ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

ইন্দিরা থেকে মমতা, ইতিহাসে ব্রিগেড সমাবেশ

ইন্দিরা থেকে মমতা, ইতিহাসে ব্রিগেড সমাবেশ
ইতিহাস তৈরির জন্য প্রস্তুত ব্রিগেড

কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বাঁধ ভাঙা সমাবেশ আছড়ে পড়েছে অনেক বারই। কখনও ইন্দিরা গান্ধীর জন্য, কখনও জ্যোতি বসুকে ঘিরে, আবার কখনও যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে। এক একটা সমাবেশ এক একটা প্রেক্ষিত থেকে মাইল ফলকে পরিণত হয়েছে। রেকর্ড তৈরি হয়েছে, রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু সমাবেশের আয়োজন পর্বেই এ যাবৎ কালের বৃহত্তম জমায়েতের নজির তৈরি হওয়ার বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত জল্পনা শুরু হওয়া এর আগের কোনো ব্রিগেড সমাবেশকে গিরে দেখা যায়নি।

গত ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে যে ভঙ্গিতে এই ব্রিগেড সমাবেশের কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন সেই ভঙ্গিই বলে দিয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনের আগে বাংলায় তৃণমূলের শক্তি প্রদর্শনের সমাবেশে পরিণত হতে চলেছে এই ব্রিগেড। প্রতিপক্ষকে দাবড়ানি দিয়ে রাজনীতি করায় যে তৃণমূল এখনও পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই তৃণমূল শক্তি প্রদর্শনে কোমর বেঁধে নামলে ব্রিগেড সমাবেশের চেহারাটা কী রকম দাঁড়াতে পারে, তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অসুবিধা হয় না। অতএব, গত বছরের ২১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণাই অনেককে বুঝিয়ে দিয়েছিল আজ ১৯ জানুয়ারির এ সমাবেশকে ঘিরে জনতার ভিড়ে কতটা উত্তাল হতে পারে কলকাতা।

১৯৭২ সালে ব্রিগেডে ইন্দিরা গান্ধী। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

এই ব্রিগেড সমাবেশকে মোদি বিরোধী ঐক্যের সব চেয়ে বড় উচ্ছ্বাস এবং হুঙ্কার হিসাবে তুলে ধরতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বদ্ধ পরিকর। জল্পনা এখন তাই আর ভিড়ের রেকর্ড নিয়ে নয়। অন্য সব রেকর্ডকে কতটা পিছনে ফেলতে পারবে শনিবারের ব্রিগেড, জল্পনা এখন শুধু তা নিয়েই।

ভারতের এ রাজ্যে এখন জেলার সংখ্যা ২৩। আর জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের উত্তর ২৪ পরগনা হোক বা গৌরীশঙ্কর দত্তর নদিয়া, অনুব্রত মণ্ডলের বীরভূম হোক বা সৌরভ চক্রবর্তীর আলিপুরদুয়ার, শুভাশিস চক্রবর্তীর দক্ষিণ ২৪ পরগনা হোক বা অজিত মাইতির পশ্চিম মেদিনীপুর— তৃণমূলের যে জেলা কমিটিকেই লোক দেওয়ার টার্গেটের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, সেই জেলা কমিটিই জানাচ্ছে, লক্ষ্য লক্ষাধিক। সব ক’টা জেলা যদি গড়ে এক লক্ষ লোকও আনতে পারে, তা হলেই অবিশ্বাস্য নজির গড়ে ফেলবে মমতার এ বারের ব্রিগেড সমাবেশ।

তা হলে শুধু ব্রিগেডের ঘাসে নয়, ব্রিগেডের মঞ্চেও এবার ইতিহাস তৈরি হবে। সমাবেশের আকারে যেমন শুধু ব্রিগেডকে নয়, গোটা কলকাতাকে উপচে দিতে চাইছে তৃণমূল, শনিবার ব্রিগেডের মঞ্চে নক্ষত্রের সমাহারে সে ভাবেই গোটা দেশের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কোহিমা— কোন রাজ্যের নেতা নেই, কোন প্রান্তের মহারথী আসছেন না! তেলঙ্গানার শাসক দল টিআরএস, উড়িশ্যার শাসক দল বিজেডি, কেরালার শাসক দল সিপিএম— এই তিন দলকে বাদ দিলে অবিজেপি বা বিজেপি বিরোধী শিবিরের প্রায় সব রথী-মহারথী শনিবারের ব্রিগেড সমাবেশে হাজির থাকছেন অথবা প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। শনিবার মমতার মঞ্চে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন কংগ্রেস নেতা সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীও।

শুক্রবার কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও চিঠিও পাঠিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সে চিঠিতে বিজেপি বিরোধী ঐক্য সমাবেশের সাফল্য কামনা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।

একমাত্র বামেরাই মমতার এই সমাবশে যোগ দিচ্ছেন না। তবে তাতে এই সমাবেশ বিন্দুমাত্র ম্লান হওয়ার নয়। ব্রিগেডের একটা সমাবেশকে এ ভাবে জাতীয় রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্রে পরিণত হতেও অনেকগুলো প্রজন্ম দেখেনি।

এর আগে কোন কোন সময়ে নজর কেড়েছে ব্রিগেড?

ব্রিগেডে নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিন

প্রথম মাইল ফলক ১৯৫৫ সাল। তৎকালীন সোভিয়েত উইনিয়নের দুই শীর্ষ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিন ভারত সফরে এসেছিলেন। তাদের নিয়ে ব্রিগেডে জনসভার আয়োজন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তাৎপর্যে এবং জমায়েতে সে ব্রিগেড ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে চির কালের জন্য।

এর পরে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ভেঙে গিয়েছে পাকিস্তান, ভারতের সহায়তায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। তাকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিগেডে সমাবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সে বারও আয়োজক ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। উচ্ছ্বাসে, উন্মাদনায় ভেসে গিয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড।

এর তিন বছর পরে আবার নজর কেড়েছিল ইন্দিরা বিরোধী এক ব্রিগেড। জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতি বসু, প্রফুল্ল সেনরা এক মঞ্চে এসেছিলেন সেবার। বাংলার তথা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেই সমাবেশ অবশ্যই এক মাইল ফলক ছিল।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় গোটা বাংলাকে চমকে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯২ সাল। বামফ্রন্ট তখন বাংলার মধ্যগগনে। ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা কংগ্রেসের ডাকে যে ব্রিগেড ভরতে পারে, এমনটা ভাবাই যাচ্ছে না। এমন এক সন্ধিক্ষণে প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রিগেডে সমাবেশ ডাকলেন, বামফ্রন্ট সরকারের ‘মৃত্যু ঘণ্টা’ বাজানোর ডাক দিলেন।

বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশ

২৫ নভেম্বরের সেই ব্রিগেড জমায়েত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ক্রাউড পুলার’ ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা তো দিয়েছিলই, কংগ্রেসকেও বাংলায় চনমনে করে তুলেছিল এক ধাক্কায়।

২৯ নভেম্বর বামেদের ব্রিগেড সমাবেশও আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। ২৫ নভেম্বর মমতার সাফল্য দেখার পরে সর্বশক্তি দিয়ে ময়দানে ঝাঁপায় সিপিএম। কংগ্রেসের সমাবেশকে টেক্কা দেওয়ার জন্য বাংলার তদানীন্তন শাসক দল উঠেপড়ে লাগে। বামেদের সেই জমায়েত কিন্তু সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল রাজনৈতিক শিবিরের। ব্রিগেডে ভিড় জমানোর পরীক্ষায় বামেদের সেই জমায়েত সর্বকালীন রেকর্ড কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী কালে ২০০৬ সালেও ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে অবিশ্বাস্য জনস্রোত তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড ফের এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে। শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র‌্যালি’র জন্য সেজেগুজে প্রস্তুত দেশের পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম শহরের সব চেয়ে বড় মাঠটা। ইতিহাস তৈরির পথে এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।

১৯৯২ সালে এই ব্রিগেড থেকেই বামফ্রন্টের ‘মৃত্যু ঘণ্টা’ বাজানোর ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সূত্র: আনন্দবাজার

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত