ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

যাদেরকে বলতো ‘নাটক করে’, তারাই এখন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রেখেছে

  ইমরুল নূর

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:৫৯  
আপডেট :
 ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৮:২৭

যাদেরকে বলতো ‘নাটক করে’, তারাই এখন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রেখেছে
চলচ্চিত্র নির্মাতা শিহাব শাহীন

রোমান্টিক নির্মাতা হিসেবে সেরার খ্যাতি পেলেও তিনি সব জনরার গল্প বলাতেই বিশ্বাসী। দীর্ঘ দুই দশকের ক্যারিয়ারে নানা স্বাদের গল্প দর্শকদের উপহার দিলেও নিজস্ব ভঙ্গিতে রোমান্টিক গল্প বলায় পারদর্শী এই নির্মাতা পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। তাই প্রতিবারই দর্শকেরা অপেক্ষায় থাকেন তার নতুন নির্মাণের। বলছিলাম ছোট ও বড় দুই পর্দাতেই সফল নির্মাতা শিহাব শাহীনের কথা। সিনেমা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন ইমরুল নূর

ছোট পর্দা, বড় পর্দা এবং ওটিটি; সব মাধ্যমেই সফল আপনি। সদ্য মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিনেমা ‘মায়া শালিক’ নিয়ে দর্শকদের মুগ্ধতার কথা দেখা যাচ্ছে বেশ। দর্শকদের এই সাড়াকে কীভাবে দেখছেন?

এক কথায় যদি বলি, আশাতীত এবং অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। আমি গত ২০ বছর ধরে রোমান্টিক গল্পই বলে আসছি। আমি জানি, দর্শকরা কি ধরণের গল্প দেখতে পছন্দ করে। রোমান্টিক গল্পের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ সবসময়ই বেশি। তবে রোমান্টিকের সঙ্গে সাই-ফাইয়ের মিশেলে নির্মিত ‘মায়া শালিক’ নিয়ে প্রথমদিকে একটু সংশয় ছিল। কারণ, বাংলাদেশের দর্শকদের এরকম গল্প দেখার অভ্যাস নেই। কিন্তু সিনেমাটি মুক্তির পর সে সংশয় কেটে গিয়েছে আমার, সেইসাথে আনন্দের অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। সবাই অনেক পছন্দ করছেন, নিজেদের ভালো লাগা জানাচ্ছেন, এটা খুবই ভালো লাগছে।

যেখানে আমাদের দেশে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে প্রযোজকরা আগ্রহ দেখায় না, সেখানে কোন ভাবনা থেকে এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার ঝুঁকি নিয়েছেন?

এটা সত্যি, এমন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চাইলে প্রযোজকরা খুব বেশি একটা আগ্রহ দেখান না। প্রথমদিকে কয়েকটি প্লাটফর্মেই কথা বলি কিন্তু অনেকেই এটা করতে রাজি হননি। পরে গল্প এবং পরিকল্পনা শুনে সবশেষে বিঞ্জ এটি করতে রাজি হয়। গল্পটা লিখা হয়েছিলো তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে। আমাকে যখন গল্পকার ডা: জাহান সুলতানা গল্পটি শোনায় তখন থেকেই এটা নিয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করি। সেসময় আমি অপূর্বকে গল্পটি শেয়ার করি, সে খুব পছন্দ করে। ওই সময়েই সে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখে রাখে এবং বলে যে, সেখানে আমরা কাজটি করতে চাই। অপূর্ব, জাহান সুলতানা এবং আমার তিনজনেরই বিশ্বাস ছিলো গল্পটি নিয়ে। সায়েন্স ফিকশনের বিষয়টি দর্শক বুঝতে না পারলেও প্রেম, বাটারফ্লাই ইফেক্ট, মিস্ট্রি; এগুলো দর্শক ঠিকই বুঝতে পারবে। সেটাকে উপজীব্য করেই এই দুইজনের প্রেমের বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছি।

অনেকের কাছেই হয়তো গল্প বুঝতে সমস্যা হয়েছে কিন্তু দেখতে ভালো লেগেছে, চোখে-কানে আরাম লেগেছে, মনে প্রশান্তি এসেছে। সিনেমাটি থেকে তারা এই বিষয়গুলোই পেয়েছে, যেগুলো তাদের ভালো লেগেছে। এটা ওয়ার্ক করেছে। বিঞ্জকে এরজন্য ধন্যবাদ জানাই। এখন যেহেতু দর্শকরা কাজটির প্রশংসা করছে সামনে হয়তো প্রযোজকরা এমন ধরণের কাজ করতে আগ্রহী হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

শোনা যাচ্ছে, ‘মায়া শালিক’ এর গল্প নাকি কোন একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?

এই বিষয়টি নিয়ে আমার অনেক কিছুই বলার রয়েছে। কনসেপ্টের মিল বাংলাদেশের অনেক গল্পেই আছে। এই সিনেমার যে গল্পকার জাহান সুলতানা, তিনি আমাকে শেয়ার করেছেন যে, তিনি এই গল্পটা জাপানিজ সিনেমা ‘ইউর নেম’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন। কিন্তু সেখানে এই গল্পের সাথে কনসেপ্টের মিল নেই। তার কাছে মনে হয়েছে যে, এরকম একটা গল্প হতে পারে যেখানে অতীতের কারও সঙ্গে কথা হওয়া, দেখা হওয়া; এরকম বিষয় থাকে। এরকম কনসেপ্টে অনেক গল্পই কিন্তু আছে, কোরিয়ান একটা সিনেমাও আছে যেখানে ছেলে-মেয়ের কথা হতো পত্রের মাধ্যমে। কনসেপ্টের মিল অনেকাংশেই থাকে তাই বলে এটাকে কপি বলা যায় না। আমাদের গল্পে ছেলে ও মেয়ে ফোনে কথা বলে, ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে; তাদের মধ্যে প্রেম হয়। এটা তো বিশ্বের কোন গল্পের সাথেই মিলবে না। যে ধরণের প্রেম, প্রেমের গল্প মায়াশালিকে দেখানো হয়েছে, এটা শতভাগ নতুন।

এরকম তো অনেক কনটেন্টই নির্মিত হয়েছে যেগুলো কোন না কোন বিদেশি গল্প থেকে অনুপ্রাণিত। এই কনসেপ্ট বাংলাদেশের জন্য নতুন কিন্তু বাইরের দেশের জন্য না। কারণে বাইরে এগুলো নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে।

গল্পের সারা চরিত্রের রূপদানকারিনী সাদিয়া আয়মান প্রসঙ্গে জানতে চাই...

সাদিয়া সম্পর্কে জানতে পারি আমার লেখিকার কাছ থেকেই। তার কথা ভেবেই তিনি চরিত্রটা সাজিয়েছেন। গল্পের সারা আর বাস্তবের সাদিয়া দুজনই প্রায় এক। চঞ্চল, মিষ্টি, উচ্ছল। গল্পের চরিত্রের জন্য সে একদমই পারফেক্ট ছিলো। সে খুবই পরিশ্রমী। আমরা রিহার্সেল করেছি, সেখানে সে প্রচুর সময় দিয়েছে। চরিত্রটাকে সে একদম নিজের মত করে উপস্থাপন করেছে, খুবই চমৎকারভাবে। প্রথমদিকে আমরা একটু চিন্তিত ছিলাম কিন্তু রিহার্সেলে সময় দিয়ে দিয়ে সে নিজেকে প্রস্তত করেছে এবং ভালো পারফর্ম করেছে। এভাবে যদি সে সময় নিয়ে কাজ করে তাহলে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়ী বলে আমি মনে করি।

অপূর্বর সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের পথচলা, তিনি আপনাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন, গুরু মানেন। গল্পের অভি চরিত্রটি করতে গিয়ে তার মধ্যে নতুন কি উপলব্ধি করলেন?

অপূর্বর সঙ্গে আমার প্রায় ১৭/১৮ বছরের পথচলা। একই সাথে চলতে গিয়ে দুজন দুজনকে ভালো বুঝি। আমরা ভাই-বন্ধু। সে আমাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, গুরু মানে; এটা তার বিনয়। ওর মন অনেক বড়। আমার কাছ থেকে অনেকেই অনেক কিছু শিখেছে কিন্তু তার এই বিষয়টা স্বীকার করে না কিন্তু অপূর্ব সেটা করে। এটাই ওকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে। কারণ তার মধ্যে সেই যোগ্যতা আছে, বিনয়টা আছে। আমাদের অনেকদিনের জার্নি একসাথে, একইসাথে বেড়ে ওঠা এই ইন্ডাস্ট্রিতে। দুজন দুজনকে অনেক কিছুই শেয়ার করি। আমি যা জানি সেটা ওর সঙ্গে শেয়ার করি এবং সেও তাই। এভাবেই আমাদের বন্ডিংটা গড়ে উঠেছে। সত্যি বলতে অপূর্ব এমন একটা মানুষ, যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।

আর মায়াশালিক নিয়ে যদি বলি, এই কাজটা করার আগে আমি অপূর্বকে একটা কথাই বলেছি যে, ওটিটি প্লাটফর্মে তাকে জায়গা করে নিতে হবে। ওর মধ্যে একটা এক্স ফ্যাক্টর আছে, সেটা তো থাকবেই; সেটা অটুট রেখে নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে হবে। ওর যে চার্ম রয়েছে তার ব্যক্তিত্বে, অভিনয় সত্ত্বায়; সেটা বজায় রেখে নতুন কিছু যোগ করার জন্য আমরা তাকে ফ্ল দিয়েছি। চরিত্রটাতে আমরা তাকে কিছু ত্রুটি দিয়েছি, যেটা টেলিভিশন নাটকে খুব একটা হয় না। তার অসুস্থতা, শারীরিক সমস্যা ক্যারি করে তার চার্মটা কাজে লাগিয়ে সে নিজেকে যেভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছে সেটা দর্শকের কাছে এক নতুন অপূর্বকে তুলে ধরেছে। যেটা তার হেটারদের কাছেও ভালো লেগেছে। হেটাররাও তার প্রশংসা করছে।

অনেকেই বলে থাকেন, অনেকের সঙ্গে কাজ করলেও আপনিই তাকে যথাযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। আপনার কাজগুলোর মধ্যে তাকে একটু অন্যরকমভাবেই পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কি বলবেন?

আমাদের মধ্যে ওয়ার্কিং রিলেশনটা ভালো হওয়ার কারণে আমরা দুজন দুজনকে বেশ ভালো বুঝি। একটা কমফোর্ট জোন আছে আমাদের মধ্যে। আমি যেটা বলি সেটা সে বুঝে আবার যেটা চাই না, সেটাও সে বুঝে ফেলে। এই বোঝাপড়ার কারণে কাজটা অনেক সহজ হয়। আমি ওর এক্স-ফ্যাক্টরটা জানি, সীমাবদ্ধতা জানি। আমি অপূর্বকে সেখানেই কাস্ট করি যেখানে সে অপরিহার্য। প্রত্যেকেরই সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাটাই যেন সেরা হয়, সীমাবদ্ধ মনে না হয়; আমি সেই চেষ্টাটাই করি ওর কাছ থেকে বের করে আনতে। তাই হয়তো কাজগুলো ভালো হয়।

টেলিভিশনের সবাই এখন ওটিটিতে ঝুঁকছে। এতে করে টেলিভিশনের পর্দায় শূন্যতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন কি না?

আমাদের এখানে যে আমরা এক ঘণ্টার ফিকশন তৈরি হয়, সেটা সারা বিশ্বের কোথাও নেই। এটা একটা বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিটা এগুচ্ছিলো। আমরা যারা টেলিভিশন ফিকশন নির্মাণ করি তারা একটা সময় সিনেমা নির্মাণের জন্য সাপোর্ট পেতাম না, পুঁজি পেতাম না। এফডিসি ঘরানার নির্মাতারা আমাদের ঢুকতে দিতো না। তাই আমরা যারা ফিল্ম মেকার তারা তাদের ক্ষুধাটা কিঞ্চিত মেটানোর জন্য টেলিভিশনে কাজ করতাম। তখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই শর্ট ফিকশন তৈরির দায়িত্বটা নেয়। এখন সেই দায়িত্বটা পালন করছে ওটিটি।

টেলিভিশনের আসলেই যেই কাজ, তাদের সেটাই করা উচিত। তাদের বিগ শো করা উচিত, ধারাবাহিক করা উচিত। বড় বড় রিয়েলিটি শো করা উচিত। টেলিভিশনের পর্দায় ফিল্ম মেকারদের যে চাহিদা সেটা এখন ওটিটি পূরণ করছে। যেহেতু ইউটিউবে আমাদের দর্শক রয়েছে, তাই ঈদ বা উৎসবগুলোতে হয়তো টেলিভিশনে ফিকশন চলতে পারে।

বলছিলেন, ‘এফডিসি ঘরানার নির্মাতারা আপনাদের ঢুকতে দিতো না।’ টেলিভিশন নির্মাতা ও এফডিসি নির্মাতাদের মধ্যকার যে একটা দ্বন্দ্ব , এটা আসলে কেন?

বিষয়টা এমন না যে, তাদেরকে দেখানোর জন্য কোন কিছু করা। এই যে কিছু হলেই তারা বলে, এরা টেলিভিশন নির্মাতা, এরা নাটক করে। সিনেমা বানালেও বলে, এরা নাটক করে, এটাও নাটক হয়েছে। কিছু হলেই টেলিভিশন নির্মাতাদের নিয়ে টিটকারি করে। এগুলো করতে করতেই তো তারা ফিল্মকে ‘ফিলিম’ বানিয়ে ছেড়েছে, ইন্ডাস্ট্রিটা শেষ করেছে। এই ‘ফিলিম’ আর এখন চলে না, দর্শক আর দেখে না। মাঝখান থেকে অনেক পরিচালক কাজ করতে পারছে না। এফডিসি ঘরানার নির্মাতাদের কাজ নেই এখন। যাদেরকে বলতো ‘নাটক করে’, সেইসব নির্মাতারাই এখন বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রেখেছে। আমরা যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটাই করছি। তারা কখনোই বুঝে নি, পিছিয়ে ছিলো। তারা তাদের জায়গা হারানোর ভয়ে ছিলো, অস্তিত্ব সংকটে ভুগতো। তারা কখনোই এগুতে চায় নি, ভয় পেতো যদি জায়গা হারিয়ে ফেলে। নতুনদেরকে জায়গা দিতে চায়নি, ঢুকতে দেয়নি। নতুন গল্প বলতে দেয় নি। এতে করে মানুষ, দর্শক সবাই এগিয়ে গেছে কিন্তু তারা পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে টেলিভিশনের নির্মাতারাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/আইএন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত