ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২১ মিনিট আগে
শিরোনাম

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন যেভাবে

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন যেভাবে

অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপের হাঙ্গেরী, রাশিয়ার ক্রিমিয়া থেকে পূর্বে জর্জিয়া এবং আরবের ইয়েমেন পর্যন্ত। এই বিশাল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিলো দীর্ঘ ৬শ বছর। এই বিশাল সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় প্রথম ওসমানের হাত ধরে, ১২৯৯ সালে। এরপর প্রথম মুরাদ (১৩৬১-১৩৮৯), প্রথম বায়েজিদ (১৩৮৯-১৪০২), প্রথম মুহাম্মদ (১৪১৩-১৪২১), দ্বিতীয় মুরাদ (১৪২১-১৪৪৪) দ্বিতীয় মুহাম্মদ (১৪৪৪-১৪৪৬) ও দ্বিতীয় মুরাদ (১৪৪৬-১৪৫১), প্রথম সুলায়মান (১৫২০-১৫৬৬), তৃতীয় মুরাদ (১৫৪৭-১৫৯৫), তৃতীয় মুহাম্মদ (১৫৯৫-১৬০৩) ইত্যাদি প্রভাবশালী শাসকদের হাত ধরে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছায় অটোমানরা।

কিন্তু শেষ দিকের শাসকরা এতবড় সাম্রাজ্যের দেখভাল করতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে ফ্রান্স, ব্রিটেন আর প্রতিবেশী রাশিয়ার দিনে দিনে শক্তিবৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে থাকে অটোমানদের প্রতিপত্তি। মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে জাতীয়বাদী শক্তিগুলো। সবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভুল নীতি বেছে নেয়ার ফল হিসাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় বিশাল এই সামাজ্য। তবে ভগ্নাংশ হিসাবে টিকে আছে আজকের তুরস্ক।

অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বহু ধর্ম, বর্ণ এবং বহু ভাষার। এই দিকে থেকে ইউরোপীয়ান পণ্ডিতরাও একমত যে অটোমান শাসকেরা জোড় পূর্বক কাউকে ধর্মান্তরিত করে নাই। কিন্তু সাম্রাজ্যের বিধর্মীরা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য বিবেচিত হতো না এবং তাদের নিদৃষ্ট হারে ট্যাক্স প্রদান করতে হতো, যা নিয়ে বিক্ষব্ধ ছিলো খ্রিস্টান সম্প্রদায়। এরই মধ্যে শিল্পবিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের পর থেকেই অটোমানের দুর্দিন শুরু হয়।

নব্য সংগঠিত ও সমৃদ্ধের পথযাত্রী খ্রিস্টান ইউরোপীয়ানদের জন্য অটোমান ছিল চ্যালেঞ্জ। অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী খ্রিস্টানরা খুব দ্রুত রেঁনেসা পরবর্তী ইউরোপের শিল্প ও জ্ঞান সমৃদ্ধির পথে নিজেদের যুক্ত করে ফেলে। অটোমান সাম্রাজ্যের বাসিন্দা হলেও পশ্চিমের সাহায্যে একটি নিজস্ব শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা সমৃদ্ধ করে ফেলে। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের শরিয়া আইন, বিধর্মী ট্যাক্স এবং রাজনৈতিক আইসোলেশন তাদের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক রূপে দেখা দেয়।

ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এবং ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন এলাকার সুলতানী শাষনে বসবাসরত বলকান এলাকায় খুবই দ্রুত জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রসার এবং প্রথম টার্গেটই হয় অটোমান সাম্রাজ্য! আর এদিকে প্রাচীন টেকনোলজী এবং ট্যাক্স নির্ভর অর্থনীতির ধারক অটোমান তুলনামূলকভাবে দিন দিন শক্তি হারাতে থাকে।

জার্মান পোস্টকার্ডে উসমানীয় নৌবাহিনীর চিত্রায়ন। বামে সুলতান পঞ্চম মুহাম্মদের ছবি

আর দুর্বল হতে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের উপর সংস্কারের জন্য বহিঃশক্তি মানে, ফ্রান্স , ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, রাশিয়ার চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এবং নিজ বর্ডারের ভেতরের ভিন্ন ধর্ম ও ভাষার জনগণও সংস্কারের জন্য চাপ দিতে থাকে।

কিন্তু ইসলামি খেলাফতের ভেতর ধর্ম সংস্কার করার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না তৎকালীন অটোমান সুলতান! এসবের ফলাফলে দীর্ঘ সময় ও শক্তি হারিয়ে ১৮৩৯ থেকে অটোমানরা বাধ্য হয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। ‘তাঞ্জিমাত’ও এর ধারাবাহিকতায় ‘ইসলাহাত’ নামে দিন বদল শুরু হয়।িএসব সংস্কারের মাধ্যমে বিধর্মী ও মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান সমান করা হয়, বিধর্মী ও মুসলিমদের ট্যাক্স সমান করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ডাক শুনতে পাওয়া জনগণ এসবে সন্তুষ্ট ছিল না। তার উপর সুলতানের আমলাদের দুর্নীতি এবং প্রাচীন সামরিক সরঞ্জাম ও শাসনের কঠোরতা ধরে রাখার পথে বাধা ছিল।

আর ইউরোপ থেকে মুসলিম অটোমানদের বিতাড়িত করার ৫০০ বছরের লালিত স্বপ্নতো তৎকালীন পরাশক্তি ফ্রান্স, ব্রিটেন আর রাশিয়ার তো ছিলই।

এদিকে সংস্কারের প্রথম ধাপের প্রতিক্রিয়া হলো খেলাফত পন্থীরা অটোমান শাসকদের প্রতি বিশ্বাস হারালেন। অন্যদিকে আরও বেশি সংস্কারের দাবিতে কঠোর অবস্থান নিলো পশ্চিমাপন্থি তথা সামাজ্যের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর। এই দুই শক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে উঠতে পারছিলো না শাসকরা। ফলে দুর্বল থেকে অটোমান দুর্বলতর হয়ে পড়তে থাকে অটোমানদের বিশাল সাম্রাজ্য।

এই অবস্থায় ক্ষমতায় আসেন সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ (১৮৭৬-১৯০৯)। তিনি শরিয়া ও খেলাফতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত খ্রিস্টান অঞ্চলগুলোতে বাস্তবায়িত সেক্যুলারিজমের সংস্কার স্থগিত করে ফের আবার ইসলামিক পুনরুত্থানের চেষ্টা করেন এবং যথারীতি ব্যর্থ হন।

সুলতান আব্দুল হামিদের এই প্রচেষ্টার ফলাফল হয় আরো খারাপ, এবার অটোমান শাষকগোষ্ঠির ভেতর থেকেই প্রতিরোধ তৈরি হয়। গঠিত হয় তরুন তুর্কী গুপ্ত সংগঠন, ইয়ং তুর্ক। যারা ১৯০৮ সালে সফল বিদ্রোহের মাধ্যমে সুলতানকে একপ্রকার পুতুলে পরিনত করে এবং অটোমান সাম্রাজ্যে সুলতানি শাষনের ইতি ঘটায়। এই গোষ্ঠটি সংসদ কার্যকর করে নিজেরা আড়ালে থেকে ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত সুলতানি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রন করে।

তরুন তুর্কীদের নিয়ন্ত্রনে দুর্বল অটোমান ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করলেও ততদিনে বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। দিকে দিকে বিদ্রোহ এবং রাশিয়া ও ইউরোপিয়ান শক্তির সাথে যুদ্ধ হচ্ছে এবং অটমানরা তাদের ভূখণ্ড হারাচ্ছে! এদিকে সাম্রাজ্যের প্রতিপক্ষ রূপে তুর্কী'র নিজস্ব জাতীয়তাবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সাম্রাজ্যের আনাতোলিয়াকে কেন্দ্র করে।

এমন সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। তখন অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বল শাসক জার্মানির সাথে সন্ধি চুক্তি করে এবং চুক্তির শর্ত হিসাবে হিটলারের বাহিনীকে সমর্থন করে অসময়ে যুদ্ধে যোগ দিয়ে পরাজিত হয়। যুদ্ধের মাঝেই অটোমানের আরব অঞ্চলগুলো বিদ্রোহ করে বসে। সবশেষে পরাজিত অটোমান তাদের সাম্রাজ্য সম্পুর্ণভাবে হারায়। অটোমান শাসিত অঞ্চল দখল করে নেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ বিজয়ী শক্তিগুলো।

তখন আধুনিক ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী তুর্কি জাগরণের নেতা মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে আরম্ভ হয় আরেক যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী শক্তির হাত থেকে মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধ। এই নতুন শক্তিটি ইস্তানবুল থেকে সরে গিয়ে আঙ্কারায় রাজধানী স্থাপন করে। ১৯১৯ থেকে শুরু করে ১৯২২ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সেই কঠিন যুদ্ধে জয়ী হয়ে শেষপর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র আনাতোলিয়া বাঁচাতে সক্ষম হয় আতাতুর্ক বাহিনী! পরবর্তীতে তিনি বর্তমান তুরস্কের জনক বা আতাতুর্ক হিসেবে স্বীকৃত হন।

তিন বছরের যুদ্ধ শেষে ১২২৩ সালের ২৯ অক্টোবর আধুনিক তুরস্কের জন্ম হয়।

আধুনিক তুরস্কের জনক আতাতুর্ক

তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত