ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২০, ২৩:৫৯

চেরি ফুলের দেশে

৪. টোকিও

জাপানের ফরেন প্রেস সেন্টর ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটির জন্য অর্থ যোগায় জাপান সরকার এবং সে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কযুক্ত। বিশাল ভবনের ৬ তলায় অফিস। ভবনটির নাম নিপ্পন প্রেস সেন্টার। এ ভবনের নিচে ৪টি তলা আছে যার ওপরে আরও ১৬ তলা। সুন্দর ডিজাইনের ভবনটিতেই রয়েছে জাপানের জাতীয় প্রেস ক্লাব। ফরেন প্রেস সেন্টারের একজন প্রেসিডেন্ট এবং একজন মহাপরিচালক রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত। তিনি বেতনভোগী নন। আর মহাপরিচালক, পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা, কর্মচারী বেতনভোগী। মহাপরিচলাক ফুমিও কিতামুরা সংবাদপত্রের লোক। এফপিসি চালুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিদিন টোকিওতে আসা বিদেশী সাংবাদিকদের সাহায্য-সহযোগিতা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করা। এছাড়া বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সাংবাদিকদের সফর বিনিময়। যে কোনো বিদেশী সাংবাদিক এফপিসিতে গেলে জাপানের যে কোন তথ্য সম্বলিত পুস্তকাদি পাবেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাঁকে গাইড করবেন। এফপিসি’তে রয়েছে বড় একটি লাইব্রেরি, কেন্টিন, কনফারেন্স রুম, সাংবাদিকদের ব্যবহারের জন্য টাইপ রাইটার, ফ্যাক্স মেশিন ইত্যাদি।

হোটেল থেকে এফপিসি’তে যেয়ে পৌঁছুলে মহাপরিচালক কিতামুরা আমাদের স্বাগত জানান। একে একে স্টাফ, কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। কর্মসূচি অনুযায়ী প্রথমেই ছিল ওরিয়েন্টেশন কোর্স। কিতামুরা আমাদের এ কোর্সের প্রশিক্ষক। কনফারেন্স রুমে আমরা সবাই আসন গ্রহণের পর পরিচয় পর্ব। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকান বিভিন্ন দেশের ১০ জন সাংবাদিক আমরা হাজির হই। শাহজাহান সরদার (দৈনিক ইত্তেফাক-বাংলাদেশ), সুনীল জৈন (ভারত-ইন্ডিয়া টুডে), জ্ঞান বাহাদুর রায় (নেপাল-দি রাইজিং সান), ফরাজ হাশমী (পাকিস্তানি-ডন), রশান ভিজেয়েতংগে (শ্রীলংকা-দি আইসল্যান্ড), ফনডং থমাস বেকং (ক্যামেরুন-দি ক্যামেরুন ট্রিবিউন), উদয়ংগ ওদুও (কেনিয়া-দি স্ট্যান্ডার্ড), মিসেস পলা মারিয়া ফ্রে (দক্ষিণ আফ্রিকা-দি স্টার), জন দানিয়েল ব্রো (উরু-তানজানিয়া) এবং মিস ইউনিস মেনিয়ামবা (জিম্বাবু-দি হেরাল্ড)। ওরিয়েন্টেশন কোর্সে আমাদের কোর্সের কর্মসূচি সম্পর্কে আলোকপাতসহ জাপানি সমাজ, জাপানের সংবাদপত্র, সাংবাদিক এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে কথা হয়।

১৯৬০ সালেও জাপান ছিল উন্নয়শীল দেশ। অথচ আজ বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশ। অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়েছে জাপানবাসী। জাপান উন্নয়নের জন্য ১৯৬৪ সালেও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে। আর আজ সাহায্যদাতা দেশের মধ্যে জাপানের স্থান এক নম্বরে। বাংলাদেশেও এক নম্বর সাহায্যদাতা দেশ। কিতামুরা বললেন, জাপানি অর্থনীতিতে বিপ্লব আর দেশটি উন্নতির শিখরে পৌঁছুলেও জাপানিদের মনমানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। তারা একই অবস্থানে আছেন। জাপানিরা যে কত অর্থশালী, নিজেদের মাথাপিছু আয় কত, এটা অনেকেই ভাবে না। কাজ আর কাজের মধ্যে ডুবে থাকে সারাদিন। কাজই যেন তাঁদের জীবন। যে কারণে সামাজিক সমস্যা আজ প্রকটতর। সমাজ বিজ্ঞানীরা জাপানি নাগরিকদের অফিসমুখী থেকে ঘরমুখী করার পদ্ধতি নিয়ে রীতিমত গবেষণা করছে। কিতামুরা জানালেন, জাপানে ৫৩০ জন বিদেশী সাংবাদিক (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত) কর্মরত আছেন। এছাড়া প্রতিদিনই বিদেশী সাংবাদিকরা টোকিওতে আসছেন। জাপানে কর্মরতদের মধ্যে ৩’শ হচ্ছেন আমেরিকান বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের, ১৬০জন ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমের আর বাকীরা অন্যান্য দেশের (তখনকার হিসেবে)। টোকিওতে বাড়ি ভাড়া অস্বাভাবিক রকম বেশি। যে কারণে উন্নয়নশীল কোনো দেশের প্রতিনিধি রাখা অসম্ভব ব্যাপার। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ভারতের হিন্দু পত্রিকার একজন প্রতিনিধি তখন জাপানে ছিলেন। টোকিওতে সাধারণ একটি এ্যাপার্টমেন্টের প্রতি স্কয়ার মিটারের মাসিক ভাড়া কমপক্ষে ১০ হাজার ইয়েন (১৯৯২ সালের হিসাবে)। বর্তমানে এর পরিমাণ দিগুণ।

টোকিওতে ১২৪টি বিভিন্ন ধরনের সংবাদপত্র রয়েছে। এর মধ্যে ইউমুরি শিম্বুন ও আশাই শিম্বুন বেশি চলে। দুটি পত্রিকারই দৈনিক ৪টি করে সংস্করণ প্রকাশ হয়। আর বিকালে ইংরেজি সংস্করণ। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য সংবাদপত্র বের হয়। জাপানিরা বিশ্বের সেরা পড়ুয়া জাতি হিসেবে পরিচিত। বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে, স্টেশনে, হোটেলে, রেস্টুরেন্টে সর্বত্রই তাদের পড়তে দেখা যায়। সবার ব্যাগেই বই অথবা সংবাদপত্র থাকে। বাসের জন্য, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া তাদের অভ্যাস। একজন আরেকজনের সাথে গল্প-গুজবে না মেতে পড়াটা সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাপানের প্রতিটি নাগরিক প্রতিদিন সাড়ে তিনটি করে সংবাদপত্র পাঠ করে। ওরিয়েন্টেশন কোর্সে আমাদের জাপানি জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ওভারসীস প্রেস ক্লাবের দু’টি পরিচয়পত্র (অতিথি) দেয়া হয়। বিশ্বের ব্যয়বহুল শহর গুলোর মধ্যে টোকিও একটা। আমাদের যাতে ব্যায় সংকোচন হয় সেজন্যই প্রেসক্লাবের কার্ড দেয়া হয়। কেননা আমাদের মতই বাইরে থেকে প্রেসক্লাবে খাবারের মূল্য বেশ কম।

ওরিয়েন্টেশন কোর্সের পর দুপুরের খাবারের বিরতি দেয়া হলে গাইড প্রেস সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রথম তলায় খাবারের দোকানে নিয়ে গেলেন আমাদের সবাইকে। প্রতিটি হোটেলে আমাদের দেশের স্টেশনারী দোকানের মত শোকেসের ভিতর খাবারের ম্যানু সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আর আছে খাবারের ছবিসহ ম্যানু বাই। এশিয়ান এবং আফ্রিকান মোটামুটি খাবারের স্টাইল একই। কিন্তু জাপানি খাবারে আমরা অভ্যস্ত নই। ঘুরতে ঘুরতে মন মত খাবার না পেয়ে নেপালের রাই প্রস্তাব দিল চাইনিজ খাবারের। আমরা সবাই রাজী হলাম। খুঁজে বের করলাম চাইনিজ হোটেল। কিন্তু আমাদের দেশের মত চাইনিজ নয়। অনেকটা জাপানি খাবারের মতই। অরুচি হলেও খেয়ে নিলাম। আবার এফপিসি। দু’টায় আবার ওরিয়েন্টেশন। সময় হাতে আছে কিছু। আমার চায়ের তৃষ্ণা পেল। দেশে দিনে ৬/৭ কাপ চায়ের অভ্যাস। শ্রীলংকার শান আর নেপালের রাইের সাথে ইতিমধ্যেই আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাদেরকে বললাম চল চায়ের খোঁজ করি। তারাও রাজী হল। কিন্তু কোথায় চা পাব? এখানে রাস্তায় রাস্তায় ব্রেন্ডিং মেশিনে কোকাকোলা, সিগারেট, বিয়ার ইত্যাদি রাখা। প্রতিটি দ্রব্যের উপর মূল্য লিখা। মেশিনে এ পরিমাণ অর্থ ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে চাপ দিলেই কোকাকোলা, সিগারেট, জুস বের হয়ে আসে। ঠাণ্ডার মধ্যেও সবাই ঠাণ্ডা খায়। ঠাণ্ডা কফি তাদের বেশি পছন্দ। চা খেতে খুব কম লোককেই দেখা যায়। আমি বললাম চল প্রেস ক্লাবে। একই ভবনের ৪র্থ তলায়। আমরা রওনা হলাম। পরে পাকিস্তানের হাশমীও আমাদের সাথে শরিক হয়। পুরো তলা প্রেস ক্লাব। বিরাট কনফারেন্স রুম। এখানে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গসহ বিদেশী অতিথীরা এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এক পাশে রয়েছে একটি কেন্টিন, অন্য পার্শ্বে বার এবং স্ন্যাকস। বিভিন্ন পত্রিকার ফাইল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। টেলিফোন, ফ্যাক্স এবং টেলিপ্রিন্টার আছে অনেক। কারও টেলিফোন বা অতিথি এলে মাইকে নাম ডাকা হয়। বিরাট আকারের একটা টিভি। লাউঞ্জে তেমন সাংবাদিক নেই। খাবারের সময় বেশির ভাগই কেন্টিনে। আমরা লাউঞ্জে বসলাম। এক বেয়ারা ডেকে আমাদের পরিচয় দিয়ে চা দিতে বলি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এল। চা পান করে এফপিসিতে আবার ওরিয়েন্টেশন কোর্স। আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল বিকালে এফপিসি আমাদের রিসিপশন দেবে।

এ রিসিপশনে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক, জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। রিসিপশনে সফররত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে একজনকে বক্তৃতা দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ একজনকে ঠিক করে রাখতে বলেছিলেন। আমরা বসে ঠিক করলা কেনিয়ার উদয়ংগু বলবে। সে নিজে থেকেই ইচ্ছ প্রকাশ করেছিল। বেচারা সকালে এসেই খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিল। বিমান বন্দরে তাঁকে নাকি অনেক হেনস্থা করা হয়। বক্তৃতার সময় সে হেনস্তার কথা নির্দ্বিদায় বলে ফেলেছিল। লম্বা গড়নের অস্বাভাবিক কাল উদয়ংগু লাল রংয়ের স্যুাট পরে সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

রিসিপশনে আমার সাথে পরিচয় হল টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলার রাশেদ চৌধুরীর সাথে। পার্টিতে তিনি এক জাপানির সাথে কথা বলেছিলেন। আমার কানে হঠাৎ আওয়াজ এল “আই লাভ জাপান, ডোন্ট লাইক মাই কান্ট্রি বাংলাদেশ”। তাঁর একথা শুনে আমি পাশে তাকাই। এমন সময় এফপিসি’র একজন কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। টুকটাক তাঁর সাথে কথা হল। কথায় বুঝলাম তাঁর তিন বৎসর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবুও তিনি আছেন। পরে শুনেছি তাকে বার বার বদলীর চেষ্টা সত্ত্বেও পারা যাচ্ছে না। তদ্বিরের জোরে তিনি থেকে যাচ্ছেন।

তাঁর সাথে আমার কথা বেশি জমেনি। তিনি জাপানের প্রশংসায়ই ব্যস্ত ছিলেন। বার বার বলছিলেন জাপানি খাদ্য তাঁর কাছে প্রিয়। পার্টিতেই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা স্ব-স্ব দেশের আগত সাংবাদিকদের দূতাবাসে আমন্ত্রণ জানিয়ে যান। মধাহ্ন ভোজ কিংবা নৈশ ভোজেরও ব্যবস্থা করেন তাঁদের জন্যে। আমাদের কূটনীতিক কিন্তু কিছু বললেন না। তিনি নীরবে চলে গেলেন। জাপান থাকাকালীন সময়ে পরে আমি একদিন তাঁকে টেলিফোন করেছিলাম ইত্তেফাকে প্রকাশ হওয়া ব্যাংককের নির্বাচন সম্পর্কে আমার পাঠানো নিউজটা হোটেলে ফ্যাক্স করার জন্য। তিনি আমাকে বলেছিলেন ঢাকায় আমার অফিসে টেলিফোন করতে। অফিস থেকে যেন আমাকে পাঠায়। তারা পাঠাতে পারবে না। ভদ্রলোকের সঙ্গে পরে আর আমার যোগাযোগ হয়নি। তিনিও করেননি। এই রাশেদ চৌধুরীই বঙ্গবন্ধু হত্যার পলাতক আসামী। জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকুরী পায়। এখনও তিনি পলাতক। রিসিপশনেই পরিচয় হল আশাই শিম্বুন, ইউমুরি শিম্বুন, জিজি প্রেস ও কিওডো নিউজ এজেন্সীর বেশ কিছু সাংবাদিকদের সাথে। এসব সাংবাদিক কেউ কেউ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সফরেও এসেছেন। তাদের একজন বিএসএস-এর বর্তমান এমডি জগলুল আলম চৌধুরীর কথা জিজ্ঞেস করলেন। তারা দু’জন দিল্লী ছিলেন এক সময়। জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা হল। তাঁরা সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কয়েকজন সরাসরি প্রশ্ন করলেন বাংলাদেশে “গণতন্ত্র কেমন চলছে।”

পার্টি শেষ হলে রাত ৯টায়। এফপিসি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে দেখি রাজধানী টোকিও আমার দিনের বেলায় দেখা টোকিও নয়। আলোকজ্জ্বল টোকিও। ভবনে ভবনে আলোর বন্যা বইছে। আলো দিয়ে যে কত রকম ডিজাইন করা যায় তা টোকিওর রাত না দেখলে জানা সম্ভব হত না। আমাদের দেশে বড় বড় বিয়েতে রকমারী আলোর ডিজাইনের চাইতেও প্রতিটি ভবনের আলোকসজ্জা বেশি। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করি রাতেওÑপ্রতিটি অফিসেই কাজ হচ্ছে। বিশাল বিশাল ভবনের কাঁচের জানালা দিয়ে রাতের আলোতে দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষ অফিসে একাগ্রচিত্তে কাজ করছেন। তিন দিনের একটানা ভ্রমনে বেশ ক্লান্ত আমি। তাই হোটেলে এসে কাপড় পাল্টিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ি। কিন্তু এত ক্লান্তির মধ্যেও ঘুম আসা দূরের কথাÑরাজ্যের চিন্তা মাথায় আসলো। রুমেই টেলিভিশন, ভিসিআর। ঘুম না আসায় টেলিভিশন দেখতে চেষ্টা করি। টেলিভিশনের ৯টি চ্যানেল। শুয়ে শুয়ে রিমোট কন্ট্রোলের নব ঘুরাতে থাকি। কিন্তু না কিছুই ভাল্লাগছে না। অগত্যা বিছানায় শুয়ে বই পড়তে থাকি। রাত তখন একটা। কিন্তু টোকিও নগরীর কর্মব্যস্ততা কমছিল না। জানালা দিয়ে দেখা যায় নারী-পুরুষরা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছেন। কিংবা অফিসে তখনও কাজ করছেন।

জাপানের রাজধানী টোকিও স্বপ্নের শহর। বিশ্বের ব্যয়বহুল শহরগুলোর অন্যতম। টোকিওতে প্রথম রাত কাটল আমার না ঘুমিয়ে। নতুন স্থান। বাড়ির চিন্তা। সকালে উঠেই দেখি কক্ষের দরজায় সংবাদপত্র। জাপান টাইমস। প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র পড়া অভ্যাস। আমি তাড়াতাড়ি করে কাগজটি হাতে তুলে নিলাম। সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট করে লীড নিউজ সে দেশের তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের (এল ডি পি) শীর্ষস্থানীয় নেতা শিন কেনেমারুর অর্থ কেলেংকারি নিয়ে। শিন কেনেমারু এলডিপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। তৎকালীন জাপানী প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহচর। তিনি একজন সংসদ সদস্য। নির্বাচনের সময় এক বড় কোম্পানির কাছ থেকে চাঁদা হিসাবে বিপুল পরিমান অর্থ নিয়েছিলেন। এত পরিমাণ অর্থ জাপানি আইনে চাঁদা নেয়া যায় না। জানাজানি হয়ে গেলে এ নিয়ে সংবাদপত্রে খবর বের হয় এবং দেশে হৈ-চৈ পড়ে যায়। আগের ঘটনা কিছুই জানি না। নিউজটি পড়ে শুধু ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি বুঝলাম। পুরো পত্রিকা পড়ে কোথাও বাংলাদেশ দূরের কথা উপমহাদেশের খবর পাওয়া গেল না। তবে শ্রীলংকার তামিল গেরিলাদের কার্যক্রম নিয়ে ছোট খবর ছিল ভিতরের পাতায়। এক মাস টোকিও অবস্থানকালীন সময়ে কোনদিনই বাংলাদেশের খবর কোন পত্রিকায় ছাপা হয়নি। জাপান টাইমস পত্রিকায় একদিন ঢাকায় ভিক্ষুকদের মিছিলের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল ভিতরের পাতায়। ছবিটি রয়টার পরিবেশিত।

সংবাদপত্র পাঠ করে নাস্তা খাওয়ার জন্য তৈরী হলাম। বাইরে বের হয়ে এ ধরনের কোনো হোটেল আশে পাশে দেখতে না পেয়ে রুমেই ফিরে আসি। মনে করলাম একা একা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। পরে সবাই মিলে খুঁজে বের করা যাবে। রুমে দেশ থেকে নিয়ে আসা চিড়া, গুড়, চিনি এবং বিস্কিট ছিল। চিড়া ভিজিয়ে চিনি দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। রুমেই হিটার আছে। চা করে নিতেও কোনো অসুবিধা নেই। লবিতে এসে দেখি অন্যরা নিচে এসেছে। সকাল ১০টা থেকে ক্লাস শুরু। জাপানি জনগণ এবং জাপানি সংস্কৃতির ওপর এক ঘন্টার লেকচার দিলেন মি. সুজু ওকোয়ামা। তিনি জাপান বৈদেশিক উন্নয়ন সম্পর্কিত সমিতিসমূহের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ভদ্রলোক হাল্কা পাতলা গড়নের। কিন্তু খুবই রসিক। তিনি জাপানি বেশ কিছু শব্দ আমাকে শিখিয়ে দিলেন যা পরবর্তীকালে খুব উপকারে এসেছে। মি. সুজু বললেন জাপানি সমাজের এখন মূল সমস্যা হচ্ছে বিশ্রাম। তারা দিন রাত পরিশ্রম করে। কাজ করে। রাতেও অফিসে থাকে। যাতে কেউ কেউ বিশ্রামের সময় পায় না। পুরুষরা অফিসে কাজের মধ্যে এত বেশি ডুবে থাকে যে পরিবার পরিজনের খবর পর্যন্ত রাখার সময় হয় না। যাতে পরিবার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। স্ত্রী-সন্তানরা স্বামী-পিতার ভালোবাসা, আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত। গভীর রাত পর্যন্ত মেয়েরা অফিসে কাজ করে। টোকিওতে একলা চলায় কোনো ভয় নেই। কোনো মহিলা যত গভীর রাতেই চলাফেরা করুক না কেন বিপদের সম্ভাবনা নেই। আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা খুবই ভালো। টোকিও-র রাস্তায় কোনো পুলিশ টহল দেয় না। অপরাধ নেই। তাই পুলিশের প্রয়োজন হয় না। তবে গোটা শহর পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে।

বিনয়ী জাতি হিসেবে জাপানিরা বিশ্বের কাছে পরিচিত। মাথা নিচু করে তারা তাঁদের বিনয় দেখায়। কোনো জাপানি নাগরিক যখন কোনো বিদেশীকে স্বাগত বা বিদায় সম্ভাষণ জানায় তখন মাথা নিচু করে দেয়। এটা তাদের বিনয়ের নজির। অথচ পশ্চিমা যে কোনো উন্নত দেশে মাথা উঁচু করে হ্যান্ডশেক করে। আর জাপানিরা মাথা নিচু করে দ্ইু হাত জোড় করে প্রণামের মত করে। মি. সুজু বললেন, অবস্থা এখন বেশ বদলাচ্ছে। পশ্চিমা সমাজের বাতাসে জাপানি সমাজও এখন হাবুডুবু খাচ্ছে। বিনয় এবং ভদ্রতা উঠে যাচ্ছে। যুবকরা এখন মাথা উঁচু করে হ্যান্ডশেক করে। আর মুরুব্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। রেলে, বাসে বা কোনো হোটেলে কোনো মুরুব্বী দেখলে আগে যুবকরা যেভাবে আসন ছেড়ে দিয়ে বসতে দিত আজকাল তা যেন কমে আসছে। এতদসত্ত্বেও আজ পর্যন্ত জাপানিরা বিশ্বের সবচাইতে ভদ্র এবং বিনয়ী জাতি হিসাবে পরিচিত। যে কোনো বিদেশী যে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে। জাপান অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে অবস্থান করলেও পারিবারিক সুখ কম। সবাই কাজে ব্যস্ত থাকে বলে এ অবস্থা হয়েছে। কথায় আছে যে জাপানি স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের মাত্র হানিমুনের দিন গুলোতে সময় দিয়ে থাকে। যে কোনো জাপানি দম্পতি বিয়ের পরই চলে যাবেন বিদেশে হানিমুন করতে। এসে আবার কাজ। আর যেন তেমন সময় আসে না। যে কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ব্যাপক। অত্যন্ত ব্যয়বহুল জাপানে অর্থের পিচনে ঘুরতে যেয়ে স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারের সবাই চাকরি করনে। এমনকি যে ছেলে বা মেয়ে স্কুলে পড়ে সেও পার্টটাইম চাকরি করে থাকে। এতে করে পরিবারের বন্ধন শিথিল হচ্ছে। অরেব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা স্বামীদের চাইতে বেশি বেতন পায়। এতে ব্যক্তিত্বের সংঘাত হচ্ছে। আর সব মিলিয়ে পরিবার যাচ্ছে ভেঙ্গে। স্বামী-স্ত্রী’র কলহের ঘটনা ঘটছে অহরহ। পরিণতিতে দু’জনের অত্যাধিক মদ্যপানে আসক্তি, বার-ক্লাবে আলাদা আলাদাভাবে সময় কাটানো নিয়মে পরিণত হয়েছে। টোকিও-র হোটেলে রেস্তোরায় গভীর রাত পর্যন্ত ঘরের বউরা আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। (বউয়ের জাপানি শব্দ হচ্ছে অকুসান)। স্বামীর বাইরে থাকাই এর অন্যতম কারণ। ঘরে ফিরে আকার অশান্তি। একথা চালু আছে যে, জাপানিরা বউ পিটানোর তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে। অথচ জাপানিদের কোনো অভাব নেই। এত কাজ না করলেও পারে। তাদের সঞ্চয় অনেক, অনেক। মি. সুজুর মতে জাপানিরা যে কত বড়লোক, কত টাকা তাদের মাথাপিছু আয় কাজ করতে করতে তারা তা নিজেরাও ভুলে যায়। যাতে ভবিষ্যতে বিপত্তি না আসে সেজন্য আরও বেশি কাজ করতে চায়। কিন্তু এত বেশি কাজ তাদেরকে একঘেরে করে ফেলেছে।

জাপানি ভাষায় সবচাইতে বেশি অক্ষর রয়েছে। তবুও এ ভাষা বলতে পারলে খুবই সহজ। পশ্চিমা অসংখ্য যুবক জাপানে এসে ভাষা শিখে বেশ ভাল আয় করছে। জাপানিরা তাদের নিজ ভাষার প্রতি বেশি আগ্রহী। ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা খুব কম জাপানিরা জানেন। মি. সুজু আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু জাপানি শব্দ শিখিয়ে দিলেন। আরিগাতো জাপানি শব্দের বাংলা হচ্ছে ধন্যবাদ। যারা বিদেশী তাদের জন্য এ ধরনের দু’একটি শব্দ জানা থাকলেই হয়, কেননা সাথে সব সময়ই গাইড থাকে। ওহাইও গুজাইমাস মানে শুভ সকাল (গুড মর্নিং)। শিমামাসিন মানে এক্সকিউজ মি (কারা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য) এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। হাজিমি মাসতে অর্থ আপনি কেমন আছেন (হাউ ডু ডু)।

আরও পড়ুন- চেরি ফুলের দেশে ( পর্ব- ৩)

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত