ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩২ মিনিট আগে
শিরোনাম

দিল্লি যখন পুড়ছিল পুলিশ তখন ক্রিকেট খেলছিল

দিল্লি যখন পুড়ছিল পুলিশ তখন ক্রিকেট খেলছিল

‘রোম যখন পুড়ছিলো নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো।’ এই কথাটি অনায়াসে এখন দিল্লি পুলিশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে বলা যায়,‘দিল্লি যখন পুড়ছিলো পুলিশ তখন ক্রিকেট খেলছিলো’। দিল্লি সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক মানুষ। বলা বহুল্য হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাসময়ে তৎপর হলে এতবড় সহিংসতা আটকাতে পারত পুলিশ। কিন্তু তারা কোনরকম চেষ্টাই করেনি। বরং অনেক স্থানে পুলিশ সদস্যদের দাঙ্গাকারীদের সাহায্য করতেও দেখা গেছে। ইতিমধ্যে এরকম কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। পাশাপাশি ওঠে আসছে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা ও উদাসীনতার ভয়াবহ সব চিত্র।

স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজারের এক পত্রিবেদনে বলা হয়েছে, রোববার দিল্লিতে যখন সহিংসতার আগুন ছড়াতে শুরু করেছে তখন দিল্লি পুলিশ প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিচ্ছিল। এসময় তারা আসহায় লোকজনের কোনও আর্তিতে কান দেয়নি। তারা কোনও জরুরি ফোনকল রিসিভ পর্যন্ত করেনি।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দিল্লি পুলিশের বাৎসরিক প্রদর্শনী ম্যাচ চলছিল দিল্লির কনট প্লেসের কাছে বড়াখাম্বা রোডের একটি বেসরকারি স্কুল মাঠে। এই মাঠ থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে দাঙ্গায় ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জাফরাবাদের অবস্থান। সহিংসতার আশঙ্কায় ওই এলাকাটি থেকে একের পর এক ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। সেই মোবাইল বার্তাগুলোর বেশিরভাগই ছিল ‘ভিড় জড়ো হচ্ছে’, ‘জনতা উত্তেজিত’, ‘বড় ঝামেলা হতে পারে’,‘ফোর্স চাই’ ইত্যাদি! কিন্তু সেই জরুরি বার্তাকে আমলই দেননি মাঠে উপস্থিত বা খেলায় ব্যস্ত দিল্লি পুলিশের কর্মকর্তারা। তাই এখন বলা হচ্ছে, দিল্লি পুলিশ যদি সেদিন নিজেদের বিনোদন বাদ দিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যেত তাহলে হয়তো সহিংসতা এতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিত না।

তবে কেবল ক্রিকেট ম্যাচ নয়, দিল্লি পুলিশের আরও অনেক ঘাটতি রয়েছে। যেমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ অফিসারের অভাব, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা, সব স্তরের পুলিশকর্মীদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। তাই বহু আগে থেকেই (জামিয়া থেকে জেএনইউ ) দিল্লি পুলিশের এসব অদক্ষতা চোখে পড়লেও আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ, আরও ভালো করে বললে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কেননা দিল্লি পুলিশের দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে।

এ প্রসঙ্গে এক সময়ে দিল্লি পুলিশে কর্মরত এবং বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,‘অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে প্রত্যেক বাড়ির ছাদে সর্বাগ্রে পুলিশ মোতায়েন করা হত। আটকে দেওয়া হতো উপর থেকে আক্রমণের রাস্তা। এরপর প্রতিটি ঘিঞ্জি গলির দু’প্রান্ত আটকে দিয়ে সকলককে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হত।’

তিন দশকের কর্মজীবনে দিল্লির পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ক বেশির ভাগ সময়েই ক্রাইম ব্রাঞ্চ, ভিজিল্যান্স ও প্রশাসনিক বিভাগে কাটিয়েছেন। তার দাঙ্গা সামাল দেয়ার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে ব্যর্থ তিনি ও তার বাহিনী।

এ নিয়ে বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে কঠিন সব অভিযোগ আনছে। কারো কারো অভিযোগ ইচ্ছাকৃতভাবেই লাগানো হয়েছে দিল্লির এই দাঙ্গা। কেননা এর আগে ২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গার সময়ও ওই রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন মোদি-অমিত জুটি। বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন সদ্য বিজেপি ও কংগ্রেসকে হারিয়ে দিল্লি মসনদে আসীন আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বিশেষ করে দিল্লির মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে তার প্রশাসনের অদক্ষতা ও অযোগ্যতা নিয়ে। বলা হয়ে থাকে, কেজরিওয়ালের ফের ক্ষমতায় আসার পিছনে বড় নিয়ামক ছিল দিল্লির মুসলিম ভোট।

পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আরও প্রশ্ন, যথাসময়ে কারফিউ বা জরুরি অবস্থা জারি করতে কেন ব্যর্থ হলো পুলিশ। যে কার্ফু মঙ্গলবার জারি করা হলো, তা কেন রোববারেই হলো না। সোমবার কেন ‘দেখা মাত্র গুলি’র আদেশ দেওয়া হল না?

ওঠে এসেছে গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতার চিত্রও। পরিস্থিতি যে এতটা খারাপ হতে পারে, তা আগে আঁচ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দারা। উত্তর-পূর্ব দিল্লির ওই মিশ্র এলাকাগুলিতে দু’পক্ষই যে পেট্রল বোমা, ইট, বন্দুক জমা করছে, বাইরের রাজ্য থেকে লোক ঢুকছে, বাড়ি-বাড়ি চিহ্নিতকরণ হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে লোকজন জড়ো হতে বলা হচ্ছিল গত বেশ কয়েকদিন ধরেই। অথচ এগুলোর কোনও তথ্যই নাকি ছিল না গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে। এ তথ্য কি বিশ্বাস করার মতো!

আসলে দিল্লির এই সহিংসতা নিয়ে অনেক প্রশ্নই উঠে আসছে। এ নিয়ে গবেষণা করারও রয়েছে অনেক দিক। কেবল পুলিশ বা গোয়েন্দা বাহিনী নয়, আজ প্রশ্নের মুখে ভারত, মোদির ভারত। আরও ভালো করে বলতে গেলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মোদি সরকারের নীতি ও নৈতিকতা। এজন্যই হয়তো বিবিসি দিল্লির দাঙ্গার সঙ্গে গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গার মিল খঁজে পেয়েছে। হিন্দুবাদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা এবং সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে এভাবে লেলিয়ে দেয়ার মোদি-অমিতের নীতিটি নিঃসন্দেহে বিজেপির ভোটব্যাংককে শক্তিশালী করছে। কিন্তু তাদের এই ভয়াবহ নীতিটি ভারতকে যে ভিতরে ভিতরে কতটা অসহায় আর নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে, সেটা কি টের পাচ্ছেন সেখানকার বিবেকমান মানুষেরা?

সূত্র: আনন্দবাজার

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত