ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

মার্কিন পুলিশের দোষী হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন

মার্কিন পুলিশের দোষী হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাজ্ঞ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনায় গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। প্রতিবাদ ও দাঙ্গার মুখে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত চার পুলিশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশটিতে এটি একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। কেননা হত্যার ঘটনায় সেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয় না বললেই চলে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর পুলিশের হাতে মারা যায় ১,২০০ মানুষ। এর ৯৯ শতাংশ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয় না।

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় ডেভিড শওভিন নামে একজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হত্যার অভিযোগ, যা পরিকল্পিত ছিল না।

এই পুলিশ অফিসার গত ২৫ মে মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েডকে মাটিতে ফেলে নিজের হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছিল প্রায় নয় মিনিট ধরে।

আরও তিনজন পুলিশকে অভিযুক্ত করা হয়েছে শওভিনকে সহযোগিতা করা ও অপরাধে মদত জোগানোর দায়ে। দোষ প্রমাণিত হলে চারজনেরই সর্বোচ্চ চল্লিশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

বিক্ষোভকারীরা আশা করছে ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ অফিসার কাউকে হত্যা করলে আইন তার ক্ষেত্রে কীভাবে প্রযোজ্য হবে তাতে একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। কারণ তাদের ধারণা, ফ্লয়েডের ঘটনা খুবই ব্যতিক্রমী।

কিন্তু মার্কিন আইনে, পুলিশ অফিসারদের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ আইনি সুরক্ষা রয়েছে। দেশটিতে পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা 'খুবই বিরল'।

পুলিশের সহিংস আচরণের খতিয়ান পর্যবেক্ষণকারী একটি প্রকল্পের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমেরিকায় পুলিশের হাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৬৬৬টি।এর মধ্যে মাত্র ৯৯টি ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এটি মোট হত্যার ঘটনার মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে মাত্র ২৫টি ঘটনায় পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।

ওয়াশিংটনে কেটো ইন্সটিটিউটের ফৌজদারি বিচার বিষয়ক বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লার্ক নেইলি বিবিসিকে বলেন, পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে কৌঁসুলিদের ফৌজদারি মামলা দায়েরের ঘটনা ‘খুবই বিরল’। ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।

এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, পুলিশ এবং কৌঁসুলি দুজনেই আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থার অংশ এবং তারা পরস্পরের সহযোগিতায় কাজ করে । অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ এবং মামলার সময় আদালতে সেগুলো পেশ করার ব্যাপার কৌঁসুলিরা পুলিশের ওপরই নির্ভর করেন।

তাদের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে এই ব্যবস্থায় ‘ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তাদের দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।’

এছাড়াও শক্তি প্রয়োগের অধিকার আইনত পুলিশকে দেয়া আছে। যেমন আইন অনুযায়ী আত্মরক্ষায় অথবা অন্য কারো মৃত্যু ও গুরুতর আহত হওয়া ঠেকাতে পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

মামলা থেকে সুরক্ষা

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে আইনি রক্ষাকবচ থাকায় পুলিশি বর্বরতার শিকার মানুষের জন্য একটাই পথ খোলা থাকে-সেটা হল দেওয়ানি আদালতে মামলা আনা।

কিন্তু নেইলি বলছেন, ‘বাস্তবে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা আনার জন্য দেওয়ানি আদালতের দরজা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে।’ কেননা এক্ষেত্রে ‘বিশেষ রক্ষাকবচের’নীতি তুলে ধরার রেওয়াজ রয়েছে।

তিনি বলছেন ক্ষতিগ্রস্তের ‘সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত অধিকার’বলে আইনের নথিতে যদি কিছু লিপিবদ্ধ না থাকে, তাহলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন একরকম অসম্ভব। তার থেকেও বেশি কঠিন এধরনের মামলা দায়ের করা সম্ভব হলেও, তার থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়।

২০১৪ সালে এমি করবেট নামে এক নারী এক ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে এক ব্যক্তি তার পেছনের বাগানে ঢুকে পড়ে। তার বাগানে সেসময় ছয়টি শিশু খেলা করছিল। সশস্ত্র পুলিশ বাগানে ঢুকে বাচ্চাদের মাটিতে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়।

আদালতের নথিপত্র অনুযায়ী, এসময় এমির পোষা কুকুর ব্রুস বাগানে বেরিয়ে এলে একজন পুলিশ অফিসার কোনরকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই কুকুরকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি চালায়, যদিও কুকুরটা তার জন্য কোনরকম হুমকির কারণ ছিল না।

কুকুরের গায়ে গুলি না লাগলেও গুলি লাগে এমির দশ বছরের ছেলে ডাকোটার পায়ে। ডাকোটা মাটিতে শোয়া অবস্থায় ছিল। ছেলেটি প্রাণে বেঁচে যায়, কিন্তু সে গুরুতর আহত হয় এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

তখন দায়ী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করে এমি ব্যর্থ হন। আদালত তার আবেদন নাকচ করে দেয় এই যুক্তিতে যে, ‘গ্রেপ্তারের সময় শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত এই ঘটনা ঘটেছে এবং এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত অধিকারের লংঘন নয়।’

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল মালাইকা ব্রুকসের প্রতি পুলিশি আচরণ। তাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে তার ওপর তিনবার টেজার অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যাতে তার নড়াচড়ার শক্তি না থাকে। তাকে মুখ নিচে করে মাটিতে শুইয়ে ফেলা হয় এবং তার ১১ বছরের ছেলের সামনে তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়। মালাইকা তখন আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা ছিলেন।

তার অপরাধ ছিলো, তিনি রাস্তায় ঘন্টায় বিশ মাইলের বদলে ৩২ মাইল গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে পুলিশ স্পিড করার জন্য জরিমানার কাগজ ধরিয়ে দেয়। নিজের দোষ স্বীকার করার ভয়ে মালাইকা ওই কাগজে সই করতে অস্বীকার করেছিলেন।

তিনিও পুলিশ অফিসারকে আদালতে নিতে ব্যর্থ হন। কারণ টেজার গান ব্যবহার করার ব্যাপারে ‘সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত অধিকার’য়ের কোনও রূপরেখা না থাকায় আদালত মামলার আবেদন নাকচ করে দেয়। দশ বছর পর মালাইকাকে আদালতের বাইরে ৪৫০০০ ডলারের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।

এসব প্রসঙ্গ টেনে নেইলি বলেন, ‘আদালত পুলিশকে যে এভাবে কী পরিমাণ স্বাধীনতা দিচ্ছে তাদের ইচ্ছামত আচরণ করার, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আমি এটাকে বলব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রায় কোনভাবেই দায়বদ্ধ না করার একটা নীতি।’

নেইলি বলছেন, পুলিশের জন্য যে সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচ রয়েছে তার কারণে ফ্লয়েডের পরিবারের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়া কঠিন হতে পারে।

‘তারা দেখবে আদালতে এমন কোন মামলার নজির আছে কি না, যেখানে কারো মেরুদণ্ডের ওপর নয় মিনিট ধরে হাঁটু দিয়ে চেপে বসে থাকা, যতক্ষণ না সে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে এবং পরে মারা যাচ্ছে - এমন ঘটনা অসাংবিধানিক বলে বিবেচিত হয়েছে। এমন নজির যদি না থাকে, তাহলে সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচের সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনি পুলিশের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। কারণ এমন কোনও ঘটনা আইনত নথিভুক্ত নেই।’

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পুলিশ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বিবিসি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এর আগে পুলিশ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ম্যাকহেল বলেছিলেন, ‘জর্জ ফ্লয়েডের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা মর্মান্তিক। পুলিশ অফিসারের আচরণের পেছনে কোন আইনগত, আত্মরক্ষামূলক, নৈতিক কোনরকম যুক্তি থাকতে পারে না।’

মার্কিন রাজনীতিকরাও একই সুরে কথা বলেছিলেন।

‘দীর্ঘদিন ধরে কালো ও বাদামি চামড়ার মানুষদের একটা শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে, তাদের ওপর নজরদারি চালানো হয়েছে, তাদের গণনির্যাতন করা হয়েছে, দমবন্ধ করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হয়েছে, খুন করা হয়েছে।’ গত ২৯ মে'র পুলিশি বর্বরতার নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব রাখার আগে এই বক্তব্য দিয়ে টুইট করেছিলেন ম্যাসাচুসেটসের জনপ্রতিনিধি আয়ান্না প্রেসলি।

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের জীবন কেড়ে নেয়ার মত অবিচার আর চলতে দেয়া যায় না।’

তবে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পেছনে কাজ করেছে ব্যাপক গণদাবি। আমেরিকার সমাজের গভীরে যে বৈষম্য শেকড় প্রোথিত রয়েছে সেখানে পরিবর্তন আনার দাবি উঠেছে জোরেসোরে।

গণমাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন পুলিশের জন্য এই সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচের নীতির বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের পর্যালোচনা করা উচিত।

পুলিশ কোন্ পরিস্থিতিতে প্রাণঘাতী হতে পারে এমন মাত্রার বলপ্রয়োগ করতে পারে সে বিষয়ে কংগ্রেসে আইন পাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনকর্মীরা।

আমেরিকার নাগরিক অধিকার বিষয়ক একটি সংস্থার পরিচালক উডি ওফার মনে করেন, আমেরিকান প্রশাসনকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তিনি চান পুলিশের বাজেট কমিয়ে দেয়া হোক।

তিনি বলেন, কোনও কোনও শহরে বাজেটের ৪০ শতাংশ খরচ করা হয় পুলিশ বাহিনীর পেছনে।

আমেরিকায় হরহামেশা মানুষ গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এফিবআইয়ের হিসাব অনুযায়ী আমেরিকায় প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন গ্রেপ্তার হন। ২০১৮ সালে গোটা আমেরিকায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল এক কোটি তিন লাখ। এর মধ্যে অনেক অপরাধ ছিল খুবই ছোটখাট।

উডি ওফার বলেন, এমন অভিযোগও এখন শোনা যাচ্ছে যে, জর্জ ফ্লয়েড একটি জাল নোট আসলে দোকানে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিলেন।

তিনি বলছেন, ‘পুলিশের সহিংস আচরণ ও পুলিশের মধ্যে বর্ণবাদ আমেরিকায় দীর্ঘদিনের একটা মৌলিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হয়েছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু এ লড়াইয়ে আমরা এখনও জিততে পারিনি।’

তবে তিনি মনে করেন,‘পুলিশ অফিসারদের ব্যক্তিগতভাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারলেই যে আমরা এই লড়াই জিততে পারব, তা নয়।’

তবে ফ্লয়েডের মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে যে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনে পরিবর্তনের আশা দেখছেন অনেকে। মানবাধিকার আন্দোলনকারীরা এখন পুলিশি নিপীড়নের ইস্যুটি রাজপথ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারায় পরিবর্তনের পথের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। সেটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সেটা সময়ই বলে দিবে। তবে ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড যে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থায় একটা ঢেউ তুলেছে সেটি কিন্তু অস্বীকার করার জো নেই।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত