চেরি ফুলের দেশে
-শাহজাহান সরদার
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:০০
১০. ডায়েটে
শুধু অর্থনীতিতে নয়, শিক্ষা-বিজ্ঞানেও জাপান আজ যথেষ্ট উন্নত। শিক্ষিতের হার একশ’ ভাগ, আগেই বলেছি। জাপানের সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। নিম্ন মাধ্যমিক স্তর সমাপ্ত করে শতকরা ৯৫ ভাগ ছেলেমেয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করে থাকে। শিক্ষকরা জাপানে সবচেয়ে সম্মানীয় এবং অন্যান্য পেশা থেকে শিক্ষকতা পেশায় বেতন বেশি। ২২ সেপ্টেম্বর জাপানি শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সেমিনারে সে দেশের শিক্ষা-সংক্রান্ত জাতীয় কারিকুলাম গবেষণা বিভাগের প্রধান মি. কাজুও ইশিজাকা বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান, বর্তমানে জাপানে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা মার্কিন ধাঁচের। এ শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পর এ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। দেশের শহর, গ্রাম সব এলাকায় একই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক ও শিক্ষা সামগ্রী বিতরণসহ সব ক্ষেত্রে রয়েছে সমান সুযোগ। কোথাও কোনো বৈষম্য নেই। গ্রাম এলাকার কোনো ছাত্রছাত্রীর কোনোভাবেই বঞ্চিত হওয়ার অবকাশ নেই। ২০ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক। জাপানের শতকরা ৯৯ ভাগই সরকারি স্কুল। বেসরকারি স্কুলগুলো ব্যয়বহুল। ’৯২-এর সেপ্টেম্বরে জাপানে ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ। সে সময় জাপানে এক হাজার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান ছিল। এর মধ্যে ৯৫টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সেমিনার শেষে আমরা জাপানের সংসদ (ডায়েট) ভবন দেখতে যাই। দুই কক্ষের সংসদের আলাদা-আলাদা ভবন রয়েছে। কোজিমা সান আমাদের গাইড। তখন ডায়েটের কোনো অধিবেশন ছিল না। আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন জনসংযোগ বিভাগের প্রধান। তিনি সরাসরি আমাদের নিয়ে গেলেন নিম্ন কক্ষে এবং পরে উচ্চকক্ষের মূল অধিবেশন কক্ষে। অধিবেশন কক্ষ আমাদের সংসদ কক্ষের মতো নয়। কাঠের তৈরি উঁচু উঁচু চেয়ার। উচ্চ কক্ষে সম্রাটের জন্য আসন রয়েছে। সম্রাট দুই বছর অন্তর অন্তর উচ্চকক্ষে ভাষণ দেন। এ উপলক্ষে তিনি দুই বছরে একবার ডায়েট ভবনে আসেন। তাঁর জন্য একটি বিশ্রাম কক্ষ আছে। সংসদ ভবন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা জানান, সম্রাট না এলেও ডায়েটে তাঁর কক্ষ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বড় অংকের ব্যয় হয়ে থাকে। জাপানি বিশেষজ্ঞরা তাদের নিজ দেশের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ডায়েট ভবন নির্মাণ করেছেন। ভবনে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সংস্কারকদের মূর্তি তৈরি করে রাখা হয়েছে। কাঠের কাজ অনেক। আধুনিক ডিজাইন। সবই তাদের নিজ দেশের হলেও ডায়েট ভবনের তালাগুলো আনা হয় আমেরিকা থেকে। ডায়েটের জনসংযোগ বিভাগের একজন মহিলা কর্মকর্তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভবন দেখিয়ে আমেরিকা থেকে তালা আমদানির কথা জানালেন। এর কারণ কী, জানতে চাইলে মহিলা বললেন, এ ভবনে আগে প্রায়ই চুরি হতো। তালাগুলো ভেঙে ফেলা হতো। এ কারণেই শক্ত আমেরিকান তালা আনা হয়। শ্রীলঙ্কার শান এ কথা শুনে মন্তব্য করে ‘মার্কিনিদের প্রটেকশনে জাপানি গণতন্ত্রকে সংহত করা হয়েছে।’ নেপালের রায় তরুণী মহিলা গাইডের কাছে জানতে চায় জাপানিরা নিজেদের ঘরেও আমেরিকান তালা লাগায় কি না? এ কথা শুনে মহিলা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আমরা ডায়েট ভবন দেখে সামনে এসে সবাই মিলে ছবি তুলি। সামনে সুন্দর ফুলের বাগান।
জাপানি এক উৎসবের কারণে ২৩ সেপ্টেম্বর সরকারি ছুটি ছিল। এদিন কোনো কর্মসূচি ছিল না। আমি আর শ্রীলঙ্কার শান দুজনে শহর দেখতে বেরুই। প্রথমে আমরা খুঁজতে থাকি ভারতীয় দূতাবাস। ভারতীয় দূতাবাস খোঁজার কারণ ভিসা। আমার টিকিট ছিল ঢাকা-ব্যাংকক-টোকিও, আবার টোকিও-ব্যাংকক-ঢাকা। কিন্তু ফেরার পথে আমি কলকাতা হয়ে আসতে চাচ্ছিলাম। কারণ ফ্লাইটের সিডিউল অনুযায়ী ব্যাংকক থেকে আমাকে রাত ১১টায় ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করতে হবে। বিমান বন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১২টায় বাসায় আসা রিস্কি। ঢাকায় আইনশৃঙ্খলার বেশ অবনতিশীল অবস্থা ছিল তখন। তাই কলকাতা একদিন থেকে ঢাকা আসার জন্য ভিসা দরকার।
হোটেল থেকে ভারতীয় দূতাবাসের ঠিকানা নিয়ে রওনা হই। দুটি ট্রেন লাইন বদলিয়ে সাবওয়েতে ভারতীয় দূতাবাসের কাছাকাছি পৌঁছি। বলে দেয়া হয়েছিল, দূতাবাসটি সম্রাটের বাড়ির কাছাকাছি। আমরা সাবওয়ে থেকে ওপরে উঠে হাঁটতে থাকি। কিন্তু এ এলাকাটি আবাসিক। ছোট ছোট ভবন। চেনা কঠিন। এক জাপানি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কিছু বলতে পারলেন না। আমরা হাঁটতে থাকি। মূল রাস্তা ছেড়ে অন্য দিকে মোড় ঘুরতেই এক মহিলা দৌড়ে এলেন সামনে। তিনি বললেন এদিক নয়, ওদিক। তার কথায় আশ্চর্য হলাম। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, পিছন থেকে ভদ্রলোকের সাথে আমাদের কথা তিনি শুনেছেন। কিন্তু সোজা পথ ছেড়ে মোড় ঘুরতেই এসে পথ দেখিয়ে দিলেন ভারতীয় দূতাবাসের।
সরকারি ছুটি হলেও ভারতীয় দূতাবাস খোলা ছিল। অভ্যর্থনায় বসা এক মহিলাকে নিজেদের আসার উদ্দেশের কথা বললাম। মহিলা আরেক মহিলাকে ডেকে নিয়ে এলেন। তার সঙ্গে কথা হলো। একটা ফরম দিলেন পূরণ করে দেয়ার জন্য। ফরম পূরণ করে তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং সাথে তিন হাজার ইয়েন জমা দিতে হলো। দূতাবাসের কর্মচারী জাপানি মহিলা মিনোভো সবকিছু জমা রাখার পর এক সপ্তাহ পর খোঁজ নিতে বললেন। এত দেরি কেন, জানতে চাইলে তিনি বললেন, তাঁরা আমার বিশদ বর্ণনা দিয়ে দিল্লিতে টেলেক্স পাঠাবেন। দিল্লি যদি রাজি হয়, তাহলে ভিসা পাওয়া যাবে। বুঝতে পারলাম কঠিন ব্যাপার হবে ভিসা পাওয়া। কিন্তু তাঁর কথা মতো সাত দিন পর আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কেননা, একদিন পরই ১০ দিনের জন্য আমি টোকিও ছেড়ে অন্যান্য শহরে চলে যাব। মিনোভোকে এ কথা জানাতে তিনি আমার টোকিওর ঠিকানা চেয়ে বললেন খবর এলে আমি জানিয়ে দিব। আমি এফপিসির ঠিকানা দিলাম। টোকিও ত্যাগের সময় এফপিসি কর্মকর্তাদের সব বলেও গিয়েছিলাম। কিন্তু না, কোনো খবর আসেনি।
দশ দিন পর টোকিও ফিরে এসে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করে জানতে পারি দিল্লি কোনো উত্তর দেয়নি। দুদিন আগে পর্যন্ত ভারতীয় দূতাবাসে খবর নিয়েছি। তাদের একই কথা দিল্লি জানায়নি। শেষ দিন আমি জানতে চাইলাম, আমার ৩ হাজার ইয়েন ফেরত পাওয়া যাবে কি না? জবাবে বলা হলো, এ অর্থ টেলেক্স পাঠানোর জন্য নেয়া হয়েছে। বিস্মিত হলাম। দূতাবাস টেলেক্সের জন্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে? তাছাড়া অর্থের অংক তো কম নয়। একটি টেলেক্স পাঠাতে কি এত অর্থ দরকার হয়? আমার ভিসাও হলো না আর অর্থও গেল। অগত্যা আমাকে কলকাতা অবস্থানের পরিকল্পনা ছাড়তে হলো। তবুও রাতে আসা পরিহারের জন্য ব্যাংকক থেকে কলকাতা হয়ে কানেকটিং ফ্লাইটে ঢাকার টিকিট করেছিলাম। কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এ জন্য ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
পরদিন সকালে আমাদের কর্মসূচি ছিল জাপানি মহিলাদের জীবনযাত্রাবিষয়ক সেমিনার। সেমিনারে যোগ দিতে আমাদের যেতে হয়েছে টোকিওর সিনঝুকি এলাকায়। এ এলাকায় বেশির ভাগ সরকারি অফিস-আদালত। টোকিও সিটি করপোরেশনের অফিসও একই এলাকায়। নতুন নতুন ভবন নির্মাণ চলছে তখনো। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান। গলি দিয়ে ঢুকে গাছপালা বেষ্টিত একটা দোতলা বাড়িতে অফিস। জাপানি নারী আন্দোলনের অগ্রদূত এর নামানুসারে এ সংগঠন। সংগঠনের এখনকার প্রধান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি আমাদের জাপানি নারী সমাজের পূর্বাপর এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা দেন দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা। তাঁরও একই কথা, বেশি বেশি কাজের জন্য সামাজিক সমস্যা হচ্ছে। মহিলারা নিগৃহীত হচ্ছেন। এ থেকে বের হয়ে আসার পথ সরকার এবং তার সংগঠন চিন্তাভাবনা করছে বলে তিনি জানান। সেমিনার শেষে আমরা রওনা হই জাপানি রেডিও-টিভি ভবনের উদ্দেশে। যাকে এনএইচকে বলা হয়।
চলবে...
আরও পড়ুন- পর্ব ৯
বাংলাদেশ জার্নাল/আর