ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

২০ হাজার মানুষ উধাও, স্বাধীনতার জন্য লড়ছে বালুচিস্তানের তরুণরা!

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২০, ১৩:৪৯  
আপডেট :
 ০৩ আগস্ট ২০২০, ১৪:১৩

২০ হাজার মানুষ উধাও, স্বাধীনতার জন্য লড়ছে বালুচিস্তানের তরুণরা!

আয়তনের দিক থেকে বালুচিস্তান হচ্ছে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। বালুচিস্তানের আয়তন ৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৯০ কিলোমিটার, যা পাকিস্তানের মোট আয়তনের প্রায় ৪৩ শতাংশ। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে ছোট। রাজধানী হচ্ছে কোয়েটা।

ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের বিবেচনায় পাকিস্তানের জন্য এই প্রদেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বালুচিস্তানের উত্তর-পূর্ব দিকে আছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখোয়া, পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্বদিকে সিন্ধু, দক্ষিণে আরব সাগর, পশ্চিমদিকে ইরান, আর উত্তর ও উত্তর-পূর্বদিকে আছে আফগানিস্তান।

প্রদেশের প্রধান জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে বালুচ এবং পশতুন। বালুচরা প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ। আর পশতুনরা ৩৬ শতাংশ। এর বাইরে আছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী - ব্রাহুইস, হাজারা, সিন্ধী, পাঞ্জাবি, উজবেক।

পাকিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বালুচিস্তানেই, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৪৮ সালে। বালুচিস্তানে যে চারটি প্রিন্সলি স্টেট ছিল, তার তিনটি ১৯৪৭ সালেই পাকিস্তানে যোগ দেয়- মাকরা, লাস বেলা এবং খারান। কিন্তু চতুর্থ একটি প্রিন্সলি স্টেট, খান অব কালাতের শাসক আহমদ ইয়ার খান প্রথমে পাকিস্তানের যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালে যখন তিনি পাকিস্তানে যোগ দেয়ার জন্য রাজি হন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন তার ভাই প্রিন্স আগা আবদুল করিম বালুচ। তারাই বালুচিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেন।

এরপর এ পর্যন্ত বালুচিস্তানে অন্তত পাঁচবার স্বাধীনতার প্রশ্নে সশস্ত্র সংঘাত হয়েছে। প্রতিবারই নিষ্ঠুরভাবে এসব বিদ্রোহ দমন করা হয়।

বালুচিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আছে।

বালুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন এখন নানা ধারায় বিভক্ত। কোন কোন গোষ্ঠী কেবল অধিকতর স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন করছে। কোন কোন গোষ্ঠী বালুচিস্তানকে একেবারে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে।

বালুচিস্তানে এরকম প্রায় আধা ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা আছে, যারা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য লড়ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)।

এদিকে ইউরোপ-ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অব বালুচিস্তান (এইচআরসিবি) এক হিসেবে জানিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য লড়তে গিয়ে ২০০০ সালের পর থেকে অন্তত ২০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী নিখোঁজ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে ৭ হাজার মারা গেছে।

তাদের মধ্যে ৩ মাস আগে সানা বালুচ নামে এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন। গত বসন্তে আরও অনেক ছাত্রের মতো সানা বালুচ ফিরে গিয়েছিলেন বাড়িতে। আরও অনেকের মতো তার সামনেও ছিল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

সানা বালুচ পড়তেন ইসলামাবাদে পাকিস্তানের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতোকোত্তর ক্লাশের মেধাবী ছাত্র সানার জন্ম বালুচিস্তান প্রদেশের ছোট্ট এক শহর খারানে।

তাদের শহরটি ইসলামাবাদ থেকে শত শত মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম বালুচিস্তানে। সেখানে জনবসতি খুবই কম। গত ১১ মে এই খারান শহরের উপকন্ঠ থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন সানা।

শুধু সানা বালুচই নয় শাহদাদ মুমতাজ নামে আরেক ছাত্রের সাথেও ঘটেছে এমন ঘটনা।

শাহদাদ বালুচিস্তানেরই আরেকজন ছাত্র। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তার পরিবার একেবারে চুপ করে ছিলেন। তাদের ছেলে ফিরে আসে কয়েক মাস পর।

তবে শেষ পর্যন্ত শাহদাদ এ বছরের মে মাসের এক তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক গোলাগুলিতে নিহত হন। এটি ঘটেছিল সানা বালুচ নিখোঁজের ১০ দিন আগে।

শাহদাদ মুমতাজ বালুচিস্তানের এই শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই একজন ছিলেন।

বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) দাবি করেছিল, শাহদাদ মুমতাজ ছিল তাদের দলের লোক। শাহদাদকে যারা চিনতেন, তারা একথা শুনে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।

বালুচ লিবারেশন আর্মি তাদের বিবৃতিতে বলেছিল, শাহদাদ মুমতাজ মারা গেছেন ‘পাকিস্তান আর্মি আর তাদের দোসর ডেথ স্কোয়াডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে।’

সানা বালুচের কাহিনীও শাহদাদ মুমতাজের কাহিনীর চাইতে আলাদা কিছু নয়। আরও শত শত বালুচ রাজনৈতিক কর্মীর কাহিনীও এরকমই। সানা বালুচও এক বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী। তার ভাগ্য কী ঘটবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

অন্যদিকে বালুচিস্তানে যেসব সেনানিবাস আছে, সেগুলোর ভেতরে নাকি অনেক বন্দীশালা আর নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। পাকিস্তানের হিউম্যান রাইটস কমিশনের ভাষায়, এসব জায়গা থেকে মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়, সেখানে মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো হয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসব কিছুই ঘটে আইনের আওতার বাইরে।

মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ- সেনাবাহিনীর হাতে এভাবে ধরা পড়া মানুষ একেবারেই হাওয়া হয়ে গেছেন। তাদের কখনো আদালতের সামনে হাজির করা হয়নি।

সেনাবাহিনী স্থানীয় অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে বালুচ জাতীয়তাবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন দমনে ব্যবহার করছে এমন অভিযোগও ব্যাপক। এই অপরাধী গোষ্ঠীগুলো এবং বন্দীশিবিরে গিয়ে ‘ভুল শোধরানো সাবেক বিদ্রোহীদের’ দিয়ে নাকি তৈরি করা হয় ‘ডেথ স্কোয়াড’। এই সশস্ত্র গ্রুপগুলো অনুচর হিসেবে কাজ করে, তারা জাতীয়তাবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে সামরিক বাহিনীকে দেয়। এরপর সামরিক বাহিনী তাদের ‘নির্মূল’ করে দেয়।

অন্যদিকে বালুচিস্তানে ক্ষমতায় আছে যে বেসামরিক সরকার, তারা অতীতে শত শত রাজনৈতিক কর্মীকে এবং সন্দেহভাজন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হত্যার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের অর্ন্তদ্বন্দ্বকে দায়ী করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বালুচিস্তানে অব্যাহতভাবে এই নিপীড়ন-নির্যাতনের নীতি এবং ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর রাশ টেনে ধরতে পার্লামেন্ট এবং বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা সেখানকার জাতীয়বাদী গোষ্ঠীগুলোকে আরও চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক একটি থিংকট্যাংক ‘কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যশনাল পীস‌’ ২০১৩ সালে বালুচিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল।

এটিতে তারা বলেছিল, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান টার্গেট এখন বালুচিস্তানের মধ্যবিত্ত। মনে হচ্ছে, এর উদ্দেশ্য বালুচ জাতীয়তাবাদের সব নিশানা নির্মূল করা এবং এটির যাতে পুনর্জাগরণ না ঘটে সেই সম্ভাবনাও বিনাশ করা‌।

প্রসঙ্গত, বালুচিস্তানের রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। পাকিস্তানের মোট আয়তনের ৪৪ ভাগই বালুচিস্তান। অথচ বালুচরা হচ্ছে দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বালুচিস্তানের খনিজ সম্পদের আর্থিক মূল্য হিসেব করলে তা এক লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু কেবল এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না বালুচিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বন্দ্ব।

তবে বালুচিস্তানের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং তীব্র সংঘাতের সূচনা হয়েছে ২০০০ সালের শুরু থেকে। সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মুশাররফ সেখানে অনেকের ভাষায় এক ‘কারচুপির নির্বাচন’ করেন। এ থেকে বিরাট রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়।

২০০৫ সালে রাজনৈতিক বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠে। বালুচিস্তানের সুই এলাকায় এক নারী চিকিৎসক সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হন। কিন্তু এজন্যে কাউকে সাজা দেয়া হয়নি। এর জের ধরে যে ব্যাপক বিক্ষোভ-বিদ্রোহ শুরু হয়, তা দমনে পারভেজ মুশাররফ সেখানে হাজার হাজার সৈন্য পাঠান।

এরপর বিগত বছরগুলোতে সেখানে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি কেবলই বেড়েছে। তৈরি করা হয়েছে আরও অনেক সেনানিবাস। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো অভিযোগ করছে, সেখানে এমনকি বেসরকারি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও তৈরি করা হয়েছে যাতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত, বা জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের ধরা যায়। সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত