ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ল্যাটিন আমেরিকার শেষ ‘পিঙ্ক টাইড’ নেতার পতন

ল্যাটিন আমেরিকার শেষ ‘পিঙ্ক টাইড’ নেতার পতন

একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তীব্র বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে রোববার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দুই দশক আগে ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া গোলাপি স্রোতের (পিঙ্ক টাইড) শেষ বামপন্থী নেতার পতন ঘটলো। স্বাভাবিকভাবেই তার পদত্যাগে দক্ষিণ আমেরিকার বাম নেতাদের মন খারাপ। ইতিমধ্যে তাকে আশ্রয় দিতে চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে প্রতিবেশী দুই দেশ ব্রাজিল ও ভেনেজুয়েলা। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার বামপন্থী দেশের সরকারগুলো তার নিরাপত্তা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্সেলো ইবরার্ড এক টুইটে বলেন, তারা মোরালেসকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে প্রস্তুত আছে। তিনি আরো জানান, ইতিমধ্যে মোরোলেস সরকারের ২০ মন্ত্রী ইতিমধ্যে বলিভিয়ার লা পাজে শহরে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূতের বাসস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

শুধু ব্রাজিল নয়, মোরালেসকে আশ্রয় দিতে চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকায় মোরালেসের বামপন্থি বন্ধু ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ-ও।

রোববার ভেনেজুয়েলার সরকারি টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে মাদুরো বলেছেন, ‘আমরা আমাদের ভাই ইভো মোরালেসকে অবশ্যই দেখে রাখবো। তার নিরাপত্তার জন্য আমাদের সতর্কতাপূর্ণ সংহতি ঘোষণা করতে হবে।’

মোরালসের দীর্ঘদিনের ও অন্যতম সহযোগী কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডিয়াজ-কানেল তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বলেছেন: ‘বিশ্বকে অবশ্যই ইভোর জীবন ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হবে।’

তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন কলম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও।

তবে প্রেসিডেন্ট মোরালেস কোথায় আশ্রয় নিবেন সে বিষয়ে এখনও তিনি মুখ খুলেননি। এছাড়া পদত্যাগের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা সে বিষয়টিও অনিশ্চিত। যদিও বলিভিয়ার পুলিশ প্রধান বলেছেন মোরালেসকে গ্রেপ্তারের জন্য কোনো ওয়ারেন্ট জারি করা হয়নি।

পিঙ্ক টাইড কি?

একবিংশ শতাব্দীতে ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিলো রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাকে পিঙ্ক টাইড নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। স্পেনিস শব্দ ‘মারা রোসা’ থেকেই এসেছে এই টার্মটি যার ইংরেজি অর্থ পিঙ্ক টাইড বা গোলাপি স্রোত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা লড়াই শেষ হওয়ার পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে রেহাই পেতে যে নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলো ল্যাটিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দেশগুলো, সেটিই পিঙ্ক টাইড। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, চিলি, মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলায় পিঙ্ক টাইড মতাদর্শের সরকার গড়ে উঠে যাদের মূল আর্দশ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। স্বাভাবিকভাবেই এসব সরকারের বৈশিষ্ট্য ছিলো স্বৈরাচারী। ২০১০ দশকের মাঝামাঝিতে পিঙ্ক টাইডের প্রভাবে মেক্সিকোয় বামপন্থী প্রার্থীরা ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে জয় পান। পরে এই জয়ের ধারা ছড়িয়ে পড়ে পানামা, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়েতে।

এই পিঙ্ক টাইড বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ছিলেন ইভো মোরালেস। তিনি ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সে দেশের ইতিহাসে প্রথম আদিবাসী ও মূল জনগোষ্ঠীর একজন নেতা যিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। প্রসঙ্গত, বলিভিয়ার জনসংখ্যার ৬০ ভাগই আদিবাসী।

মোরালেস মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নীতি গ্রহণ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই তীব্র চাপের মুখে ছিলেন। এরপরও তিনি গত ১৪ বছর ধরে বলিভিয়া শাসন করে গেছেন। বেশ কিছু বৈপ্লবিক সংস্কারও করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তার সরকারের ধরণ ছিলো অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী। যার ফলে ধীরে ধীরে তার সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে উঠতে থাকে। তবে গত ২০ অক্টোবরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ে।

বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার পুননির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি সে দেশের সাধারণ মানুষও। ফলে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন মোরালেস। ওই নির্বাচনের দিন সরকার বিরোধীদের সঙ্গে মোরালেজের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে তিনজন নিহত এবং আরো তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিলো। ফলে এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে সে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ তার পদত্যাগের দাবিতে একটানা বিক্ষোভ করতে থাকে। এরপরও ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেন মোরালেস।

গত রোববার নির্বাচনে ‘সুস্পষ্ট কারচুপি’র প্রমাণ পাওয়ার অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করার আহ্বান জানায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। এরপরই রোববার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন মোরালেস। পর্যবেক্ষকদের এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়ে নতুন নির্বাচন আয়োজন করার ঘোষণা দিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।

রোববার টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে মোরালেস বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এ সময় তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি হামলা ও ভাঙচুর বন্ধ করার আহ্বান জানান।

বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট আলভারো গার্সিয়া লিনেরা এবং সিনেট প্রেসিডেন্ট আদ্রিয়ানা সালভাতিয়েরা এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন।

প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পর বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং আনন্দ মিছিল করতে থাকে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, উইকিপিডিয়া

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত