ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

চায়ের রাজ্যে একদিন

  ভ্রমণ ডেস্ক

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৫:০৯  
আপডেট :
 ১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩২

চায়ের রাজ্যে একদিন

একটি কুড়ি দুটি পাতায় পাতায় চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল। শীতের শহর। বৃষ্টিপাত বেশি হয়। মাথার উপর নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভেলা যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি ঝরে শরীর ভিজিয়ে দেয়। এ যেন রৌদ বৃষ্টির খেলা। দেশি বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে পর্যটনের এই শহর। প্রকৃতি নিজেকে আপন মহিমায় সাজিয়েছে। চারপাশে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে চায়ের বাগান। লেবু ও আনারসের বাগান অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মেরে। চা ঘিরেই পর্যটনের এই শহরে বছর জুড়েই দেশ বিদেশের পর্যটকরা ভিড় জমায়। চা রুপ্তানি ও পর্যটন খাত থেকে দেশিয় আয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। যাদের শ্রমে এই আয় তাদের খবর কেউ রাখে না। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে আনন্দের ভাজে নীরব কান্না ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চা শ্রমিকদের। এই কান্নার শব্দ পৌঁছায় না দেশের প্রধানের কানে। তাদের কান্না কি কোনো দিনই থামবে না?

৭৩ বছর পরেও ইংরেজদের রেখে যাওয়া শ্রম শোষণ এখনো চলছে চা বাগানগুলোতে। কেমন করে দেশের মালিক রপ্তানিকারক পণ্যের কারিগর চা শ্রমিকদের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রেখেছে চা কোম্পানিগুলো। সম্পর্ক বাগানে ২০ কেজি চা গাছের কচি পাতা মেপে নিয়ে ১২০ টাকা হাত গুজে দেয়া পর্যন্ত ইতি। তাদের সাথে মালিকতো দুরের কথা মিলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে কর্মকর্তাদের চলাফেরা মিলামেশা অফিসিয়ালভাবে নিষিদ্ধ। এক প্রকার চা বাগানের আইনও বলা চলে। সময়ের বিবর্তনে দেশ সমাজ ও মানুষের জীবন উন্নয়নে পরিবর্তন ঘটলেও চা শ্রমিকদের ভাগ্য তিমিরেই রয়ে গেছে। একটি কুড়ি দুটি পাতার আড়ালে চা শ্রমিকদের কষ্ট মাখা জীবনের গল্পগুলো চাপা পড়ে আছে চা বাগানের আনাচে কানাচে। এই গল্প কজনই বা জানে?

পাঠকরা ভাবছেন ভ্রমণ কাহিনীতে আনন্দের মাঝে চা শ্রমিক নিয়ে এমন রাশভারী কথা কেন তুলে ধরছি। চা শ্রমিকদের জীবন ছাড়া চা বাগানে ভ্রমণ কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চা শ্রমিকদের জীবন জীবিকার গভীরে আরো তথ্যবহুল কাহিনী তুলে ধরার জন্য ছুটে গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গল পেরিয়ে কমলগঞ্জে মাগুরছড়া পুঞ্জি খাসিয়াদের গ্রামে। ভাগ্য সেখানে সায় দিলো না। বাঁধ সেধে বসলো করোনা। মাগুরছড়া পুঞ্জিতে লকডাউন এখনো চলছে। বাহিরের লোকের প্রবেশ নিষেধ।

মাগুরছড়া পুঞ্জির গেটের দারোয়ানকে নানা অনুনয় বিনয় করেও খাসিয়াপাড়া গ্রামে ঢুকতে পারলাম না। বিশেষ অনুরোধে গেটের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ছবি তুলতে দিলো। দুঃখভরা মন নিয়ে ফিরে এলাম। খাসিয়াদের জীবন জীবিকার গল্প লিখা হলো না আমার। চলে গেলাম জাহানারা চা বাগানে। আমার সফর সঙ্গী পরিবারের বেশ কজন সদস্য। তাদের কিছু ছবি তুলে ডুব দিলাম সেখান চা শ্রমিকদের জীবনে। আমার চোখ ও মন চা শ্রমিকদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

একটু এগিয়ে যেতেই দেখি স্থানে স্থানে ছনের চালা। অটোবাইকের ড্রাইভার কাম গাইড জুয়েল মিয়াকে চালাগুলো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই বললো এই ঘরগুলো চা শ্রমিকদের বিশ্রামস্থল। এই কথা শুনতে না শুনতেই চোখে পড়লো চা বাগানের পাশে একটি ছনের চালায় দলবেঁধে নানা বয়সের চা শ্রমিক। কেউ বাড়ি থেকে পড়ে আসা কাপড় বদলে চা বাগানে কাজ করার বিশেষ কাপড় পড়ছে। শরীর থেকে খুলে রাখা কাপড় পুটলা বেঁধে কেউ কেউ ছনের চালায় বেঁধে রেখে যাচ্ছে। খেয়াল করে দেখলাম ছনের চালায় অসংখ্য চা শ্রমিকের পুটলা ঝুলছে।

সেখানে কথা হলো চা শ্রমিক কমলা, কাঞ্চন বালা, মেঘমালা ও ভানুমতিসহ অনেকের সাথে। তারা জানালো প্রতিদিন কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ২০ কেজি করে চা পাতা তুলে দেয়া বাধ্যতামূলক। এর বিনিময়ে পান ১২০ টাকা। ২০ কেজির উপরে তুলতে পারলে বাড়তি কিছু হাত ধরিয়ে দেয়। দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে এই দিয়ে কি সংসার চলে। কাকে বলবো আমাদের দুঃখের কথা। পেটে আহার যোগাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় জীবনের বাকি প্রয়োজনের কথা বাদই দিলাম।

কমলা, কাঞ্চনবালা ও মেঘমালাদের মতোই চা শ্রমিকদের জীবনের গল্প একই।

চা বাগানে চোখে পড়লো চা বাগানের সারির ফাঁকে লম্বা লম্বা গাছের সারি। অটোবাইকচালক কাম গাইড সাজিদ ভাই আঙ্গুল উঁচু করে চিনিয়ে দিয়ে বললো ভাই এগুলো চা গাছ। চা গাছ ছোট ছোট দেখছেন বাগানজুড়ে এসব বড় চা গাছ। চা গাছ বড়ও হয়। কথা ভাব বিনিময়ের একফাঁকে চোখ এড়িয়ে সাজিদ ভাই তার অটোবাইকে নিয়ে আসা একজোড়া পর্যটক নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল আমাদের মাঝ থেকে। আমরাও ছুটলাম মাধবপুর লেকের দিকে। আমাদের বহন করে অটোবাইক এগিয়ে চলছে চা বাগানে মাঝ দিয়ে সরু পথে।

আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে পৌঁছলাম মাধবপুর লেকে। লেকের ধারে দাঁড়ালে যে দৃশ্যায়ন চোখে পড়ে লেকের পাশেই পাহাড়ের চুড়া থেকে পুরো লেকের মনোরম দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে যায়। লেকে বয়ে যাওয়া বাতাসে ঘণ্টাখানেক ছিলাম। ততক্ষণে আমার দুই বছর বয়সী ছেলে নাবিল দুরন্তপনায় মেতে উঠেছে। লেকজুড়ে দৌড়াচ্ছে আর হালুম হুলুম বলে জাম্পিং করছে শক্ত লাল মাটিতে। সেজেছে বাঘ মামা। সারাদিন ইউটিউবে বাঘ সিংহের কার্টুন দেখা নাবিলের দিনলিপির একটা পার্ট। পাহাড়ি পরিবেশ পেয়ে নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।

আর আমার ছোট্ট মা মেধা, জীবন সঙ্গী শিমু, ওর বড় বোন শিল্পি আপা ক্লান্ত লেকের পাশে বেঞ্চে বসে একটু জুড়িয়ে নিচ্ছে ক্লান্ত দেহমন। ভাগিনা অনিক, শ্যালক শুভ আর আমি লেক এবং পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের ফ্রেমবন্দি করতে ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত।

মাধবপুর লেকের গেইটে ১০ টাকা গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে ক্লান্তি দূর করে ফের অটোবাইকে চেপে বসলাম সকলে। ড্রাইভার জুয়েল অটোবাইক নিয়ে ছুটে চললো চা বাগানের আঁকাবাঁকা পথে। অটোবাইক এগিয়ে চলছে চারপাশে দৌড়াচ্ছে চা বাগান আর চা শ্রমিকদের মাটির ঘর। তাদের পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলছি কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে। পথে মাগুরছড়া পুঞ্জি, লাউয়াছড়া উদ্যানে অটোবাইক থামলেও ক্লান্ত হয়ে পড়ায় সফরসঙ্গী কেউ নামলো না। তাদের নিয়ে স্পটগুলোতে ঘোরাফেরার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।

কি আর করার চলে এলাম মনিপুরি মার্কেটে। পরিবারের কয়েকজনের জন্য মনিপুরি চাদর কিনলাম। কেনাকাটা শেষে আমার শ্বশুরকুলের এনামুল নামে এক আত্মীয়ের ফোন পেয়ে প্রবেশ করলাম চা বোর্ড। এনামুল সেখানে চাকরি করে। আমাদের চা বোর্ডের সরকারি চা কারখানা ঘুরে দেখালো। চার পাতা বাছাই, পাতার আদ্রতা, কাটিং হয়ে পরিশেষে চা হয়ে আসা ঘুরে ঘুরে বর্ণনা করে চা কারখানা পরিদর্শন করালেন।

সেখান থেকে একেবারে ফ্রেস চার কেজি চা পাতা কিনলাম এনামুলের সুবাধে। চা বোর্ডের এরিয়া চা বাগানসহ মনোরম পরিবেশ যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। এমন কোনো ফলজ ও বনজ গাছ সেখানে নেই। রয়েছে নানা প্রজাতির পশুপাখিও।

দেখা মিললো নাগলিঙ্গম নামে দুর্লভ গাছের। গাছটি খুবই বিষাক্ত। ফুল ফনা ধরা সাপের মতো। আর ফল খয়েরি কালার বেলের মতো। ফল পাকলে আশেপাশে খুবই দুর্গন্ধ ছড়ায় জানালো চা বোর্ডের কর্মচারীরা।

চা বোর্ড ঘুরে এনামুলকে সাথে নিয়ে ফিরে এলাম শ্রীমঙ্গল শহরে। পানসিতে দুপুরের খাবার সেরে শেষে ঢু মারলাম সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানার ভাল্লুক, বানর, ময়ূর, অজগরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখিতে সাজিয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। শেষ মুহূর্তে চিড়িয়াখানাতে জীবজন্তু ও পশু পাখির দর্শনে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটিয়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে চেপে শেষ হলো চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ।

লেখক: শওকত জামান, গণমাধ্যম কর্মী

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত