলাম আমি, সেটা এখনও। এমনও হয়েছে শুটিং করতে গিয়ে দেখি যে কস্টিউম পছন্দ হয়নি, তাহলে সে ছবি মাঝপথেই ছেড়ে দিয়েছি। এরকম বহু হয়েছে আমার সঙ্গে। যার কারণে আমার সিনেমার সংখ্যা কম। আমার সিনেমার সংখ্যা তখন ৫০-১০০ হতো, যদি না ছাড়তাম। আমার এখনও মনে আছে, প্রয়াত নায়ক রাজ রাজ্জাক আঙ্কেল একটা ইন্টার্ভিউতে আমাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বাচ্চা মেয়েটা এই বয়সেই এত সচেতন, এত ট্যালেন্টেড; ও অনেকদূর যাবে। এই কথাটা আমার সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এরপর অনেকগুলো কাজই করি। একের পর এক হিট সিনেমা যখন যাচ্ছিলো তখন সব পরিচালক আমার বাসার সামনে লাইন ধরেছিলো। তখন অনেক নিউজও হয়েছিলো এরকম যে, সব পরিচালকদের রাস্তা এখন তামান্নার বাসার দিকে। ২০০৩ সালে ‘মুখোশধারী’ সিনেমার কাজটি শেষ করি, এরপরই সুইডেন চলে আসি।’’

আপনি যেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে গিয়েছেন এখনকার সেই ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে ধারণা কেমন আপনার বা খোঁজ রাখেন কি? তামান্না বলেন, ‘আমি বাইরে থাকলেও আমার মন কিন্তু দেশে পড়ে থাকে। আমি চেষ্টা করি খোঁজখবর রাখার। এখন তো ভালো কাজই হচ্ছে। চারিদিকে এখন শুধু শাকিব খান। এখনও কাজ করে যাচ্ছে, খুবই ভালো। আর এখন নায়িকা কারা কাজ করছে সে সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই আমার। মাঝখানে অপু বিশ্বাস কাজ করেছিলো শাকিবের সঙ্গে। এরপর আর তেমন কাউকে দেখিনি। আর বুবলীর কিছু গান দেখেছি। ভালো নাচ করে মেয়েটি, দেখতেও অনেক কিউট।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময়টাতে তো কাজ করাটা অনেক বেশি কঠিন ছিলো, প্রতিযোগিতাও বেশি ছিলো। কাজ দিয়ে সবাই প্রতিযোগিতা করতো। আমাদের সময়ের কাজ, গল্প সবকিছুই কিন্তু দর্শক লুফে নিতো। এখন তো শুনি, কোনো সিনেমার লগ্নির টাকা উঠতেই হিমশিম খেয়ে যায়। আর কোনোরকমে যদি লগ্নির টাকাটা উঠে যায় তাহলেই সেটাকে সুপারহিট বানিয়ে দেয়। অথচ সুপারহিট, বাম্পার হিট বা হিট; এগুলোর সংজ্ঞা কিন্তু ভিন্ন।’

‘আমি যে সময়টাতে কাজ করেছি ওই সময়টাতে প্রতিযোগিতাও অনেক বেশি ছিলো। লগ্নির টাকার দ্বিগুণ, তিনগুণ বা তার চেয়েও বেশি টাকা উঠলে তখন সেটাকে ‘সুপারহিট’ বলা হতো। যদি লগ্নির চেয়ে কিছুটাও বেশি উঠতো তখন হয়তো আমরা ‘হিট’ বলতাম। কোনোরকমে যদি লগ্নির টাকাটা উঠতো তাহলে সেটাকে ‘ফ্লপ’ বলা হতো। আমার ‘ভণ্ড’ সিনেমার বাজেট ছিলো ১ কোটি টাকা। ছবিটি সেসময় ৫ কোটি টাকা ব্যবসা করেছিলো। আমার এক দিয়ে লাক ফেভার করেছিলো যে, আমার কোনো ছবি-ই ফ্লপ যায়নি। সুপারহিট, বাম্পার হিট, হিট হয়েছে কিন্তু আমার কোনো ফ্লপ নেই। এখন যে ছবি হচ্ছে সেসবের লগ্নির টাকা কোনোরকমে উঠলেই সেটাকে দেখছি সুপারহিট তকমা দেওয়া হচ্ছে, সেদিক থেকে এখনকার সুপারহিট সিনেমাগুলো আমার সময়ের ফ্লপ সিনেমার সমান।

তখন মানুষের সিনেমার প্রতি আগ্রহ ছিলো অন্যরকম। আর আমাদের সিনেমার গল্পগুলোও ভালো ছিলো। ব্যবসাও হতো দারুণ। কিন্তু এখন তো সিনেমা চলছে কোনোরকমে।’

২০০৩ সালের পর ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশে এসেছিলেন। দেশে এসে একটি সিনেমাও করেছিলেন। এরপর আর দেখা যায়নি কেন? আবার কবে দেখা যাবে? তামান্নার উত্তর, ‘‘হ্যাঁ। দেড় মাসের ছুটিতে গিয়েছিলাম। এরপর ‘পাগল তো জন্য রে’ সিনেমার প্রস্তাব আসে। আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে কাজটি করেছিলাম। এরপর আর যাওয়া হয়নি।’’

‘আমার তো দেশে আসতে খুব ইচ্ছে করে। জীবনে এই একটি জিনিসই (অভিনয়) তো শিখেছিলাম, ওটাই তো পারি; আর কিছু তো পারি না। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে আর যাওয়া হয়নি। আমার সিনেমার একটি গানের রিমেকে কাজ করার কথা হয়েছিলো। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বছরই আসবো দেশে।’

অভিনেত্রীর বাইরেও তামান্না একজন ডেন্টিস্ট। পাশাপাশি সুইডেনের নৃত্যশিল্পী এসোসিয়েশনের ড্যান্স লিডার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। সুইডেনের স্টকহোল্মে ভাই-বোনদের সঙ্গেই থাকছেন এখন। জীবনটাকে বেশ উপভোগ করছেন। তবে কিছুটা আফসোস কিংবা আক্ষেপ রয়েই গেছে তার।

আক্ষেপ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন অনেক ভালো আছি। তবে হয়তো আরো অনেক ভালো থাকতে পারতাম। অভিনয়টাই কিন্তু আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিলো। মেধা বলি বা ক্যাপাবিলিটি, সবই কিন্তু ছিলো আমার। শুধু আফসোস হয়, যদি নিজের ক্যারিয়ারটাকে নিজের মতো করে সাজাতে পারতাম তাহলে হয়তো অনেক কিছুই বদলে যেতো। তখন অনেকটা কলের পুতুলের মতো ছিলাম। অন্যের সিদ্ধান্তে চলতে হতো। যখন বুঝতে পারলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেলো। কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক; এটা বুঝতে বুঝতেই অনেক সময় চলে যায়। আমার ব্যাড লাক।’

তামান্না অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘ভণ্ড’, ‘হৃদয়ে লেখা নাম’, ‘তুমি আমার ভালোবাসা’, ‘শত্রু তুমি বন্ধু তুমি’, ‘কঠিন শাস্তি’, ‘সন্ত্রাসী বন্ধু’, ‘আমার প্রতিজ্ঞা’, ‘মুখোশধারী’, ‘পাগল তোর জন্য রে’ ইত্যাদি।

বাংলাদেশ জার্নাল/আইএন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত