ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

তবে কি নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্য?

তবে কি নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্য?

সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ তেল স্থাপনায় হামলার পর আরো একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যে। বলা বাহুল্য এই যুদ্ধটা হবে সুন্নি মুসলিমদের নেতৃত্বদানকারী সৌদি আরবের সঙ্গে শিয়াপন্থি ইরানের। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়াকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছর ধরেই ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি দেশ। কিন্তু আরামকো তেলক্ষেত্রে হামলাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন সমর বিশেষজ্ঞরা

।শনিবার সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো’র দুটি শোধনাগারে ড্রোন হামলা চালানো হয়। এই হামলার জন্য সরাসরি ইরানকে দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

রোববার এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প তেহরানকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আমরা জানি আসল অপরাধী কে এবং আমরা তাদের উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য তৈরি আছি। তবে আমরা কেবল এ ব্যাপরে সৌদি সরকারের বিবৃতির জন্য অপেক্ষা করছি।’

তবে শুরু থেকেই সৌদি তেল শোধনাগারে হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে ইরান সরকার। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা এ হামলা দায় স্বীকার করেছে। শুধু তাই নয়, তারা সৌদি তেল শোধনাগারে আরো হামলার হুমকিও দিয়েছে। এজন্য সৌদি তেল স্থাপনা থেকে সব বিদেশিকে সরে যেতে সতর্ক করে দিয়েছে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত শিয়াপন্থী হুথি বিদ্রোহীরা।

সোমবার টুইটারে দেওয়া এক পোস্টে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, হুথি বিদ্রোহীদের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারিয়ি বলেন, ইয়েমেনের ওপর সৌদি আরবের সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করা এবং অবরোধ তুলে নেওয়া উচিত। অন্যথায় সৌদি আরবের যে কোনো যায়গায় যে কোনও সময় হামলা চালানো হবে।

সৌদি আরবের এই তেলস্থাপনাগুলো গোটা বিশ্বের তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে খু্বই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলো যে কতটা নাজুক অবস্থায় আছে, এই হামলা সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছে।

ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যে বিমান হামলা চালাচ্ছে সৌদি আরব, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মদত আছে। সৌদি আরবের এসব বিমান সরবরাহ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। বহু দিন ধরে সৌদি আরব হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিপক্ষও যে পাল্টা হামলার ক্ষমতা রাখে, সৌদি তেল স্থাপনার ওপর এই আঘাত তারই প্রমাণ।

তবে এই ঘটনা সেই পুরোনো বিতর্ককে আবার উস্কে দিয়েছে- হুথি বিদ্রোহীদের ইরান কী পরিমাণ সামরিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এমনিতেই অস্থিতিশীল। সেখানে এই সর্বশেষ ঘটনা যেন পুরো অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। কিন্তু এই হামলা একই সঙ্গে ইরানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি এবং কৌশলের ব্যর্থতাও ফুটিয়ে তুলেছে।

সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার ব্যাপারে নানা দাবি এবং পাল্টা দাবির মধ্যে অনেক তথ্য এখনো অজানা।

হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের বিভিন্ন টার্গেটে আগেও ড্রোন এবং মিসাইল হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ড্রোন হামলা থেকে তারা খুব সীমিত সাফল্যই পেয়েছে। তবে এবারের যে হামলা সেটা এমন মাত্রার যে তার সঙ্গে আগেরগুলোর কোন তুলনাই চলে না।

যা দিয়ে হামলা হয়েছে

এই হামলার ব্যাপারে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। হামলায় কি 'আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল' (ইউএভি) ব্যবহার করা হয়েছে, নাকি নতুন কোন ধরনের মিসাইল। যদি মিসাইল ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সৌদি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেন তার সংকেত পেল না? আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে হামলার পেছনে ইরাকের কোন ইরানপন্থী মিলিশিয়া গোষ্ঠী ছিল, নাকি স্বয়ং ইরানই জড়িত?

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও কিন্তু কোন সময় নষ্ট না করে সরাসরি তেহরানের দিকে আঙ্গুল তুলছেন এই ঘটনার জন্য। ঘটনার ব্যাপারে কোন গোয়েন্দা তথ্যের জন্য পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেননি।

কয়েকঘন্টা পর অবশ্য মার্কিন সূত্রগুলো দাবি করতে থাকে মোট ১৭টি স্থানে এই ড্রোন হামলা হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসব হামলা হয়েছে উত্তর বা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। যুক্তরাষ্ট্র বলতে চাইছে, এই হামলা হয়েছে ইরান বা ইরাকের দিক থেকে, দক্ষিণের ইয়েমেন থেকে নয়।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা এই হামলা ব্যাপারে আরও বিস্তারিত তথ্য জানাবে। হামলায় ব্যবহৃত যেসব ড্রোন টার্গেট পর্যন্ত যেতে পারেনি, সেগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে।

কোন দিক থেকে হামলা

২০০৮ সালে জাতিসংঘের এক বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলেছিল, হুথি বিদ্রোহীদের কাসেফ-ওয়ান ড্রোনের সঙ্গে ইরানের আবাবিল-টি ড্রোনের ব্যাপক সাদৃশ্য আছে। জাতিসংঘের দলটি তাদের রিপোর্টে বলেছিল, ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি আছে, ইরান সেটি ভঙ্গ করেছে এবং হুথি বিদ্রোহীদের নানা রকম অস্ত্র সরবরাহ করেছে।

কাসেফ-ওয়ান কিংবা আবাবিল-টি ড্রোন বড়জোর ১০০ বা ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে পারে। ইয়েমেনের সীমান্ত থেকে খুরাইস তেল ক্ষেত্রের দূরত্ব প্রায় ৭৭০ কিলোমিটার। যেসব টার্গেটে হামলা হয়েছে, তার মধ্যে এই তেলক্ষেত্রই ইয়েমেনের সবচেয়ে কাছে।

কাজেই ইয়েমেনের দিক থেকে যদি এই হামলা হয়ে থাকে, তাহলে এবারের ড্রোনগুলো নিশ্চিতভাবেই একেবারে ভিন্ন ডিজাইনের, যেগুলো অনেক বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে এবং অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।

ইরান এবং সম্ভবত হুথি বিদ্রোহীদেরও হয়তো আরও দূরপাল্লার ড্রোন আছে। কিন্তু এর আগে ইয়েমেনের যুদ্ধেেএ ধরনের ড্রোনের ব্যবহার দেখা যায়নি।

আরেকটা জল্পনা হচ্ছে, হামলায় হয়তো ক্রুজ মিসাইলও ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। হয়তো ইরাক বা ইরান থেকে এই ক্ষেপনাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের দরকার হবে।

সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি কতটা

এই হামলাকে কেন্দ্র করে আর মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সম্ভবানা ব্যাপক আকারে ছড়েয় পড়েছে। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের কমন শত্রু ইরান। এর আগে পারস্য উপসাগরে বিভিন্ন জাহাজে হামলার জন্য তারা ইরানকেই দায়ী করছে। এবার তেলক্ষেত্রে হামলার পরও তারা তেহরানকেই দুষছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, সৌদি আরবের তেল স্থাপনার বিরুদ্ধে হুথি বিদ্রোহীরা যত হামলা চালিয়েছে তার সবকটিতে ইরানের হাতের ছাপ স্পষ্ট।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যাপারে তারা কী করবে বা কী করার ক্ষমতা রাখে?

এর উত্তর হচ্ছে, সম্ভবত খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই।

ইয়েমেনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এমনিতেই শক্তভাবে সৌদি আরবের পক্ষে। কিন্তু এই যুদ্ধের ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসে অতটা উৎসাহ নেই। বরং কংগ্রেস মনে করে থাকে, ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি আরব অনর্থক বিমান হামলা চালাচ্ছে, যা থেকে কোনো ফায়দা আসেছে না। বরং একটা গরীব দেশের ওপর এই হামলা এক বড় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

ট্রাম্প প্রশাসন যদিও সৌদি আরবের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন জোগাচ্ছে এবং ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কথা বলছে, বাস্তবে তেহরানের কাছে তারা কিন্তু নানা ধরণের বার্তা দিচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি যুদ্ধের ঝুঁকি নেবেন?

একদিকে মনে হচ্ছে ট্রাম্প যেন ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটা মুখোমুখি বৈঠকে বসতে চান। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তিনি ইরানকে নিঃশর্ত আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনকে বরখাস্ত করেছেন। জন বোল্টন হচ্ছেন সেরকম একজন কট্টরপন্থী, যিনি কিনা যে কোনো পন্থায় ইরানের রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদলের পক্ষে।

ইরান এবং হুথি বিদ্রোহীরা যুদ্ধে যে ধরণের কৌশল নিয়েছে, সেটা শক্তিমানের বিরুদ্ধে দুর্বলের লড়াইয়ের চিরাচরিত কৌশল। বেশিরভাগ কৌশল যেন রুশদের কাছ থেকে ধার করা। যেমন, যে কোন কিছু অস্বীকার করা, ছায়াযুদ্ধ, সাইবার হামলা এবং প্রপাগান্ডা যুদ্ধ।

তেহরান ভালো করেই জানে, ট্রাম্প মুখে যত কথাই বলুন, আসলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াতে চান না, বরং যুদ্ধ থেকে বের করে আনতে চান। এর ফলে ইরানই বরং এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছে।

কিন্তু যে কোনো মূহুর্তে কোনো একটা ভুলে একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকেও কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইরান, দু পক্ষের কেউই এখন যুদ্ধে জড়াতে চায় না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত