ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ আপডেট : ৭ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:১৭

চেরি ফুলের দেশে

১২. হোম স্টে ইকোহামা

২৫ সেপ্টেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে সব গোছগাছ করে তৈরি হয়ে নেই। রাজধানী টোকিওর বাইরে আমাদের কর্মসূচি আজ থেকে শুরু। ১০ দিন থাকব বিভিন্ন শহরে। প্রথমেই ইকোহামা। সবকিছু ঠিকঠাক করে হাত ব্যাগটায় প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ভরে চেইন টান দিয়ে দেখি, চেইন কাজ করছে না। নারিতা বিমানবন্দরের শুল্ক কর্মচারীরা ব্যাগের এ দশা করেছিল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বড় ব্যাগ নিতে মানা। কয়েকটি শহরে ঘুরতে হবে। বড় ব্যাগ টানাটানি করাও অসুবিধা। ব্যাগের চেইন খারাপ হয়ে যাওয়ায় চিন্তা করছিলাম কী করা যায়। অবশেষে চেইন ছেঁড়া ব্যাগ নিয়েই নিচে লবিতে এসে হোটেল কর্মচারীদের বললে তাঁরা আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ঠিক করার জন্য বেশ চেষ্টা করে।

আমি এবং বন্ধু ফেলোরা সবাই একসাথে চলে যাই এফপিসিতে। বাইরে যাব বলে ব্রিফিং আছে। হোম স্টে সম্পর্কে। হোম স্টে মানে হচ্ছে জাপানি একটি পরিবারের সাথে বাড়ির মতো বসবাস। তিনরাত থাকতে হবে। এ তিন দিন সে পরিবারের একজন সদস্যের মতো মিশে যেতে হবে তাদের সাথে। এমনকি পরিবার প্রধান ও তাঁর স্ত্রীকে ফাদার-মাদার হিসাবেও ডাকতে হবে। পারিবারিক কাজও করতে হবে। যে পরিবারে থাকতে হবে সে পরিবারও নিজের করে নিয়ে জাপানি ভাষা, সংস্কৃতিসহ সবকিছু শেখাবে। জাপানকে পরিচয় করিয়ে দেবে। জাপানে বিদেশিদের জন্য হোম স্টে খুবই জনপ্রিয়। জাপানি অনেক পরিবার স্বেচ্ছায় বিদেশিদের বাসায় নিয়ে যায়। হোম স্টের ব্যবস্থাপনার জন্য জাপানে অসংখ্য সংগঠন রয়েছে। যেসব বিদেশি জাপানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণ কিংবা লেখাপড়া করতে যায়, তাদের জন্য এ হোম স্টে মানে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা। এতে জাপানের পরিবারকে জানা যায়। ছোটখাটো ইতিহাস এবং ভাষা জানা যায়। হোম স্টে ব্যবস্থাপনাকারী সংস্থাসমূহ এ জন্য অর্থ নিয়ে থাকে। তবে পরিবারসমূহ কোনো অর্থ নেয় না। তারা অতিথিদের জন্য খাবার এবং অন্যান্য ব্যয় নিজেরাই বহন করে থাকেন।

আমাদের হোম স্টে-এর ব্যবস্থা ইকোহামা শহরে। টোকিওর কাছেই এ শিল্প ও বন্দরনগরী। জাপানের সবচাইতে উঁচু ভবন ১৬ জুন ’৯৩ ইকোহামায় উদ্বোধন করা হয়েছে। ইকোহামা শহরে তিনদিন থেকে আমরা হিরোশিমা, ওকাইয়ামা ও কিওটো শহর ঘুরে আবার ফিরে আসব টোকিওতে। এ সম্পর্কে এফপিসিতে ব্রিফিং শেষে ব্যাগ নেয়ার জন্য হোটেলে এসে দেখি আমার হাত ব্যাগের সাথে আরেকটি চামড়ার সুন্দর ব্যাগ বাঁধা আছে। আমি দুটি ব্যাগ একসাথে দেখে অবাক হলাম। অভ্যর্থনাকারী এগিয়ে এসে বলল, এটা আপনার জন্য হোটেলের উপহার। তাদের এ ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। হোম স্টেতে আমাদের সাথে রয়েছেন দুজন এফপিসি গাইড মি. কোজিমা সান ও মি. ইয়ানো সান। স্টেশনে যেয়ে তাদের দুজন দুদিকে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। তরুণ ইয়ানো সান একদিক আর বৃদ্ধ কোজিমা সান ম্যাপ দেখতে দেখতে অন্যদিকে। অবশেষে ইয়ানো সানের কথা মতো লাইনের ট্রেনেই আমরা আরোহণ করি। কিন্তু ট্রেনে উঠেও কোজিমা সান বার বার ম্যাপ দেখতে থাকেন। তাঁর ভাবে বোঝা যায় আমরা ভুল করেছি। কিন্তু না সঠিক পথেই গিয়েছি।

তিনবার ট্রেন বদলিয়ে চতুর্থ ট্রেন দিয়ে আমরা যেয়ে ইকোহামা সিটি স্টেশনে পৌঁছি। তখন বেলা পৌঁনে ২টা। সেখান থেকে হেঁটে কাছেই ইকোহামা সিটি হল। এটা সিটি করপোরেশনের অফিস। এ অফিসের কর্মকর্তারা আমাদের স্বাগত জানান। এ সময় স্থানীয় সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন। সিটি হলে করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা আমাদের উদ্দেশে ইকোহামার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। সেখান থেকে আমরা স্থানীয় সংবাদপত্র ‘দ্য কানাগুয়া শিম্বুন’ অফিসে যাই। আমাদের রাজধানী ঢাকার তুলনায় ইকোহামা নারায়ণগঞ্জের মতো। কানাগুয়া শিম্বুন অফিসে পত্রিকার বার্তা সম্পাদক পত্রিকা অফিস ঘুরিয়ে দেখান। সব কাজ কম্পিউটারে। ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংবাদপত্রটি নীতি হিসেবে বলা হয়েছে নিরপেক্ষতা। প্রচার সংখ্যা আড়াই লাখ। মোট ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে সাংবাদিক দেড়শ’। লোকবল ও প্রচার সংখ্যা আমাদের ইত্তেফাক-এর মতো। তখন আমি ইত্তেফাকে কাজ করি। ৮০ লাখ লোক অধ্যুষিত ইকোহামা শহরে টোকিও থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকাগুলোর দৈনিক সংস্করণ প্রতিটিই আসে। এ ছাড়াও স্থানীয় অন্যান্য আরো সংবাদপত্র রয়েছে।

কানাগুয়া শিম্বুন অফিস দেখে আমরা রওনা হই আমাদের পরিবারের সন্ধানে। আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিভাবকরা আসবেন সেখানে। একটি সংগঠন এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। ইকোহামা শহরে তখন প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইছিল। ধূলিঝড় ছিল কম-বেশি। হেঁটে কিছুতেই এগোনো যাচ্ছিল না। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছিল। হাঁটতে তখন খুবই কষ্ট হয়। তবুও উপায় নেই, হাঁটতেই হলো। পৌনে ৫টার দিকে ঐড়সব ঝঃধু-র ব্যবস্থাপকদের অফিসে পৌঁছি। সবাই অপেক্ষা করতে থাকলাম অভিভাবকদের জন্য। ভীষণ উত্তেজনাকর ব্যাপার। নিজের পরিবার ছেড়ে ভিনদেশে পরিবারের মতো বাস করা কৌতূহলের বিষয়ও বটে। একটা সারপ্রাইজ আর অভিজ্ঞতার বিষয় তো আছেই। ৫টার দিকে সব অভিভাবকরা একে একে এসে পৌঁছান। জানি না কে আমার অভিভাবক। কার সাথে যেতে হবে। ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকে এর ওপর বক্তব্য রাখা হয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে এ কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। তারা ইংরেজি বলতে পারে না। তাই দোভাষী ইংরেজি করে দিচ্ছেন। সবকিছু অবহিত করার পর এবার যাওয়ার পালা।

ডাক শুরু হলো। যার যার অভিভাবকের পাশে যেয়ে আমরা বসলাম। অভিভাবকদের সাথে সবার পরিচয় শেষে বাড়ির উদ্দেশে রওনা। দীর্ঘ ১০ দিন ধরে একজন আরেকজনের সাথে আমরা যে বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আপাতত এর ছেদ ঘটল। বিদায় নিলাম পরস্পরের কাছ থেকে। তিনদিন পর আবার দেখা হবে। আমার অভিভাবক এর সাথে রওনা দিলাম। মহিলাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। বারবার হাঁই তুলছিলেন। যেতে যেতে কথা হলো। প্রথমে ট্যাক্সি করে একটি রেল স্টেশনে, পরে দুইবার ট্রেন বদলিয়ে পশ্চিম ইকোহামায় এসে পৌঁছি। তখন সন্ধ্যা ৭টা। দুটি স্টেশনেই মহিলা টেলিফোনে কথা বললেন। শেষ স্টেশনে নেমে আমরা বের হয়ে এলাম রাস্তায়। মহিলা এদিক-ওদিক কী যেন দেখছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, তাঁর স্বামীর গাড়ি নিয়ে আসার কথা। তাই খুঁজছেন। মুহূর্তেই একটা গাড়ি এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। হ্যান্ডশেক ও হ্যালো বিনিময়ের পর গাড়িতে উঠলাম। আমি একা পেছনের আসনে। তাঁরা দুজন যেন কি বলছিলেন বুঝতে পারলাম না। সামনের সিট থেকে আমার দিকে ফিরে বললেন, আমরা ভাবছি রাতের খাবারটা কোন চাইনিজ হোটেলে সেরে নেই। আমার কোনো আপত্তি আছে কি? আমি আপত্তি নেই জানাতেই গাড়ি ঘুরে এক চাইনিজের কাছে থেমে গেল। নেমে এলাম। নিরিবিলি পরিবেশ। আবাসিক এলাকায় চাইনিজ হোটেল। ভিড় নেই। কয়েক জোড়া দম্পতি বসে আছে বলে মনে হয়। হোটেলের নাম ইওএ ইঙণ. এখানেই আমার সাথে আমার হোস্ট ফাদার ও হোস্ট মাদারের পরিচয় পর্ব সমাপ্ত হয়। ভদ্রলোকের নাম ণধংঁভঁংধ ঋঁলরুড়ংযর. আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজন সদস্য। তিনি তার এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আর মহিলা এক স্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা। ভদ্রলোক ইংরেজি বলতে পারেন না তেমন।

তাদের একমাত্র সন্তান ইয়াতারো। থাকে ইয়ামানাসিতে। একটি জাতীয় সংবাদপত্রের স্থানীয় সংবাদদাতা। ইকোহোমার নিজস্ব বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী দুজনই থাকেন। বৃদ্ধ বয়সেও মহিলা চাকরি করেন। সংসারের সব কাজ করেন নিজে। সাহায্যের কেউ নেই। আমাকে আনতে যেয়ে যে সময় ব্যয় হয়েছে, এ জন্য তাঁকে বেশি কাজ করে যেতে হয়েছে। পর পর দুদিন ছুটি। ঘোরাঘুরি করবেন। তার ঘুম আসছে বলে জানালেন। আর এর প্রমাণ বারবার হাঁই তোলা। চাইনিজ হোটেলে খেতে বসে আমাকে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কী খাব? আমি বললাম, জাপানি ছাড়া যে কোনো পশ্চিমা ডিশ। কেন জাপানি নয়? জানতে চান গৎং. ঊপযড়. আমি উত্তর দিলাম, হোটেলে জাপানি না খেয়ে, তোমার বাসায় খাব। সেখানে তো তিনদিন সময় আছে। ভেজিটেবল, গরুর কারি এবং সামুদ্রিক মাছ দিয়ে ভাত খেলাম পেট ভরে। টোকিওর চাইতে এখানে ব্যতিক্রম মনে হলো খাবার। স্বাদ একটু ভিন্ন। খেয়ে আমরা এলাম ঊপযড়-এর বাসায়। একটা ছোট দোতলা বাড়ি। জাপানি ঐতিহ্যে নির্মিত। ওপরে কাঠ ও টিনের কাজ করা। বাসায় আসার পর কক্ষের মেঝের গর্ত থেকে টেনে একটা টেবিল বের করেন ঊপযড়. মেঝে থেকে কিছু ওপরে টেবিলটি পাতেন আলাদা পা বসিয়ে। জাপানি বেশির ভাগ বাড়িতেই এমন ব্যবস্থা। কাজের সময় টেবিল গর্তের ভেতর থেকে বের করে আনা হয়। পরে আবার ঢুকিয়ে রাখে। জায়গা কম বলে এমন ব্যবস্থা। পা গর্তের ভিতর দিয়ে বসতে হয়। ঊপড় টেবিল ঠিক করে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বেশ কয়েকটি বড় অ্যালবাম নিয়ে এলেন।

প্রথমেই দেখান তার বাড়িতে ইতোপূর্বে যারা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিলেন, তাদের ছবি। এরপর পারিবারিক বিভিন্ন ছবি। স্বামী-স্ত্রীর চীন, পাকিস্তান, গ্রিস ও ইতালি সফরের ছবি। ছবিগুলো দেখিয়ে মহিলা ম্যাপের বই নিয়ে এলেন। এরই মধ্যে আমার হোস্ট ফাদার কাগজপত্র নিয়ে এসে বসেন। দুজনই ম্যাপের বই থেকে বাংলাদেশের ম্যাপ বের করে কোন স্থানে আমার বাস, জানতে চান। আমি দেখালাম। এরপর আমার কাছে পারিবারিক বিভিন্ন তথ্য জেনে নেন। আমাকে প্রয়োজনীয় কিছু জাপানি শব্দও শিখিয়ে দেন। আমার কাছ থেকে দু-একটা বাংলা শব্দ স্বামী-স্ত্রী দুজনে শেখেন। রাত ১০টা বেজে যায়। মহিলা বারবার হাঁই তুলেও ঘুমাতে যাচ্ছেন না। আমিও ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছে। আমি আমার ক্লান্তির কথা বলতেই মহিলা বললেন আধঘণ্টা পরে তাঁর ছেলে ইয়াতারো টেলিফোন করবে। ছেলের সাথে কথা না বলে ঘুমাবেন না।

আধঘণ্টা পরে টেলিফোন না এলে মহিলা নিজেই টেলিফোন করলেন ইয়ামানাসির মাইনচি শিম্বুন অফিসে। জবাব এলো, ছেলে কাজে ব্যস্ত। তার মন খারাপ হয়ে যায় ছেলের সাথে কথা না বলতে পেরে। তাই আর দেরি না করে আমার শোবার ঘর দেখিয়ে দিয়ে নিজে ঘুমাতে চলে গেলেন। ঘরে কোনো খাট নেই। ফাঁকা ফ্লোরে চাটাই মোড়া। দেয়ালে দেয়ালে আলমারির মতো সেলফ। জিনিসপত্র, বিছানাপত্র এখানে রাখা আছে। আমাকে এসব দেখিয়ে দিয়ে নিজেই বিছানা করে নিয়ে সকালে আবার ভাঁজ করে রাখতে বলে গেলেন। জাপানে সবাই নিজের কাজ নিজে করে। অন্যকে সাহায্য করার মতো সময় নেই। ঊপযড় যেয়ে শুয়ে পড়ার পর আমি তার স্বামীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করি। তিনি ইংরেজি কম বোঝেন। তাই সমস্যা ছিল। তবে ভদ্রলোক খুবই ভালো এবং শান্ত মেজাজের। আমি এসে শুয়ে পড়ার অনেক পর ভদ্রলোক ঘুমাতে যান।

হোম স্টে-এর প্রথম রাত বস্তুতপক্ষে অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছি। সারারাত ভীষণ ঝড়োবাতাস, ভয় হচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল, সেভ সেরে আসতেই দেখি নাস্তা রেডি। পাউরুটি, মাখন এবং চা। সাথে আছে আঙুর ফল। তখনো বাতাস বইছিল। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হয় ঘূর্ণিঝড়। আমি আবহাওয়া রিপোর্ট জানতে চাইলাম। আমার হোস্ট মাদার বললেন, টাইফুন (মানে ঘূর্ণিঝড়) এগিয়ে আসছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সমুদ্রপাড়ের এ শহরে যদি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, তবে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আমার হোস্ট মাদার বললেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, টাইফুন আঘাত হানবে না। তিনি বললেন, চারিদিকে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় পাকা উঁচু দেয়াল ঘেরা আছে। টাইফুন এলে শক্ত দেয়ালে আঘাত পেয়ে দুর্বল হয়ে পানি আবার সমুদ্রে চলে যায়। আমার হোস্ট মাদার জানতে চাইলেন, তোমাদের দেশে টাইফুন, বন্যা বেশি বুঝি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কীভাবে জানলে? উত্তরে তিনি বললেন, টিভিতে সেসব দৃশ্য আমরা দেখি। তিনি ১৯৮৮ সালে বন্যা এবং ’৯১-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের দৃশ্য ও মানুষের লাশের দৃশ্য দেখার কথা জানিয়ে বললেন, ‘আমরা ইকোহামা এলাকা থেকেও বাংলাদেশের দুর্গত জনগণের জন্য চাঁদা তুলে সাহায্য পাঠিয়েছি।’

নাস্তার টেবিলে কথা বলতে বলতে আমার হোস্ট ফাদার মি. ফুজিওশির এক বন্ধু আসেন। তখন সকাল প্রায় ১০টা। ঝড় কমে রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা আকাশে। ফুজিওশি জানালেন, আমাকে তার বন্ধুর সাথে যেতে হবে। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য হিরোকে ডেকে এনেছেন। তিনি আমাকে ইকোহামা ঘুরিয়ে দেখাবেন। তাঁর গাড়িতেই রওনা হলাম। জাপানে তখন গ্রীষ্মকাল। আগস্ট থেকে অক্টোবর গ্রীষ্মকাল। এ সময় জাপানের স্কুলে স্কুলে স্পোর্টস হয়। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা দল বেঁধে পিকনিকে যায়। হিরো প্রথমেই আমাকে নিয়ে গেলেন একটি হাইস্কুলের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে। এ স্কুলে তাঁর ছেলেও পড়াশোনা করে। আমাদের দেশের মতোই মাইকে ধারাবিবরণী, খেলাধুলা প্রায় একই রকম। তবে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী ট্র্যাকসুট পরিহিত। অনুষ্ঠানে অতিথির জন্য আলাদা ব্যবস্থা। আমাকে অতিথিদের সাথে বসানো হলো। শিক্ষকরা বেশ খাতির-যত্ন করলেন। ইংরেজি শিক্ষক দীর্ঘক্ষণ এসে আমার সাথে কথা বললেন। দুপুরে প্যাকেট লাঞ্চ দিয়ে সব ছাত্রছাত্রী এবং অতিথিকে আপ্যায়ন করা হলো। স্পোর্টসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দলবদ্ধ ছাত্রদের নব নব আবিষ্কারের প্রদর্শনী। তিনটি গ্রুপে বিভক্ত ছাত্ররা বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলে এমন কিছু দৃশ্য এবং ঘটনা তুলে ধরে, যাতে ছিল উন্নত জাপানের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিভার ছাপ। তিন গ্রুপ তিন রকমের কলাকৌশল দেখায়। দর্শকদের কাগজ-পেনসিল সরবরাহ করে ভোটের মাধ্যমে তাদের একদলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ক্রীড়ানুষ্ঠানের সময়টুকু ভালোই কাটল।

আমাদের দেশের মতো যেখানে সেখানে সংবাদপত্র পাওয়া যায় না। প্রায় ৫ মিনিট গাড়ি চালিয়ে যেয়ে সংবাদপত্র নিয়ে ফিরে এলাম হোস্টের বাড়িতে। বিদায় হিরো। কোনোদিন আর দেখা হবে, এমনটি নিতান্তই কল্পনা মাত্র। স্কুল থেকে ফিরে এসে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। উঠি সন্ধ্যা ৬টায়। উঠে সংবাদপত্র পড়ে, টিভি দেখতে বসি। ৮টায় রাতের খাবার দিলেন হোস্ট মাদার। টুকটাক কথা হলো। হোস্ট মাদার জানালেন, তারা বাংলাদেশে ভ্রমণের ইচ্ছা রাখেন। বছর-দুবছরে একবার তারা জাপানের বাইরে বেড়াতে যান। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে আসবেন। আমি বললাম আপনাদের বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে পারলে আমি খুবই খুশি হব। তিনি কথা বলতে বলতে ঘড়ি দেখছিলেন। বার বার ঘড়ি দেখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আজ তার ছেলে আসবে কথা দিয়েছে। কিন্তু না, সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এলো না। পরে টেলিফোন। ছেলের অ্যাপার্টমেন্টে টেলিফোন করে জানলেন ছেলে রওনা দিয়েছে, রাস্তায় আছে। টেলিফোন কেউ না ধরায় তিনি এ মনোভাব ব্যক্ত করলেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন শুনি তাঁর ছেলে গভীর রাতে টেলিফোনে বলেছে আজ আসবে।

সকালে নাস্তা সেরে চা খাচ্ছিলাম। হোস্ট মাদার এসে বললেন হোস্ট ফাদারের সাথে বাগান পরিষ্কারের কাজ করার জন্য। জাপানিরা নিজ হাতে সব কাজ করে। ছুটির দুদিন সপ্তাহে ধোয়ামোছা, ঝাড় দেয়ার কাজগুলো নিজেরাই সারে। আর এ সময় কোনো অতিথি এলে তারাও এসব কাজে অংশ নিয়ে থাকেন। কাজ এবং কাজই তাদের জীবন। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। আমাদের দেশের মতো কাজের লোক নেই। সে কারণে সব করতে হয় নিজেদের। বৃদ্ধ বয়সেও হোস্ট মাদার কাপড় কাঁচেন, রান্না করেন এবং ঘর মোছার কাজ করেন। তারপর আবার চাকরি। আমাদের দেশে এমনটি অকল্পনীয়। আমরা দুজন বাগান পরিষ্কার করার কাজে লেগে যাই। ঝরা পাতা এবং ছোট গাছ পরিষ্কার করে দূরে নির্দিষ্ট বাক্সে ফেলে আসি। মি. ফুজিওশি তার অটোমেটিক ক্যামেরা দিয়ে আমার সঙ্গে বেশ কিছু ছবিও তুললেন।

কাজ শেষ করে এসে চা খাওয়ার সময় তাদের একমাত্র সন্তান ইয়োতোরো (ণধঃধৎড়) গাড়ি করে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে। মা ঊপযড় দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন এই বলে যে, আমার ছেলে তোমাকে তোমার বাড়িতে স্বাগত। ছেলেকে বাইরে থেকে প্রায় আধা কোলা করে মা ঘরে নিয়ে এলেন আমার কাছে। ২৫-২৬ বছরের জাপানি যুবক, বেশ স্মার্ট। মা ছেলেকে আমার সাথে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন রান্না ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার এলো। এরই মধ্যে ইয়োতোরো যে পত্রিকায় কাজ করে সে পত্রিকায় প্রকাশিত তার বিভিন্ন রিপোর্ট, বিশেষ করে জাপানে বসবাসরত বাঙালিদের সম্পর্কে কয়েকটি রিপোর্টের কাটিং বের করে আমাকে দেখায়। সে জানায় তার বেশ কিছু বাঙালি বন্ধু আছে। এদের কয়েকজন অবৈধভাবে জাপানে আছে। তারা বেশ কষ্ট করে চাকরি করছেন। ইয়োতোরো জানালেন বাঙালি বন্ধুদের সাথে সে একত্রে রাতে থেকেছে এবং রান্না করে খেয়েছে। তাই আমার সাথে সাক্ষাতে সে খুব খুশি।

ইয়োতোরোর সাথে অনেক কথা হলো। কথায় কথায় তার পত্রিকা মাইনচি শিম্বুন, কর্মস্থল ইয়ামানাসি এবং প্রেমের খবর পর্যন্ত বলে দিল। সে জানাল রাজধানী টোকিওতে কাজ করার ব্যাপারে সে বেশি আগ্রহী। কিন্তু এ জন্য তাকে আরো ভালোভাবে কাজ শিখতে হবে। মাইনচি শিম্বুন এত ভালো সংবাদপত্র নয়। তার ইচ্ছা সে একদিন ইউমুরি অথবা আশাই শিম্বুনে আসতে পারবে। অনর্গল কথা বলছিল ইয়োতোরো। সে জানাল বার্মার মেয়ে মরিয়মের সাথে তার প্রেম। মরিয়ম জাপানের ইয়ামানাসিতে এক হোটেলে চাকরি করে। সেখানেই পরিচয় এবং পরিচয় থেকে প্রেম। মরিয়মকে সে বিয়ে করবে বলে জানায়। মরিয়মের আরেক বোনের বিয়ে হয়েছে থাইল্যান্ডের এক যুবকের সাথে। তারা দুজনই জাপানে থাকেন। পিতা-মাতার সামনেই ইয়োতোরো সিগারেট ফুঁকছিল। জাপানি সমাজে বর্তমানকালে বয়স্ক ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে নেয়। পিতা-মাতার সাথে জন্মের বন্ধন ছাড়া তেমন কিছু একটা থাকে না। তারা আলাদা বাস করে। ইয়োতোরো জাপানের রাজনীতি-অর্থনীতি আলোচনাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে। তার মতে জাপানের তাবৎ সমস্যার মধ্যে বর্তমান কালের মূল সমস্যা হলো পরিবেশ সমস্যা।

কথা বলতে বলতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। খেয়েই ইয়োতোরো চলে গেল দোতলায় গাড়ি চালিয়ে অনেক দূর থেকে এসেছে। তাই তাকে ঘুমোতে হবে। আমাকে বলে গেল ৪টায় তৈরি থাকবে। আমরা বেরুব। ইকোহামা সিটি তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাব। বাড়ির নিচতলায় বাবা-মা থাকেন। ইয়োতোরো এলে ওপর তলা খোলা হয়। সবাই শুতে গেলে আমিও ঘুমোতে চেষ্টা করি। কিন্তু ঘুম আসছিল না। ঠিক সাড়ে ৩টায় হোস্ট মাদার আমাকে ডেকে তুলে দিয়ে দোতলা থেকে ইয়োতোরোকেও নিয়ে আসে। চা পান করে ইয়োতোরোর গাড়িতে করে শহর দেখতে বেরুই। প্রথমেই ইকোহোমা বন্দর। জাপানের বৃহত্তম এবং বিশে^র অন্যতম বৃহত্তম বন্দর। হাজার হাজার বিদেশি ও জাপানি নাগরিক প্রতিদিন এ বন্দর দেখতে আসে। বন্দরে রাখা বিশাল বিশাল পন্টুন দিয়ে নদীর ওপরে অনেক দূর যাওয়া যায়। পানি কোথাও নীল, কোথাও কাল রং। পন্টুন পার হয়ে আমি আর ইয়োতোরো একটি বিরাটকায় জাহাজে উঠে হাঁটতে থাকি। এত বড় জাহাজ হাঁটা যেন শেষ হচ্ছিল না। গভীর সমুদ্র পর্যন্ত অনেক জাহাজ নোঙর করা। প্রতিদিন বিশে^র বিভিন্ন স্থান থেকে জাহাজ আসছে-যাচ্ছে।

ঘণ্টাখানেক সমুদ্রের ওপর হাঁটাহাঁটি করে যাই ইকোহামা ব্রিজ দেখতে। ৮৬০ মিটার দীর্ঘ এ ব্রিজ নতুন ইকোহামার পরিচয় বহন করে আছে। ব্রিজের ওপর ও নিচ দিয়ে দুটি হাইওয়ে। এমনভাবে ব্রিজটি করা হয়েছে দূর থেকে দেখলে মনে হয় এটি গোলাকার বৃত্ত। আসলে গোলাকারভাবে শুরু হলেও পরে সোজা। ব্রিজটির মাঝের অংশ বেশ ওপরে। ৩৬০ মিটার ওপরের উঁচু অংশ দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য লোক জড়ো হয়। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আকাশে হাঁটা।’ বেশির ভাগ যুগলকে সেখানে পাওয়া যায় বাহুবন্দি। গাড়ি থামিয়ে পরিবারের সদস্যরাও দল বেঁধে হাঁটাহাঁটি করে। সমুদ্রের ওপর নির্মল বাতাস। সারা শহর দেখা যায় সেখান থেকে। ছবি তোলার জন্য খুবই সুন্দর স্থান। আমি ক্যামেরা বের করলাম। ইয়োতোরোকে দিলাম ছবি তুলতে। কিন্তু আমার ক্যামেরা কাজ করছে না। যে কারণে আর ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। তাই ইয়োতোরোর সাথে আমার সে ব্রিজের কোনো স্মৃতিচিহ্ন রাখা সম্ভব হয়নি।

ব্রিজের ওপর বসে ইয়োতোরো জাপান এবং ইকোহামার অনেক ইতিহাস আমার কাছে বর্ণনা করে। ব্রিজের নিচে বিরাট শপিং কমপ্লেক্স, সাথে রেস্টুরেন্ট। ইয়োতোরো শপিং কমপ্লেক্স থেকে ইকোহামার মনোগ্রাম সম্বলিত একটা স্কার্ফ কিনে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটি তোমার স্ত্রীর জন্য আমার প্রেজেন্টেশন। ঘুরতে ঘুরতে ৬টা বেজে যায়। ইয়োতোরো মাঝে আমাকে জানিয়ে রাখে ঠিক ৭টায় তাকে ইকোহামা রেল স্টেশনে থাকতে হবে। মরিয়ম আসবে ইয়ামানাসি থেকে। একা একা গাড়ি চালিয়ে রাতে ফেরার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য মরিয়মকে বলে এসেছে ইকোহামাতে আসার জন্য। পরে দুজন একসাথে চলে যাবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি মরিয়মকে সত্যিই বিয়ে করবে? উত্তরে সে বলল, অবশ্যই। জাপানি যুবক বার্মিজ কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারিবারিক বা সামাজিক কিছু বাধা আছে কি না, জানতে চাইলে সে বলে, কোনো বাধা নেই। জাপানি যুবকরা নিজেদের স্বাধীন সত্তা নিয়ে চলে। লেখাপড়া শেষ হলে তাদের ইচ্ছামতো কাজ এবং সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে।

ব্রিজ থেকে ইয়োতোরো আমাকে চায়না টাউনে নিয়ে আসে। চায়না টাউন হচ্ছে জাপানে বসবাসরত চীনা নাগরিকদের সমৃদ্ধ বৃহত্তম বাস এলাকা। এখানে রয়েছে শতাধিক চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন ধরনের দোকান এবং আমোদ-প্রমোদের আয়োজন। চীনা নাগরিকরাই ওসব ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে।

৭টার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে আমরা ইকোহামা রেল স্টেশনের গাড়ি পার্কিং পয়েন্টে গিয়ে পৌঁছি। আমি গাড়িতেই বসে থাকি। ইয়োতোরো নেমে যেয়ে স্টেশন থেকে কয়েক মিনিটের মাথায় তার ভবিষ্যৎ স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে আসে গাড়িতে। চটপটে তরুণী। অনর্গল জাপানি বলছিল। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি মরিয়মের কাছে বার্মা সম্পর্কে জানতে চাই। সে দেশের সামরিক শাসক, আমাদের দেশে বর্মি লাখ লাখ উদ্বাস্তু জেলে আটক, বর্মি নেত্রী অং সান সুচি বিষয়ে প্রশ্ন করলে মরিয়ম তেমন উৎসাহ দেখায়নি। মরিয়ম জানাল সে জাপানে এসেছে আর যাবে না, এখানেই থাকবে। তাই বার্মা নিয়ে চিন্তা করে না। মরিয়ম ইয়োতোরোর প্রেমে এত বিভোর, অন্যকিছু যেন চিন্তা করার অবকাশ নেই। একই অবস্থা ইয়োতোরোর। কথা বলতে বলতে আমরা বাসার কাছে এসে পৌঁছি। গাড়ি থেকে আমি নেমে গেলেও তারা দুজন নামতে দেরি করে। আমি প্রশ্ন করতেই ইয়োতোরো জানাল মরিয়ম লজ্জা পাচ্ছে। মরিয়ম এর আগে কখনো এখানে আসেনি। মা-বাবা কেমন করে গ্রহণ করবে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম, এত দূরে থেকে হৃদয়ের টানে যখন এসেই পড়েছো তাহলে আর এখন লজ্জা করে লাভ কি? তারা কানে কানে ফিসফিসিয়ে কি বলতে থাকে। আমি ভেতরে চলে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দুজন ঘরে প্রবেশ করে। মরিয়ম খাস জাপানি কায়দায় ঊরশড় কে সালাম জানাল। ঊরশড় মরিয়মকে নিয়ে সরাসরি ডাইনিং টেবিলে বসল। কতক্ষণ পরে এলো ঋঁলরংযড়. প্রাণখোলা লোক। ভবিষ্যৎ পুত্রবধূকে অভিনন্দন জানালেন। এরই মধ্যে ঊরশড় চলে যান রান্না ঘরে। খাবার নিয়ে এলেন কিছুক্ষণের মধ্যে। ঊরশড়-কে কিছুটা বিরক্ত মনে হল। কিন্তু ঋঁলরংযড় আনন্দিত।

ইয়োতোরো ও মরিয়ম সামান্য কিছু খেয়ে রাত ৯টার দিকে রওনা দিল ইয়ামানসির উদ্দেশ্যে। মা ঊরশড় তাদের হাতে খাবারের একটি পুটলি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, রাস্তায় যেন এসব খেয়ে নেয়। আমরা তাদের বিদায় জানালাম, ইয়োতোরো আমাকে বলল, ‘বিদায়, আবার দেখা হবে’। তাঁরা চলে যাওয়ার পর ঊরশড় আমাকে বললেন, আমাদের সকাল ৯টার মধ্যে পৌঁছুতে হবে। এ জন্য বাসা থেকে বেরুতে হবে ৭টায়। ইকোহামার শেষ রাত। সকালেই বিমানে যাব হিরোশিমা। আতিথেয়তার কথা মনে থাকবে। তিন দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ভোর হয়ে যায়। আমি তৈরি হয়ে নিই সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে। পৌনে ৭টায় নাস্তা দিলেন ঊরশড়. আমরা সবাই একসঙ্গে নাস্তা খেয়ে নিই। ৭টায় স্টেশনের উদ্দশ্যে রওনা দিয়ে পথে একটি স্টুডিওর সম্মুখে গাড়ি থামিয়ে ঋঁলরংযড় ছবি নিয়ে আসে, ছবিগুলো আমার হাতে দিয়ে বলেন এগুলো ইকোহামায় তোমার স্মৃতি। ট্রেনে তুলে দিয়ে ঋঁলরংযড় বিদায় নেন। ঊরশড় আমাকে ইকোহামা সিটি বিমান টার্মিনালে নিয়ে আসেন। ততক্ষণে টার্মিনালে কয়েকজন ফেলো এসে পৌঁছেছেন। তিনদিন পর তাদের সাথে কথা- অভিজ্ঞতা বর্ণনা। ইন্টারেস্টিং সব অভিজ্ঞতা। ঊরশড়-র স্কুলে যেতে হবে ১০টায়। অনেক দূরে। তিনিও বিদায় নিলেন।

তিনদিন যাকে ‘মা’ বলে ডেকেছি, সত্যিই তিনি মায়ের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। পছন্দমতো রান্না করে খাইয়েছেন। তাই তার বিদায়ের সময় আবেগাপ্লুত না হয়ে পারিনি। তিনিও রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বিদায় নিলেন। ৯টার মধ্যে সবাই এসে পৌঁছে গেলে আমরা বিমানের একটা বাসে চড়ে রওনা দিই বিমানবন্দরের উদ্দেশে। শহর থেকে অনেক দূরে বিমানবন্দর। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি স্কুল ড্রেস পরা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী। সব লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ কী, জানতে চাইলে আমাদের গাইড জানালেন জাপানে এখন গ্রীষ্মকাল। ছাত্র-ছাত্রীরা পিকনিক করতে বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। দল বেঁধে তারা পিকনিকে যায়। বিমানবন্দরে যখন অপেক্ষা করছিলাম হঠাৎ দেখি ছাত্র-ছাত্রীরা সব দৌঁড়াচ্ছে। সব লাইন ভাঙা, বিশৃঙ্খল অবস্থা। কোথাও কিছু হয়েছে কি না, এগিয়ে যাই আমরাও। গিয়ে দেখি এক সুমো প্লেয়ার। জাপানে সুমো খেলা খুবই প্রিয়। আমাদের কুস্তিগিরের মতো দেখতে বিশালদেহী লোক। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা লাইন ভেঙে গিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন- চেরি ফুলের দেশে পর্ব ১১

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত