নন্দাদেবী শৃঙ্গে কি পারমাণবিক বোমা লুকানো আছে?
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৯:০০ আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৯:০৫
ভারতের হিমালয়-সংলগ্ন উত্তরাখন্ড রাজ্যে দু’সপ্তাহ আগে হিমবাহ ভেঙে যে বরফ, পানি আর পাথরের ঢল নেমেছিল - তার কারণ কী? এ কথা যদি আড়াই শ পরিবারের ছোট্ট গ্রাম রাইনির লোকদের জিজ্ঞেস করেন - তাহলে এক অদ্ভূত জবাব শুনতে পাবেন আপনি।
গত ৭ই ফেব্রুয়ারি হিমবাহ ধসের ঘটনায় ৫০ জনেরও বেশি লোক নিহত হন। তবে এর কারণ সম্পর্কে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সেই বিচিত্র ধারণা প্রচলিত আছে কয়েক প্রজন্ম ধরেই। তারা মনে করেন - সেখানে বরফের নিচে লুকিয়ে রাখা আছে কিছু পারমাণবিক অস্ত্র, এবং সেই বোমাগুলোর কোনো একটি বিস্ফোরিত হয়েই ওই ধসের ঘটনা ঘটেছিল।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, চামোলি জেলায় হিমালয়ের নন্দাদেবী শৃঙ্গের কাছে হিমবাহের একটি অংশ হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল - এবং তার ফলে অলকানন্দা ও ধৌলিগঙ্গা নদীতে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি হয় যা অনেক বাড়িঘর ও স্থাপনা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু রাইনির লোকজনকে যদি আপনি এ গল্প বলতে যান - তাহলে দেখবেন অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করছে না।
‘আমাদের মনে হয় লুকানো বোমাগুলোর একটা ভুমিকা আছে। শীতকালে একটা হিমবাহ কিভাবে ভেঙে পড়তে পারে? আমরা মনে করি সরকারের উচিত ব্যাপারটার তদন্ত করা এবং বোমাগুলো খুঁজে বের করা,’ বলছিলেন সংগ্রাম সিং রাওয়াত, রাইনির গ্রাম প্রধান। তাদের এই ধারণার পেছনে আছে স্নায়ুযুদ্ধের যুগের এক বিচিত্র কাহিনি।
চীনের বিরুদ্ধে নজরদারি করতে ভারত-মার্কিন গোপন তৎপরতা
উনিশ শ ষাটের দশকে এই এলাকাটিতে কিছু বিচিত্র গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা ঘটেছিল। এতে জড়িত ছিল তৎকালীন কিছু শীর্ষ পর্বতারোহী, ইলেকট্রনিক স্পাইং সিস্টেম চালানোর জন্য তেজষ্ক্রিয় পদার্থ, এবং কিছু গুপ্তচর। সে সময় চীন পারমাণবিক বোমা এবং ক্ষেপণাস্ত্রের মালিক হবার জন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিল। আর তার ওপর নজর রাখতে ১৯৬০-এর দশকে ভারতের সাথে সহযোগিতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা চীনের পারমাণবিক পরীক্ষা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ওপর নজরদারি করতে হিমালয় এলাকায় পরমাণু শক্তিচালিত কিছু যন্ত্র স্থাপনের কাজে ভারতের সাহায্য নিয়েছিল।
এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখালিখি করেছেন পিট তাকেডা - যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘রক এ্যান্ড আইস ম্যাগাজিনের’ একজন প্রদায়ক-সম্পাদক। তিনি বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের যুগের সন্দেহবাতিক তখন চরমে উঠেছে। কোন পরিকল্পনাকেই তখন পাগলামি বলে উড়িয়ে দেয়া হতো না, যত অর্থই লাগুক তা পেতে অসুবিধা হতো না, এবং এ জন্য যে কোন পন্থা নিতে কেউ দ্বিধা করতো না।
এই অভিযান নিয়ে নানা রকম গল্প
নন্দাদেবী নিয়ে একটি বই লিখেছেন ব্রিটিশ লেখক হিউ টমসন। তিনি লিখেছেন, স্থানীয় লোকেরা যাতে সন্দেহ না করে সে জন্য আমেরিকান পর্বতারোহীদের চামড়ার রঙ তামাটে করার ক্রিম লাগাতে বলা হয়েছিল। তাদের অভিযানের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল - অত উঁচুতে উঠলে অক্সিজেনের অভাবে মানবদেহে কি প্রতিক্রিয়া হয় তা পরীক্ষা করতেই এ অভিযান।
সাথে যে কুলিরা পারমাণবিক যন্ত্রপাতি বহন করছিলেন তাদের বলা হয়েছিল - এতে সোনা বা ওই জাতীয় কোন ধনরত্ন আছে।
১৯৭৮ সালের আগে এ অভিযানের কথা কেউ জানতো না ভারতে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই ব্যর্থ অভিযানের কথা গোপন রাখা হয়েছিল। সে সময় ওয়াশিংটন পোস্ট এক রিপোর্টে জানায়, সিআইএ কিছু অভিজ্ঞ আমেরিকান পর্বতারোহী ভাড়া করে হিমালয়ের দুটি শৃঙ্গে পারমাণবিক শক্তিচালিত নজরদারির যন্ত্র বসিয়েছিল - যার লক্ষ্য ছিল চীনের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করা।
ওয়াশিংটন পোস্টের সেই রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৬৫ সালে প্রথম অভিযানটি ব্যর্থ হয় এবং যন্ত্রপাতি হারিয়ে যায়। তবে দু বছর পর আরেকটি অভিযানে সিআইএ’র মতে ‘আংশিক সাফল্য’ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর ১৯৬৭ সালে নন্দাদেবীর কাছে নন্দাকোট নামে আরেকটি শৃঙ্গের ওপর নতুন এক সেট গুপ্তচরবৃত্তির যন্ত্রপাতি সফলভাবে বসানো হয়।
এ জন্য ১৪ আমেরিকান পর্বতারোহীকে তিন বছর কাজ করতে হয়। তাদের প্রতি মাসে ১,০০০ ডলার দেয়া হয়েছিল। পার্লামেন্টে এ তথ্য জানান প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই। ১৯৭৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই পার্লামেন্টে জানান যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে নন্দাদেবী শৃঙ্গে পারমাণবিক শক্তিচালিত যন্ত্র বসানোর কাজ করেছে। তবে এ মিশন কতটা সফল হয় তা দেশাই জানাননি।
সে সময় দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে এর প্রতিবাদে ছোট একটি বিক্ষোভ হয়েছিল বলে সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন গোপন দলিলপত্রে জানা গেছে। বিক্ষোভকারীদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘সিআইএ ভারত ছাড়ো’ এবং ‘সিআইএ আমাদের পানি দূষিত করছে’।
যন্ত্রগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছে?
কেউ জানে না সেই হারানো পারমাণবিক যন্ত্রগুলোর কি হয়েছে। আমেরিকান সেই পর্বতারোহীদের একজন জিম ম্যাককার্থি তাকেডাকে বলেছিলেন, হ্যাঁ সেই যন্ত্রগুলো ধসের মধ্যে পড়ে কোন হিমবাহে আটকে গেছে। এর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।
পর্বতারোহীরা বলেন, রাইনিতে একটি ছোট স্টেশন আছে যেখানে নিয়মিত নদীর জল ও বালুতে কোন তেজষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। তবে এরকম দূষণের কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। আউটসাইড সাময়িকীর রিপোর্টে বলা হয়, ব্যাটারির প্লুটোনিয়াম পুরোপুরি নষ্ট হতে কয়েক শতাব্দী লাগতে পারে। ততদিন হয়তো এটা একটা ভয়ের কারণ হয়েই থাকবে যে - হিমালয়ের বরফের মাধ্যমে ভারতের নদীগুলোতে তেজষ্ক্রিয় উপাদান মিশে যেতে পারে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে