ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১২ মিনিট আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:১৫

চেরি ফুলের দেশে

৯. আশাই শিম্বুন

২১ সেপ্টেম্বর সকালে জাপানি অর্থনীতির ওপর সেমিনারে বক্তব্য রাখেন সে দেশের অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি মি. হিসাও কানামুরি। অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার জাপানের অর্থনীতি এখন এক স্থানে এসে স্থির হয়ে আছে। যে কারণে সারা জাপানে কম-বেশি মন্দা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ত্বরিত তাঁরা এত উন্নতি করেছে যে, এখন নব নব আবিষ্কার এবং নতুন বিনিয়োগ ছাড়া আর উন্নয়ন সম্ভব নয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, জাপান দেশে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। চাকরি হারিয়ে রেল স্টেশনে বসে সাহায্য মাগতে পর্যন্ত দেখা গেছে। মি. কানামুরি জানালেন, জাপানের শ্রমিক-কর্মচারীদের সাথে শিল্প মালিক কিংবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সাধারণত সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। একই কোম্পানিতে শ্রমিক-কর্মচারীরা আজীবন চাকরি করে। পরিবারের মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানের সাথে। আর ধর্মঘটসহ শ্রমিক বিদ্রোহ নেই বললেই চলে। পরিবারের মতো ব্যবস্থাপনা বলে মালিক-শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যেকার সৌহার্দ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিছনে চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃপক্ষ বছর বছর শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতিনিধিদের সাথে বসে তাদের দাবি ও সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে মজুরিও বৃদ্ধি পায়। এ জন্য মিছিল কিংবা ধর্মঘটের দরকার হয় না। প্রতিটি মিল, ফ্যাক্টরি, অফিস, আদালতে শ্রমিক-কর্মচারীদের ক্লাব, কেন্টিন, খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া গাড়ি-বাড়ি করার জন্য অর্থ ঋণ দেয়া হয়। প্রায় সব শ্রমিকেরই গাড়ি আছে।

বিকালে আমরা যাই জাপান তথা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সংবাদপত্র আশাই শিম্বুন অফিস পরিদর্শনে। এটা সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়। আশাই শিম্বুনের নাম শুনেছিÑকোনোদিন দেখার সুযোগ হবে এমন ভাবিনি। অবশেষে সুযোগ হলো। সংবাদপত্রের মানুষ হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই এর দিকে ঝোঁক বেশি। আসলে প্রথম দিন থেকেই অপেক্ষা করছিলাম আশাই শিম্বুন পরিদর্শনের জন্য। তাই সবারই কৌতূহল এবং উত্তেজনা কখন যাব। লাঞ্চ সেরে সবাই জড়ো হই জাপান প্রেস ক্লাবে। কফি পান করে পত্র-পত্রিকা দেখছিলাম। এমন সময় খবর এল হাশমী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়েছে। হাশমীর খাবারের সমস্যা কাটেনি। যে কারণে প্রায় প্রতিদিনই অসুস্থ হয়ে পড়ত। প্রথম প্রথম পাকিস্তানি হাশমী হোটেলে হালাল খাবার খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু পরে তাকে হুইস্কি পর্যন্ত গলাধঃকরণ করতে দেখেছি। ট্রেনে এবং হেঁটে আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই আশাই শিম্বুন অফিসে। আশাই জাপানি শব্দ। এর ইংরেজি হচ্ছে ঝঁহ জরংব বাংলায় সূর্যোদয়। সূর্যোদয়ের দেশে সংবাদপত্রের নামও সূর্যোদয়। আর শিম্বুন অর্থ সংবাদপত্র। আমি আগে জানতাম আশাই শিম্বুন বিশে^র সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র। কিন্তু জাপানে যেয়ে শুনলাম এটা দ্বিতীয়। প্রথমটিও জাপানের। নাম ইউমুরী শিম্বুন। আশাই শিম্বুন প্রতিষ্ঠান হিসাবে নামকরা এবং বড় ও আধুনিক। আশাই শিম্বুনের চারটি সংস্করণ বের হয় প্রতিদিন। এ ছাড়াও সন্ধ্যায় ইংরেজি সংস্করণ আশাই ইভেনিং নিউজ বের হয়। আশাই শিম্বুনের জাপানি ভাষায় সকালের সংস্করণের প্রচার সংখ্যা (১৯৯২ সালের হিসেবে) ৮২ লাখ ৬০ হাজার। আর পরেরগুলো সংস্করণের প্রচার সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। সকালে ৩২ পৃষ্ঠা আর বিকালে বের হয় ২০ থেকে ৩০ পৃষ্ঠা। প্রতি প্ল্যান্টে ৪টি করে রোটারি প্রিন্টিং মেশিন সম্বলিত মোট ১৯টি প্রিন্টিং প্ল্যান্টের ১০টি দিনরাত চালু থাকে। এক ঘণ্টায় ৭২ হাজার ছাপা যায় এক একটি মেশিনে। আশাই শিম্বুন কোম্পানির আরো ১৪টি সাপ্তাহিক ও মাসিক সংবাদপত্র রয়েছে। এ ছাড়া তাদের একটি স্যাটেলাইট টিভি ও রেডিও স্টেশন আছে। পত্রিকাটি বর্তমানে টোকিও, ওসাকা, ফকুকা, নগুয়া ও হুক্কাইডু পাঁচটি স্থান থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়।

১৮৭৯ সালে জাপানের ওসাকায় জুড়যপর গঁৎধুধসধ এবং জরপযর টবহড় যুগ্মভাবে এ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ সালে রাজধানী টোকিওতে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানেও পত্রিকাটি যুগ্ম মালিকানার। এরা হলেন গরপযরশড় গঁৎধুধসধ এবং ঔঁহ ওপযর টবহড়. প্রথম জন মহিলা, দ্বিতীয় জন পুরুষ। দুজন মালিকের শেয়ার সমান সমান শতকরা ৫০ ভাগ। আর ৫০ ভাগের মালিক পত্রিকাটির সাবেক ও বর্তমান কর্মচারীগণ। পত্রিকাটির সাংগঠনিক প্রধানকে প্রেসিডেন্ট বলা হয়। তিনিই প্রধান নির্বাহী। তারপরে আছে সিনিয়র ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং নির্বাহী সম্পাদক। এরপর পর্যায়ক্রমে আছেন দুজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ১০ জন পরিচালক, ৩০ জন অডিটর, একজন জনসংযোগ পরিচালকসহ বিভিন্ন বিভাগের অসংখ্য উপদেষ্টা। সংবাদপত্রটির আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডও আছে। তখন আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ, সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিট, মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলজ, সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইয়েনসহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ। পাঠকের মতামত নেয়ার জন্য রয়েছে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিস। বিশ্বের ৬০টি দেশে এবং শহরে পত্রিকাটির শাখা অফিস আছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা আশাই শিম্বুন অফিসে কাজ হয়। ১ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন। ৩ হাজার সাংবাদিক। ৩ হাজার সাংবাদিকের মধ্যে অর্ধেক রিপোর্টার।

তাঁরা রাজধানী টোকিওসহ জাপানের বিভিন্ন স্থানে রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেন। অফিসে আইবিএমের সর্বশেষ কম্পিউটার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। ১২ বছর আগে কম্পিউটার চালু করা হয়। এর আগে ছিল হাতে কম্পোজ ব্যবস্থা। রিপোর্টারদের শতকরা ৯০ ভাগই অফিসে আসেন না। তাদের প্রত্যেকের কাছে একটি বহনযোগ্য কম্পিউটার আছে। বাসায় ফ্যাক্স দেয়া হয়েছে। কম্পিউটার দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে তারা ফ্যাক্সে অফিসে সংবাদ পাঠিয়ে দেন। শুধু রিপোর্টারদের নিউজ সংগ্রহের জন্য ১৪টি ফ্যাক্স সব সময় তৈরি থাকে। জাপানের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং বড় বড় অফিসে রয়েছে প্রেস ক্লাব। সে প্রেস ক্লাবে ফ্যাক্স-টেলিফোনসহ সব ব্যবস্থা আছে। সংশ্লিষ্ট অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় ব্রিফ করেন। এ ছাড়া রিপোর্টারদের মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ ভাগ করা আছে। যার যে দায়িত্ব, তিনি ওই অফিসেই ঘোরে সংবাদের সন্ধানে। প্রেস ক্লাবে আড্ডা দেয়। অফিসে যাওয়ার তাগিদ নেই। যেখানে থাকে নিউজ পেলে সেখান থেকেই পাঠিয়ে দেন।

আশাই শিম্বুন পত্রিকায় রয়েছে চারটি হেলিকপ্টার ও তিনটি জেট বিমান। জরুরি সংবাদ সংগ্রহে রিপোর্টাররা জেট বিমান এবং ফটোগ্রাফাররা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। রাজধানী টোকিওসহ জাপানের কোনো স্থানে বড় কোনো দুর্ঘটনার খবর পেলে সাংবাদিকরা জেট বিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে ছোটেন। ২৬ বছর আগের হিসাব মতে সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন মাসে ২০ থেকে ৫০ লাখ ইয়েন। আর সিনিয়র সাংবাদিকরা পেতেন ১ কোটি ২০ লাক ইয়েন। পত্রিকাটির রয়েছে বড় বড় দুটো ভবন। ভবন দুটি ২০ তলা। নতুন একটি ভবনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে আমাদের পরিদর্শনের সময়। সেটি হবে ২৪ তলা। মাটির নিচে আছে ৪ তলা। নতুন ভবনের ওপর তলায় ছাদের ওপর আছে টেনিস কোর্ট। ডেভিস কাপের চ্যাম্পিয়ন তারকাকে এনে এ কোর্ট উদ্বোধন করা হয়। এত ওপরে যাতে বাতাসের জন্য টেনিস খেলায় কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা করা আছে। নতুন ভবনের চার তলায় রয়েছে বিরাট একটি মিলনায়তন। এটা নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহার ছাড়াও ভাড়া দেয়া হয়। পত্রিকার কর্মচারীদের জন্য নতুন ভবনে একটি কনসার্ট হল আছে। আলাদা-আলাদা রিক্রিয়েশন কক্ষ আছে। আর আছে বার। একটা বড় আধুনিক পিয়ানো কিনে এনে রাখা হয়েছে।

আমাদের জানানো হয় যে, জাপানে এ ধরনের পিয়ানো মাত্র দুটি। একটা সম্রাট পরিবারে, অন্যটা আশাই শিম্বুন অফিসে। এ পত্রিকা দেশব্যাপী স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্য বছর বছর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও মহিলাদের জন্য বছরে একবার ম্যারাথন রেসের আয়োজন করে থাকে। পুরনো ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় সাংবাদিক-কর্মচারীদের জন্য আলাদা ক্যানটিন রয়েছে চারটা। ব্যায়ামাগারও আছে কয়েকটা। নিচ তলায় আছে অতিথিদের জন্য কফিরুম। প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ লোক এ পত্রিকা অফিস পরিদর্শনে আসেন। ফরেন লিয়াজোঁ সেন্টার নামে একটা বিভাগে ২৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী অতিথিদের অফিসে স্বাগত জানান এবং বিভিন্ন বিভাগ ঘুরিয়ে দেখান।

আমরা আশাই শিম্বুন অফিসে গিয়ে পৌঁছলে ফরেন লিয়াজোঁ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্বাগত জানান। প্রথমেই তিনি পত্রিকার কার্যক্রম সম্বলিত একটা বুকলেট আমাদের হাতে তুলে দেন। একটা ভিডিও চিত্রে তাদের কার্যক্রম প্রদর্শন করা হয়। এরপর একজন কর্মকর্তা আমাদের বেইজমেন্টে নিয়ে যান প্রথম। বেইজমেন্টে ছাপার মেশিন। বিরতি দিয়ে প্রিন্টিং প্ল্যান্টগুলো চালু করা হয়ে থাকে। কাগজ ছাপা, বাইন্ডিং, হয়ে একদম প্যাকেট হয়ে বের হয়। মেশিনের সাথেই দাঁড়ানো আছে ট্রাক। ট্রাক পর্যন্ত অটোমেটিক উঠে যায় পত্রিকা। এরপর ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে। কাগজ পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে। ১৬টি ট্রাক সব সময় প্রিন্টিং প্ল্যান্টের সাথে এ জন্য তৈরি থাকে। নিজস্ব এজেন্ট রয়েছে ৪ হাজার ৩৮০ জন। তারা বাইসাইকেলযোগে বাড়ি বাড়ি কাগজ পৌঁছে দেয়। আবার কেউ দোকানে বসে, স্ট্যান্ডে বসে কাগজ বিক্রি করে।

জাপানের প্রত্যেক বাড়ির সামনে সংবাদপত্র রাখার বাক্স আছে। প্রতি পরিবারই একাধিক সংবাদপত্রের গ্রাহক। পুরনো ভবনের চতুর্থ এবং পঞ্চম তলায় সংবাদের কাজ হয়। এ তলায়ই রিপোর্টার, সাব-এডিটর এবং নিউজ এডিটরের বসার স্থান। আমরা যখন সংবাদপত্র অফিসটিতে যাই, তখন বিকেল ৫টা। আমাদের দেশের দৈনিক সংবাদপত্রে ১৬ বছর আগে বস্তুতপক্ষে এমন সময়ে কোনো কাজ হতো না। আশাই শিম্বুন অফিসে কিন্তু পুরাদমে কাজ চলছিল। কেননা, তাদের কয়েকটা সংস্করণ। তাই সারাদিন, সারারাত কাজ। প্রত্যেকের টেবিলে কম্পিউটার। কে আসছে-যাচ্ছে, খবর নেই। আমরা ঘণ্টাখানেক বার্তাকক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেছি; কিন্তু কথা হয়েছে মাত্র কয়েকজনের সাথে। এত মানুষ একসঙ্গে ঘোরার পরও যেন কারো কাজে ব্যাঘাত হয়নি। কেউ ভ্রক্ষেপও করেনি। একের পর এক বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে আমরা নিচে যখন আসি, তখন সন্ধ্যা। ফরেন লিয়াজোঁ বিভাগের প্রধান ঊসরপড় ঞবৎাুধহধ আমাদের কফি রুমে নিয়ে আপ্যায়ন করেন। কথায় কথায় তিনি জানান, এই পত্রিকার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ৪০০ বিলিয়ন ইয়েন। চলবে...

আরও পড়ুন- আগের পর্ব

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত