ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০৭

চেরি ফুলের দেশে

৮. আকিয়াবারা

ডিজনিল্যান্ড থেকে বিকালে ফিরে এসে আমরা সবাই দল বেঁধে টোকিও শহর ঘুরতে বের হই রাতে। আগেই বলেছি, পরদিন রোববারও ছুটির দিন। পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি নেই। সারাদিন কী করব, এমন ভেবে ঘুমিয়ে পড়ি। বিছানা থেকে উঠি একটু দেরি করেই। নাস্তার জন্য রুটি আগের দিনই আনা ছিল। সকালে নাস্তা খেয়ে চা তৈরি করছিলাম। এমন সময় শানের টেলিফোন। সরদারজী, আজ আমরা কী করব? সবাই আমাকে সরদারজী বলেই ডাকত। আমি শানকে আমার রুমে আসতে বললাম। চা খেতে খেতে বুদ্ধি বের করব, কোথাও যাওয়া যায় কি না। কেননা, আজ গাইড নেই। যেখানেই যাই না কেন, নিজেদের দায়িত্বে যেতে হবে। শান এলো। আমরা স্থির করলাম আকিয়াবারা যাব। আকিয়াবারা হচ্ছে জাপানের বৃহত্তম ইলেকট্রনিক্স মার্কেট। সেখানে তাদের দেশীয় গ্রাহকদের জন্য যেমন দোকান আছে, তেমনি আছে বিদেশি গ্রাহকদের জন্য শুল্কমুক্ত দোকান। ইলেকট্রনিক্সে জাপানের সমৃদ্ধি কারো অজানা নয়। বিশ্ববাসীর দুর্নিবার আকর্ষণ রয়েছে জাপানি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর প্রতি।

শান আবার রুম থেকেই সবার কাছে টেলিফোন করে জানতে চায়, কে কে যাবে আকিয়াবারা। ১১টায় আমাদের যাত্রা। আমি, সুনীল, হাশমী, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রলা আর শান শিমবাশি রেল স্টেশনে গিয়ে রেলে উঠে আকিয়াবারা পৌঁছি সাড়ে ১১টায়। স্টেশনে নামতেই চারিদিক থেকে বিভিন্ন ধরনের গানের আওয়াজে বোঝা গেল এখানেই আকিয়াবারা। স্টেশনের পাশ ঘেঁষে একটি রোডের দুই পাশে বড় বড় ভবনে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর দোকান। নিচতলা থেকে ১০ তলা ১৫ তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রেডিও, টিভি, ভিসিআর, ভিসিপি, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, ওভেন, ইস্ত্রি, ঘড়ি, রাইসকুকারসহ সব ধরনের বৈদ্যুতিক সামগ্রী। একেক তলায় একেক ধরনের সামগ্রী। তাই তলায় তলায় ঘুরতে হয়। এ ছাড়া ফুটপাতেও কিছু দোকান রয়েছে। ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ডেকে ডেকে হকাররা বিক্রি করে। বড় বড় দোকানের সামনেও মাইক দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা আছে। মূল্য হ্রাসের সাইনবোর্ড প্রায় প্রতিটি দোকানেই। ফুটপাতে ঘড়ির দোকানে হাজার হাজার ঘড়ি টানিয়ে রাখা হয়েছে। ক্যামেরা আর ফিল্মও টানানো আছে।

হকার্স মার্কেটের মতো ছোট একটা ইলেকট্রনিক্স মার্কেটও আছে আকিয়াবারায়। এখানে পুরনো টেলিভিশন, ভিসিআর থেকে শুরু করে সব ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী পাওয়া যায়। বিদেশিসহ জাপানি অপেক্ষাকৃত অল্প আয়ের লোকদের ভিড় পুরনো মার্কেটে। খুবই সস্তা। ২৬ বছর আগের হিসাবে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার ইয়েন অর্থাৎ সাড়ে ৬ হাজার টাকায় ভালো রঙিন টেলিভিশন পাওয়া যায়। খুব বেশি পুরনো বলে মনে হয় না এসব। দেদার বিক্রি হচ্ছে পুরনো দ্রব্যসামগ্রী। আমাদের কেনার বেশি কিছু ছিল না। দেখা, শুধু দেখা। কারণ, কিনেও লাভ নেই। শুল্ক আইন মতে এসবের ওপর যে পরিমাণ ডিউটি তা দিয়ে দেশে এনে খুব বেশি লাভ নেই। তাছাড়া এতদূর থেকে আনার রিস্কও আছে। শুল্কের ঝামেলা তো আছেই। তাই আমি কোনো কিছু ক্রয় করার লোভ যথেষ্ট কষ্ট করে সামলালাম। তবুও আমার লোভ একটা কম্পিউটারের প্রতি। হাশমী ক্যামেরা কিনবে। আর শান ডেক সেট। আমরা শুরু করলাম প্রথম তলা থেকে। প্রতি তলায়ই এমনভাবে দ্রব্যসামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে আকর্ষিত না হয়ে উপায় নেই। আসল জাপানি দ্রব্যসামগ্রী ঢাকায় ক্রয় করার জন্য আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু তবুও ভেজাল হয়। তাইওয়ান ও কোরিয়ান দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে দেয়।

জাপানে সব আসল জাপানি জিনিস দেখেও ক্রয় করার উপায় নেই। শুধু চোখকে দেখানো। কী করেছে এ জাপান। ৩০ বছর আগেও জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল আমাদের মতো আর আজ উন্নতির শিখরে। কঠোর পরিশ্রম আর চেষ্টা তাদের ভাগ্যকে বদলে দিয়েছে। সারা জাপানে কুটিরশিল্প আকারে লাখ লাখ ইলেকট্রনিক্স শিল্প গড়ে উঠেছে। আর বড় বড় প্রতিষ্ঠান তো আছেই। না দেখলে বোঝা কঠিন কী চোখ ধাঁধানো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী তারা তৈরি করে। নিজেদের ও বিদেশিদের জন্য আলাদা-আলাদা ডিজাইনের সামগ্রী তৈরি করা হয়। দামেও পার্থক্য। বিদেশে রপ্তানি করা হয় অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে। তাদের জনগণের আয়ের ওপর দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত।

আকিয়াবারার প্রায় প্রতিটি মার্কেট আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। শান, সুনীল এবং প্রলা ঘড়ি, ক্যামেরাও ক্রয় করেছে। শেষ প্রান্ত থেকে হেঁটে আবার স্টেশনের দিকে আসতে ফুটপাতে এক জাপানি যুবকের আকর্ষণীয় বক্তব্যে আমরা সবাই থেমে দাঁড়াই। এ যুবক বিক্রি করছে সেলাই মেশিন। হাতে সেলানোর ছোট সুন্দর সেলাই মেশিন। খুব সহজভাবে সেলানো যায়। পাকিস্তানি হাশমী একটা ক্রয় করল তিন হাজার ইয়েন দিয়ে। সে সবাইকে এ যন্ত্রটি ক্রয় করার জন্য উৎসাহিত করে। আমারও বেশ ইচ্ছা হলো। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হলো দাম বেশি নিচ্ছে। আমি সংযত হলাম। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে এসে আবার আমরা আরেকটি দোকানে ঘুরতে ঘুরতে সে একই সেলাই মেশিন দেখি বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার ইয়েন। মানে মাত্র সাড়ে ৫০০ টাকা। বড় দোকানে চকচকা নতুন। আমি এবার একটা সেলাই মেশিন ক্রয় করি। হাশমীর চোখ বড় হয়ে গেল। একই জিনিস সে ফুটপাত থেকে কিনেছে ৩ হাজার ইয়েন দিয়ে।

কারণ কী, কেন এমন হলো? ফুটপাতে তো কম দামে পাওয়ার কথা। হাশমী বলল না, এভাবে ছাড়া যায় না। তাকে ধরবে বলে সবাইকে আবার তার সাথে ফুটপাতের দোকানীর কাছে যেতে অনুরোধ করতে থাকে। আমরা সবাই ক্লান্ত ছিলাম। তবুও যেতে হলো। সেই যুবক আগের মতোই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বিদেশিরা থামছে, ক্রয় করছে। হাশমী আমার মেশিনটা আর তারটা বের করে জিজ্ঞেস করল, কেন সে মূল্য বেশি নিয়েছে? ব্যবধান কী? যুবক প্রথমে হতচকিত হয়ে গেল। এমন বোধহয় কেউ করে না। পরে বলল তার টার কোয়ালিটি ভালো। আমরা মিলিয়ে দেখলাম একই কোম্পানি। সবকিছু এক। কিন্তু যুবকের এক কথা। হাশমী ব্যর্থ হলো। আমরাও যুবকের সাথে পারলাম না। স্রেফ দেড় হাজার ইয়েন লোকসান হলো হাশমীর। কিছুতেই পাকিস্তানি হাশমী ভুলতে পারেনি জাপানি ওই যুবকের প্রতারণা! জাপানের রাজধানী টোকিওতে এমন হয় আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। তাদের নৈকিতকাবোধও অধঃপতিত হচ্ছে। বিশেষ করে যুবকরা পশ্চিমাদের মতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ফুটপাতে অনেক বিদেশিকে ঠকতে হয়। জাপানিরা সতর্ক। বিদেশিরাই খপ্পরে পড়ে। যেমন পড়েছিল হাশমী।

এ ঘটনার পর আমরা আর আকিয়াবারা বেশিক্ষণ দেরি করিনি। ফিরে আসি হোটেলে। সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে রাতে আমরা আবার শহর দেখতে বের হই। হেঁটে হেঁটে দেখি টোকিও নগরী। রাতের টোকিও উন্মাতাল। আলোর বন্যার সাথে সাথে বারে, ক্লাবে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

চলবে...

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত