ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেভাবে ‘ভুয়া সংবাদ’ বানাতো ব্রিটেন

স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেভাবে ‘ভুয়া সংবাদ’ বানাতো ব্রিটেন
ভুয়া পোস্টার

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে‘ভুয়া সংবাদ’বানানোর জন্য নকল প্রমাণাদি তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারি দলিল দস্তাবেজ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সরকারের তথ্য গবেষণা বিভাগ ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রোপাগান্ডা চালানোর গোপন ইউনিট। ত্রিশ বছর ধরে সাংবাদিকদের নানারকম খবর যোগান দিয়ে গেছে এবং একই সঙ্গে চালিয়েছে নিজেদের এক সংবাদ সংস্থাও। ২০১৯ সালের শুরুতে দুই হাজারের বেশি ফাইল ন্যাশনাল আর্কাইভে পাঠানো হয়েছে, যা থেকে জানা যাচ্ছে বিস্ময়কর সব তথ্য।

স্নায়ু যোদ্ধা

এই ফাইলগুলোর বেশিরভাগই ষাটের দশকের। ব্রিটেনের সিক্রেট প্রোপাগান্ডা ওয়ার নামে বই এর লেখক পল লাশমার বলছেন, সেই সময়টাই ছিল আইআরডির স্বর্ণসময়। সেই সময় এর কর্মী সংখ্যা ছিল ৪০০-৬০০ জনের মত ।

১৯৭৮ সালে পল লাশমার সেই সাংবাদিকদের দলে ছিলেন, যারা আইআরডির অস্তিত্ব সম্পর্কে বাকি পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিল।

তিনি জানিয়েছেন, প্রথমবারের মত সেই সময়কার দলিলপত্র প্রকাশিত হলো। সংস্থায় যারা কাজ করতেন, তাদের বেতনাদি ‘গোপন ভোটের’ মাধ্যমে পরিচালনা করা হতো। এর অর্থ এই বরাদ্দের জন্য পার্লামেন্টের কাছে কোন জবাবদিহি করতে হত না।

এর একটি অংশ হত দেশের বাইরে, কিন্তু তাদেরও কাজ ছিল লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের সংবাদ সরবারহ করা। নতুন প্রকাশিত দলিলগুলোর মধ্যে অনেক গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকেরাও রয়েছেন।

১৯৬০ সালে নিল অ্যাশেরসন ছিলেন অবজারভার পত্রিকার অল্প বয়েসী একজন রিপোর্টার, যাকে আইআরডিতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক ও সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড ক্রাঙ্কশ। তাকে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হবার পর আইআরডি তাকে ‘খবর’সরবারহ করার যোগ্য বিবেচিত হন।

তখন তাকে পূর্ব ইউরোপ সংক্রান্ত খবরাখবর দেয়া হত। সেসব খবর হত হাতে লেখা, এবং এগুলো গোপন হিসেবে বিবেচিত হত।

‘আমি দ্রুতই বুঝতে পেরেছিলাম, এসব খবর কোন খবরই নয়। খুবই সাদামাটা আর অনেক সময়ই পুরনো খবর’ হত সেই সরবারহকৃত সংবাদসমূহ। ‘আর খবরগুলো এমন হত যেন তারা নিজেরাও স্নায়ু যুদ্ধে লড়ছে।’

বানানো তথ্য বিবরণী

পল লাশমার বলছেন, অন্য যেকোন সংবাদ সংস্থার সাথে প্রতিযোগিতার বিষয়টি আইআরডির কর্মকর্তারা বেশ উপভোগ করতেন। এর মধ্যে বুদাপেস্ট ভিত্তিক কম্যুনিস্ট সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ডেমোক্রেটিক ইয়ুথের এক ভুয়া খবর বানানো নিয়ে বেশ জটিল এক প্রজেক্ট বানাতে হয়েছিল আইআরডিকে।

১৯৬৩ সালে একবার খবরের শিরোনাম হয়েছিলো যে বুলগেরিয়ায় থাকা আফ্রিকান ছাত্ররা কট্টরপন্থীদের আক্রমণের শিকার হয়ে একসঙ্গে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সেসময় আইআরডি ভাবল একে ঐ অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ বাড়াতে খবরটিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়।

সরকারি সংস্থার ভুয়া লেটারমার্ক সম্বলিত কাগজে আইআরডি শত শত সংবাদপত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ কূটনীতিকরা ব্যবহার করেন এমন ব্যাগে করে পাঠানো হয়েছিল সেই প্রেস রিলিজ।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তির একটি লাইন ছিল খুবই আপত্তিকর, যাতে বলা হয়েছিল, ‘আফ্রিকানরা জঙ্গলের অন্ধকারের চাহিদা থেকে বের হয়ে আসছে, যেখানে তারা বুঝতোই না যে খাদ্য, জ্বালানি কিংবা কাপড় মুফতে পাওয়া যায় না।’

আইআরডি বহু নকল বিবৃতি তৈরি করেছে ষাটের দশকে

এ খবর প্রকাশিত হবার পর আফ্রিকান ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। নাইজেরিয়ার ছাত্ররা একে ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ঘোষণা’বলে আখ্যা দিলো। এ নিয়ে ভয়াবহ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল তখন। যদিও পরে জানা গিয়েছিল, এটি ছিল ভুয়া খবর।

বিদেশের খবরে নজর বেশি

আইআরডির খবরের বড় অংশটি ছিল বিদেশের খবর, কিন্তু মাঝে মাঝে তাদের যুক্তরাজ্যের ভেতরের খবর তৈরির কাজেও লাগানো হত। ১৯৬২ সালে ইলিংটনের লেবার দলের এমপি গেরি রেনোল্ডস তাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। তার আশংকা ছিল তার স্থানীয় লেবার পার্টির নেতা কর্মীদের একদল সংগঠিত ট্রটস্কিপন্থী বাম ধারার লোক নিজেদের দলে টানতে চাইছে।

যে কারণে তিনি চাইছিলেন, আইআরডি যদি এক্ষেত্রে ঐ দলটি সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে তিনি দলে ভাঙন ঠেকাতে পারবেন। আইআরডি তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দা বাহিনীর ভূমিকায় নেমে পড়ে।

নকল পোষ্টার

গোপন নথিতে দেখা যায়, আইআরডি ভিয়েনার ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পিসের হয়ে প্রেস রিলিজ বানাতো এবং বিতরণ করতো। আন্তর্জাতিক ছাত্র ইউনিয়নের ভুয়া পোস্টারও ছাপত আইআরডি, যেখানে মার্কিন বিরোধিতার বদলে চীন বিরোধিতাকে উস্কে দেয়া হত।

এবারই প্রথমবারের মত আইআরডির নিজের তথ্য উন্মোচন হলো। কয়েক দশক ধরে আইআরডি কম্যুনিস্টদের বানানো ভুয়া খবর সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। দলিলে দেখা গেছে, ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার বরাতে ভুয়া খবর আফ্রিকার নেতাদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই নিজের স্বার্থ অনুযায়ী দলিলপত্র তৈরি করে বিলিও করেছে আইআরডি। যদিও সেটা সম্পূর্ণই নীতিবিরুদ্ধ বলে রায় দিয়েছেন পল লাশমান।

স্নায়ুযুদ্ধের বিখ্যাত প্রতীক ছিল এই বার্লিন দেয়াল

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত