ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১২ মিনিট আগে
শিরোনাম

স্বেচ্ছা আইসোলেশনে যেভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবেন

স্বেচ্ছা আইসোলেশনে যেভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবেন
করোনা মহামারির মধ্যেও রোমান্টিক হওয়া যায়

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই আইসোলেশন বা সঙ্গীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা শুরু হয়। এছাড়া কোনো করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে এলেও বেশ কিছুদিন (কমপক্ষে ১৪ দিন) ধরেই আইসোলেশনে থাকতে হয়। এ অবস্থায় নিজেদের রোমান্টিক লাইফ শঙ্কিত অনেক যুগল। ইন্টারনেটে নানা রকম প্রশ্ন ও আশঙ্কা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ মনে করছেন, করোনা ঠেকাতে গিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনই হুমকির মুখে পড়ছে।

যুক্তরাজ্যে এই চিন্তাগুলো মূলত সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে সামনে আসতে শুরু করে যখন বারগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং পরস্পরের কাছ থেকে দুই মিটার দূরত্ব রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু মানসিক বিষয়টি কেমন হবে? মহামারির সময় আমাদের সম্পর্কগুলো সুখকর আর ভালো রাখতে কী করা উচিত?

লকডাউনের সময় দুটো জিনিস হতে পারে। প্রথমত: হয়তো আপনি লকডাউনের পুরো সময় সঙ্গীর সঙ্গে কাটানোর সুযোগ পেলেন। অথবা এক সাথে থাকার কোনও সুযোগই পেলেন না।

২৪শে মার্চ যখন যুক্তরাজ্য কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জোরদার করে তখন ইংল্যান্ডের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জেনি হ্যারিস বলেন, যেসব যুগলরা একসাথে বাস করেন না তাদের উচিত একসাথে বসবাস করতে শুরু করা, যাতে তারা তাদের সম্পর্কের দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে পারেন।

আপনি যদি আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে দূরে স্বেচ্ছায় আইসোলেশনে যান তাহলে তার অভাব অনুভূত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

আইসোলেশনের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সরাসরি সংস্পর্শ থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়।

ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার অধ্যাপক করি ফ্লয়েড এই বিষয়টিকে বলেছেন ‘স্কিন হাঙ্গার’বা শারীরিক সংস্পর্শের অভাব। একাকীত্ব ছাড়াও এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় যে মানুষ কেন কারো সাথে কথা বলে বা ভিডিও কলে দেখেও কেন সরাসরি কাছে পাওয়ার মতো আনন্দ দেয় না।

প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে তাদের পাঠানো কোনও কিছু সহায়ক হতে পারে। ওয়েইনি স্টেট ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথরিন ম্যাগুয়ের বলেন, এক্ষেত্রে পুরনো দিনের মতো হাতে লেখা চিঠি খুব ভাল কাজ করতে পারে।

তিনি বলেন, প্রিয়জনের স্পর্শে আসা কোনও কিছু স্পর্শ করতেও ভাল লাগে। যেমন: তার লেখা চিঠিটি, আপনি তাদের হাতের লেখা দেখতে পারবেন, তারা যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকে তাহলে আপনি তার গন্ধ পাবেন, সব কিছু মিলিয়ে এটি পরিস্থিতিকে জীবন্ত করে তোলে।’

কিন্তু তাই বলে যুগল হিসেবে একসাথে থাকা কিংবা বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাড়াহুড়ো করে নেয়া উচিত নয়।

যেসব যুগলরা একে অপরের থেকে দূরে থেকে সম্পর্ক বজায় রাখেন তাদের উপর করা গবেষণায় দেখা যায়, আলাদা বসবাসের বেশ কিছু সুবিধাও রয়েছে। যেমন, বন্ধু কিংবা পরিবারের থেকে দূরে থাকা মানেই খারাপ কিছু নয়।

বাস্তব ক্ষেত্রে এক সাথে আইসোলেশনে গেলে সেখানেও কিছু চাপ তৈরি হতে পারে। ম্যাগুয়ের মনে করেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের সীমা পার করে ফেলছি- অনেক কিছুই অস্পষ্ট।’

কখনো কখনো আলাদা থাকাই ভালো

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সঙ্গীকে মিস করাটা জরুরি। শীতকালীন ছুটির সময় যেসব শিক্ষার্থীরা বলে যে তারা তাদের সঙ্গীকে মিস করেছে, পরবর্তীতে দেখা যায় যখন তারা আবার একত্র হয়, তখন তাদের ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

সালস্টেইন পার্সেল বলেন, অনেকেই মনে করেন যে সম্পর্ক তখনই তৈরি হয় যখন সঙ্গীরা এক সাথে থাকে এবং সরাসরি দেখা করার সময় যখন ‘টান’ অনুভব করে। তবে এটা সত্যি নয়।

তিনি বলেন, একে অন্যের থেকে দূরে থাকাটা যুগলদের জন্য ইতিবাচক হতে পারে এবং এটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।

এ সম্পর্কে সালস্টেইন পার্সেল বলেন, যেসব যুগলরা পরস্পর থেকে দূরে থাকেন তারা একসাথে থাকার সময়টাকে বিশেষভাবে ‘কাপল টাইম’ হিসেবে উদযাপন করে এবং যখন আলাদা থাকে তখন ‘ব্যক্তিগত সময়’ বা ‘ইনডিভিজ্যুয়াল টাইম’ হিসেবে কাটায়।

তার ভাষায়, ‘আমার মনে হয় দূরে থেকেও সফল সম্পর্কের চাবিকাঠি হচ্ছে, এই ধরনের সময়ের বিভাজন খুব কঠোর হওয়া উচিত নয়।’

পুর্নমিলন কেন খারাপ হতে পারে

আইসোলেশনে যাওয়া যুগলদের জন্য অনেক সময় ধরে আলাদা থাকাটাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটাও সমানভাবে কঠিন।

সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবার বা দূরে থাকা যুগলদের উপর চালানো গবেষণায় দেখা যায়, একসাথে হওয়া বা পুর্নমিলনীর পর প্রথম ছয় মাসের মধ্যে হয় সম্পর্ক টিকে যায় নয়তো ভেঙ্গে যায়।

বিচ্ছেদের পর পুনর্মিলন কিভাবে কাজ করে সেটা ভালভাবে বোঝা যায় সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের দিকে খেয়াল করলে। কারণ তারা যখন আলাদা থাকে তখন সামরিক কর্মকর্তা আর তার পরিবার নিজেদের মতো আলাদা রুটিন অনুসরণ করে চলে।

একজন সামরিক কর্মকর্তাকে হয়তো সকাল সকাল উঠতে হয় এবং খাবারের সময়গুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। এই কড়কড়ি তাদের পরিবারের সাথে নাও মিলতে পারে। ফলে দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে আসলে এ নিয়ে সঙ্গীর সঙ্গে শুরু হয় অশান্তি, ঝড় উঠতে পারে পরিবারে।

তবে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের লিয়ান নবলচ জনসন বলেন, ‘ঝড় উঠা মানেই কিন্তু এটা নয় যে তা দূর করা যাবে না। এটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নয়, বরং ওই মুহূর্তে এটি সমস্যা। আমরা একজন আরেকজনের সাথে পথ চলি, তাই আমাদেরকে শিখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে ঝড় আসতে পারে এবং সেটা কষ্টদায়কও বটে।’

আরেকটি বিষয় হচ্ছে অনেকেই মনে করে থাকেন যে, তার সঙ্গীটি হয়তো আর আগের মতো নেই।

ম্যাগুয়ের বলেন, ‘এটা মনে করা বোকামি যে, দীর্ঘদিন পরও আপনার সঙ্গীটি আগের মতোই থাকবে। বরং আপনার উচিত তাকে আবার নতুন করে জানা। কারণ সময়ের সাথে তার ভিতরে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে সেগুলো হয়তো হঠাৎ করেই জানা যাবে না।’

সঙ্গীর সাথে আইসোলেশনে যাওয়াটাও কঠিন হতে পারে

কোয়ারেন্টিন সবার জন্যই কঠিন। কোভিড-১৯ মহামারির পর লন্ডনের কিংস কলেজের সামান্থা ব্রুক কোয়ারেন্টিনের প্রভাব বিষয়ে তার মানসিক গবেষণা আবার পুর্নমূল্যায়ন করেছেন।

বেশিরভাগ গবেষণাতেই বলা হয়েছে, কোয়ারেন্টিনে বিরক্তি, হতাশা এবং ক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, এর কারণে দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। আইসোলেশনের সময়ে অনুযায়ী পোস্ট-ট্রমাটিক সিম্পটম বা উপসর্গও দেখা দিতে পারে।

তবে সবার ক্ষেত্রে একই ফলাফল হবে কিনা সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরিষ্কারভাবেই এই সময়টা যুগলদের জন্য মানসিক চাপের। ব্রুক বলেন, যদিও কর্তৃপক্ষ আমাদের বলছে যে, মানুষের বৃহৎ স্বার্থেই আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তবুও এর কারণে কিছু মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে।

যাদের পারিবারিক সম্পর্ক ভাল নয়, নির্যাতনের মতো ঘটনা হয়ে থাকে, তাদের জন্য বাড়ির গণ্ডির বাইরে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে সেটা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এ সম্পর্কে ইলিনয়ের অরোরা ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক রেনে ফ্র্যানিউক বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি যে, লকডাউনের কারণে বেকারত্ব এবং অনিশ্চয়তার কারণে পারিবারিক নির্যাতনের মাত্রা বাড়বে। সামাজিক সহায়তার ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় সেটি নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। যদি অন্য কোথাও থাকার দরকার হয় তাহলে আমরা বন্ধুদের বাড়িতেও যেতে পারবো না।’

হয়তো বা এ কারণেই বিভিন্ন দেশে লকডাউনের সময় পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গেছে। স্পেনে পারিবারিক সহিংসতার হার ৫ গুন এবং ফ্রান্সে ৩ গুন বেড়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনেও অনেকটা একই রকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে।

কোয়ারেন্টিনে এভাবে একসঙ্গে থাকার কোনও মানে আছে কি?

পুনর্মিলনীর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে

আমাদের মধ্যে যাদের পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, তাদেরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা কঠিন হবে। রোমান্স বাদ রাখলেও, আমাদের অনেকেই হয়তো পরিবারের সাথে দীর্ঘ সময় কাটানো কিংবা বন্ধুদের সাথে কম সময় কাটানোতে অভ্যস্ত হতে পারবে না।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশগুলোতে নানা ধরণের অনিশ্চয়তার কারণে কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে সে বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তাই এটা বোঝাও মুশকিল যে কবে এবং কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। সামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে অন্তত একটা নির্দিষ্ট সময় সীমা থাকে।

সালস্টেইন পার্সেল পরামর্শ দেন, এই সময়ে আসলে আলাদা থাকার সময়টার নানা বিষয়কে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে।

যারা দূরে থেকে সম্পর্কে রয়েছেন তাদের উচিত যেকোন ধরণের সংঘর্ষ এড়িয়ে চলা।

সালস্টেইন পার্সেল বলেন, যুগলরা যখন সরাসরি দেখা করে তখন তারা যে কোন ধরণের সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে কারণ তারা ওই সময়টাকে একসাথে ভালভাবে উপভোগ করতে চায়। আলাদা থাকার সময় ঝগড়া করা এবং একসাথে থাকার সময় মতবিরোধের মতো ঘটনাগুলো এক ধরণের চক্র তৈরি করে যা সম্পর্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়।

ম্যাগুয়ের বলেন, একমাত্র সমস্যা যদি হয় একে অন্যের থেকে দূরে থাকা- তাহলে সেটি আসলে ভাল লক্ষণ। একইভাবে যেসব যুগলরা এক সাথে আইসোলেশনে রয়েছেন তাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোয়ারেন্টিনের মানসিক চাপ একসময় দূর হয়ে যাবে।

তাই করোনা ঠেকাতে সব যুগলদেরই এই সাময়িক কষ্ট মেনে নিতে হবে। এছাড়া আর কোনও উপায়ও তো নাই। তাই সঙ্গী দূরে বা কাছে যেখানেই থাকুন না কেন, কোয়ারেন্টিনের এই দীর্ঘ ছুটি উপভোগ করুন। সঙ্গী দূরে থাকলে তাকে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নানা পরিকল্পনা তৈরিতে নিজেকে ব্যস্ত থাকুন। েএকদিন না একদিন তো কাটবেই এই অমানিশা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত