ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

মুখ থুবড়ে পড়ছে মোদির ‘বিশ্বাসের’ ফানুসটি

মুখ থুবড়ে পড়ছে মোদির ‘বিশ্বাসের’ ফানুসটি
দিল্লি দাঙ্গা

কি আশ্চর্য, আজাদ ভারতে আবার নতুন করে 'আজাদি'র আওয়াজ উঠছে কেন! স্বাধীন এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকরা তবে এখন কিসের থেকে আজাদি চাইছেন? কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে - ভুখমারি সে আজাদি, পুঁজিবাদ সে আজাদি, মনুবাদ সে আজাদি, ভেদভাব সে আজাদি, খানে পিনে কি আজাদি, যোগী-মোদি সে... আজাদি, অমিত শাহ সে... আজাদি ইত্যাদি।

কিন্তু এই তো সবে ২০১৯ এ লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর আসনে নরেন্দ্র মোদীকেই দ্বিতীয় বারের জন্য জিতিয়ে আনলেন দেশবাসী। তিনি ও তার আগের দেওয়া স্লোগান', 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ'এর সঙ্গে এবার 'সব কা বিশ্বাস'ও জুড়ে দিলেন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর ওই 'বিশ্বাস' অর্জনের ফানুসটি যেন মুখ থুবড়ে পড়ছে!

আসলে ভোট রাজনীতির অঙ্কে ভারতে প্রায় ১৪ শতাংশ মুসলমানের বিশ্বাস অর্জন করাটাও যে জরুরি। সেটা বুঝেই হয়তো ওই 'সব কা বিশ্বাস' অর্জনের বার্তা।

কিন্তু সম্প্রতি ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি (এনপিআর) চালু করার ঘোষণা হতে না হতেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। কারণ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিপন্ন বোধ করছেন।

যে মানুষ দেশের নাগরিক হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে ভোট দিয়ে এসেছেন, হঠাৎই যেন সন্তান-সন্ততি পরিবার নিয়ে আবার দেশহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত তারা।

একসময় প্রতিবেশী দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ অত্যাচারের শিকার হয়ে ভিটে মাটি ছেড়ে মান, প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। এবং শুধু জীবিকার সন্ধানে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেও অগণিত, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়ে থেকে গেছেন, ভোটাধিকারও প্রয়োগ করেছেন।

তাদের সকলের সামনেই এখন ঝুলছে ওই 'সিএএ', 'এনআরসি'র এক অদৃশ্য খাঁড়া। যে খাঁড়ার কোপে তাদের কেউ ‘শরণার্থী’ হবেন কেউ বা হবেন ‘অনুপ্রবেশকারী’। মনে হচ্ছে, নতুন পাস হওয়া ওই বিলটি বোধহয় এই প্রথম ভারতের বৈশিষ্ট্য - সমানাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

তাই সরকারের তরফে - এই সিএএ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়, নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যই - যতই বলা হোক না কেন, সেই কথায় আর আস্থা বা বিশ্বাস রাখতে পারছেন না অসংখ্য ভারতীয়।

তার ওপর মন্ত্রিসভার প্রধান দুই মন্ত্রীরই এই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী মন্তব্য, দেশে কোন 'ডিটেনশান ক্যাম্প নেই' - এর মতো অসত্যভাষণ, সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই মনে হয় ভারতে একের পর এক রাজ্যে বর্তমান সরকারের প্রতি অবিশ্বাসের বারুদ বোমাটি ক্রমশ যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে।

এমনটা যে ঘটতে পারে, তা বোধহয় দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কল্পনারও বাইরে ছিল।

এমনিতে তো ভারতে, 'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ,' যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধরাই থেকে গেছে, গত পাঁচ বছরের সরকারি রিপোর্ট কার্ড'ই ( যা অর্ধসত্য, জলমেশানো সত্য, গোপন করা এবং মিথ্যা নির্ভর তথ্য দ্বারা নির্মিত) তা বলে দেয়। কারণ কোটি কোটি চাকরি হওয়ার বদলে দেশে হাজার হাজার লোকেরই চাকরি চলে গেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, কৃষকের আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি হাজারও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে তাদের ব্যর্থতা আজ কারও অজানা নাই।

তার ওপর হঠাৎই আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ওই নাগরিকত্ব প্রমাণ দাখিলের প্রশ্ন। যেখানে অগণিত দেশবাসীকে (?) এখন - ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’এই জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড়াতে হবে। একসময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া মানুষ 'শরণার্থী, না 'অনুপ্রবেশকারী, কোন পরিচয়ের স্ট্যাম্প তাদের কপালে আটকানো হবে?

তার ওপরই তো নির্ভর করবে নাগরিকত্ব, নয়তো দেশহীন, রাষ্ট্রহীন হয়ে ডিটেনশান ক্যাম্প' এ তাদের আমৃত্যু বন্দি জীবন।

নাগরিকত্বের প্রশ্নে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতিবাদেই যেন আজ গর্জে উঠছে দেশের ওই বিরুদ্ধ স্বর। এবং মনে হয় তার সঙ্গে দেশের ‘ভেঙে পড়া অর্থনীতি’ও পদে পদে সামাজিক অনিরাপত্তার বিরুদ্ধেও জমে থাকা ক্ষোভ প্রতিবাদী স্বর হয়ে মিলে যাচ্ছে।

সেই সঙ্গে শাসক দলের ছোট বড় নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্যোগে নাগরিক সমাজে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা আর অবিশ্বাসের বীজকে সোল্লাসে ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানোর বিরুদ্ধেও যেন সোচ্চার হচ্ছে প্রতিবাদ। এবং জাতি-ধর্ম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কৃষক-শ্রমিক, ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠ রাস্তা-ঘাটে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, মসজিদে, পার্কে ছড়িয়ে পড়েছে।

কিন্তু ক্রমশ সমাজের সমস্ত শ্রেণীর নাগরিকই যে সেই প্রতিবাদে এমন শামিল হয়ে রাস্তায় নেমে আসবে কে জানত?

প্রবল ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে পুলিশ ও শাসকদলের গুন্ডা বাহিনীর লাঠি, গুলি, কাঁদানে গ্যাসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এতদিন ধরে এমন অরাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে কে জানত? কে জানত দিল্লির শাহিন বাগের মতো দেশের নানা প্রান্তে গজিয়ে ওঠা একাধিক শাহিন বাগে প্রায় সদ্যজাত শিশু কোলে মা থেকে অশীতিপর বৃদ্ধাসহ হাজার হাজার নারী খোলা আকাশের নীচে দিন-রাত আন্দোলনের আগুন জ্বেলে বসে থাকবেন?

অবশ্য অনেকের মনে হতে পারে পার্লামেন্টে পাস হওয়া আইনের এমন বিরোধিতা করা যায় না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে সংশোধনী এনে যেমন বিল পাস করে নতুন আইন সরকার আনতে পারে। ঠিক তেমনি সেই আইনকে ‘বিভাজনকারী’মনে করে তার বিরুদ্ধে পথে নামার গণতান্ত্রিক অধিকারও দেশের মানুষের আছে ।

তাই কোথাও ১৪৪ ধারা জারি করে, কোথাও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেও, এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তার করে, লাঠি গুলি চালিয়ে, এমনকি আন্দোলনকারীদের হত্যা করেও সেই প্রতিবাদের আগুন কিছুতেই দেশের কর্ণধাররা ছিনিয়ে নিতে পারছেন না, নিভিয়ে দিতে পারছেন না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত