ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২১, ০০:২৮

চেরি ফুলের দেশে

১৬. কিওটো

ওকাইয়ামা থেকে ২ অক্টোবর রওনা হওয়ার আগে আমরা হায়াসাবারা জাদুঘর ও গ্রিন পার্ক পরিদর্শনে যাই। পার্কে ঘণ্টাখানেক অবস্থানকালে মি. রইস আমাদের সাথে ছিলেন। বুলেট ট্রেনে ১১টায় রওনা দিয়ে ঠিক ২টায় আমরা কিওটোর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষে এসে পৌঁছি। কিওটো জাপানের অন্যতম আধুনিক শহর। টোকিও-র পর এ শহরে বিদেশিদের আনাগোনা বেশি। পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় শহর। ওকাইয়ামা ও হিরোশিমা খুবই নিরিবিলি শহর। কিওটো কিন্তু তা নয়। কিওটোর মেজাজ সাধারণ জাপানের মতো নয়। পাশ্চাত্যের ঢঙে গড়ে উঠেছে কিওটোর জীবন। রাস্তায় তরুণ-তরুণীদের ভিড়। বিদেশিদের ভিড়। ব্যস্ত শহর। গভীর রাত পর্যন্ত শহর জেগে থাকে। শহরের আকর্ষণ অনেক। যার কারণে এখনও হাজার হাজার পর্যটক আসে। কিওটো এককালে জাপানের রাজধানী ছিল। বর্তমানে প্রধান আকর্ষণ হলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। ৩৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সম্মেলন কেন্দ্রে প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনো সম্মেলন হয়ে থাকে। এর মধ্যে অধিকাংশই আন্তর্জাতিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম। সে কারণে অসংখ্য বিদেশি আসা-যাওয়া করে। কিওটো সম্মেলন কেন্দ্রের ২শ’ কক্ষ রয়েছে। মূল হলে রয়েছে ২ হাজার আসন। বছরে ৩শ’ দিন মূল হলে কোনো না কোনো সম্মেলন হয়। এছাড়া ছোট ছোট অসংখ্য সভা-সমাবেশ হয়। আমরা

যেদিন সম্মেলন কেন্দ্র পরিদর্শনে যাই সেদিন সারা জাপান শিক্ষকদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রের ভিতরেই রয়েছে অনেক কমিটি কক্ষ, অভ্যর্থনা কক্ষ, বার, ক্লাব, রেস্টুরেন্ট, হোটেল। স্থাপত্য কারুকাজে আধুনিক তৈরি সম্মেলন কেন্দ্রটি সবারই দৃষ্টি কাড়ে। কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষ আমাদের ঘুরিয়ে দেখান আন্তর্জাতিক লিয়াজোঁ সেকশনের কর্মকর্তা ও তার সহকর্মীরা। পরে এ কেন্দ্রের প্রেসিডেন্টের সাথেও আমাদের কথা হয়। এটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ২ কোটি লোকের বাসস্থান কিওটোতে এককালে কমিউনিস্টদের শক্তিশালী সংগঠন ছিল। জাপানের একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কিওটোর বাসিন্দা। ১৮৬৮ সালে তৎকালীন সম্রাট কিওটা থেকে টোকিওতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। প্রায় ৩ হাজার মন্দির এবং বিভিন্ন উপাসনালয় আছে কিওটোতে।

কিওটোতে অবস্থানকালে আমরা জাপানি ঐতিহ্যবাহী নাচ দেখতে যাই। পুরনো শহরে একটা ছোট হলে নাচের ব্যবস্থা। অনুষ্ঠান হলে একশ’র মতো আসন আছে। একটি শো শুরু হলেও পরের শো’র জন্য লোক দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমেই দেখানো হয় জাপানি ঐতিহ্যবাহী চা উৎসব। চা উৎসবে চা তৈরি করে অতিথিকে পরিবেশন করা হয়। ১৫ শতক থেকে জাপানে চা উৎসব চলে আসছে। জাপানিদের খুবই প্রিয় উৎসব। বিভিন্ন অভিজাত এমনকি অপেক্ষাকৃত কম আয়ের লোকেরাও এ উৎসবের আয়োজন করে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আপ্যায়িত করে। এ জন্য গ্রাম এলাকায় বা শহরে যাদের বাড়ি আছে তাদের প্রত্যেক বাড়িতেই চা উৎসবের জন্য আলাদা ছোট ঘর রয়েছে। এ ছোট ঘরেই চা উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রথমেই এক তরুণী কারুকাজ করা বেশ কিছু চা তৈরির সরঞ্জাম এক ধরনের চুলা নিয়ে এসে কারুকাজখচিত এক কাপে চা তৈরি করে এবং অতিথিকে বসিয়ে তা পান করায়। চা উৎসবে জাপানিদের জন্য বেশ কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম আছে। যা অতিথি এবং আমন্ত্রণকারী উভয়কেই পালন করতে হয়। চা উৎসবের পর পুরনো ঐতিহ্য থেকে শুরু করে বর্তমান ঐতিহ্যের কয়েকটা নাচ ও গান পরিবেশন করা হয়। বিদেশী দর্শকরা এসব উপভোগ করে থাকেন।

টোকিও-র বাইরে কয়েকদিনের বিরামহীন ভ্রমণ এবং ঠিকমতো বিশ্রামের অভাবে আসলে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। প্রদর্শনীর অর্ধেক সময়েই আমি হল থেকে বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। ক্লান্তির কারণে আমার তেমন ভালো লাগছিল না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটির সময় দেখি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রকম মানুষ। পরের শো’র জন্য অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে আমার বাংলাদেশের মতো একজনকে মনে হলো। আমি তার দিকে তাকাই। ভদ্রলোকও আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। তিনি এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন? আমি বললাম, না। ভদ্রলোক লাফ দিয়ে উঠলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমিও বাংলাদেশের। ভাবিইনি বাংলাদেশের কারও সাথে দেখা হবে। আসলে বিদেশে নিজ দেশের না হলেও কাছাকাছি দেশের লোক পাওয়া গেলেও যে কি আনন্দ কল্পনা করা যায় না। ভদ্রলোকের নাম ডা. সেলিম। নিপসমের ডাক্তার। এক নিঃশ্বাসে তিনি জানালেন ৪ মাসের একটি কোর্সে তিনি জাপানে আছেন। ২ মাস হয়েছে, আরও ২ মাস থাকতে হবে। কথায় কথায় জানালেন তার স্ত্রী ডা. নাসরীনও নিপসমে আছেন। টেলিফোন নম্বর দিলেন ঢাকায় গিয়ে যেন বাসায় জানাই তিনি ভালো আছেন। ডা. সেলিম কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কোর্সমেট বিভিন্ন দেশের ডাক্তারদের আমার কাছে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন। দীর্ঘদিন পরে আমি বাংলায় কথা বলতে পেরে যেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম।

সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একদল বিদেশি মহিলা এসে প্রবেশ করেন হলে। এদের মধ্যে একজন মহিলাকে লক্ষ্য করলাম সালোয়ার-কামিজ পরা বিমর্ষ অবস্থায়। ডা. সেলিম বললেন, মহিলা মনে হয় আমাদের দেশি। আসলে তাই হলো। মহিলা দৌঁড়ে এলেন আমাদের দেখে। প্রথম দফায় জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কি বাংলাদেশের? আমরা বললাম হ্যাঁ। মহিলা হাঁফ ছেড়ে বললেন, ৪ মাস পরে দেশের মানুষ পেলাম। বাংলায় কথা বললাম। তার নাম স্বপ্না। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নার্স। ১০ মাসের ট্রেনিং। ৪ মাস হয়েছে, আরও ৬ মাস থাকতে হবে। মহিলা প্রায় কেঁদেই ফেললেন দেশের কথা বলে। ততক্ষণে শো শেষ। আমার সহকর্মী ফেলোরা বের হয়ে এসেছেন। আমি তাদের পরিচয় করিয়ে দিলাম ডা. সেলিম ও স্বপ্নার সাথে। গাড়ি রেডি, ছক বাঁধা সফরসূচি, দেরির কোনো উপায় নেই। তাদের বললাম, বিদায়। ডা. সেলিম ও স্বপ্না বললেন, আরেকটু কথা বলতে পারব না? ততক্ষণে আমার সহকর্মীরা গাড়িতে উঠে বসে গেছেন। গ্রুপের সাথে যেতে না পারলে কোথায় যাব কীভাবে যাব জানা ছিল না। তাই আর কথা হলো না। বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে তবুও দেখি তারা দাঁড়িয়ে। আমরা ফিরে আসি গ্রান্ড হোটেলে। রাতে আর কোনও কর্মসূচি নেই। কিন্তু সারাদিন ক্লান্তির পরও রাতে হোটেলে ঘুম না হওয়া আসলে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

৩ অক্টোবর শনিবার। কিওটো গ্রান্ড হোটেল থেকে বের হযে আমরা প্রথমেই দেখতে যাই প্রাচীন এক প্রাসাদ। এ প্রাসাদে থাকতেন জাপানের সাবেক শাসক শগুন সম্রাটের উপরে ছিলেন শগুন। বংশপরম্পরাগত সেনাধ্যক্ষ। অর্থাৎ প্রকৃত শাসক। ১৮৬৮ সাল থেকে এ পদ বিলুপ্ত। প্রাসাদে প্রবেশের পথে একটি ট্যাঙ্কিতে পানি এবং বড় হাতওয়ালা চামচ রাখা আছে। দর্শক যারা এখানে আসেন তারা এ পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দেন। এ পানিতে হাত ধুলে পবিত্র হওয়া যায় এবং মনোবাসনা পূরণ হয় এমন ধারণা আছে। তাই অনেকে হাত-মুখ ধুয়েই প্রাসাদে প্রবেশ করেন। বিরাট প্রাসাদ। ৫টা বড় ভবন। পুরোনো এবং ক্ষয়িষ্ণু হলেও স্থাপত্য নকশার উজ্জ্বলতা স্পষ্ট। প্রতিদিন হাজার হাজার জাপানিসহ বিদেশী পর্যটক আসে দেখতে। প্রাসাদের ভিতরে শগুন যেখানে থাকতেন, যে বিছানায় শুতেন যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন সবই রক্ষিত আছে। তাছাড়া ডামি শগুন তৈরি করে রাখা হয়েছে। তাঁর কর্মকর্তা, স্ত্রী, উপ-পত্নী, রক্ষিতা এবং অসংখ্য সেবিকার ডামিও আছে। প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষে রক্ষিত ডামি এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যাতে বোঝা যায় শগুনের সাথে সাক্ষাৎ করতে হলে কত জনকে ডিঙ্গিয়ে যেতে হতো। এক কক্ষে শগুনের সাথে কয়েকজন সুন্দরী রক্ষিতা ও সেবিকার আনন্দ-ফূর্তির দৃশ্যও দেখা যায়। প্রাসাদের চারিদিকে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া, পুকুর এবং লেক।

প্রাসাদের ভিতরেই আছে শেরিন। পবিত্র স্থান বা তীর্থ মন্দির। এ তীর্থ মন্দিরে বিয়েসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে। শেরিনে আমাদের জাপানি বিয়ের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়। জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনো পরে বিয়ে হয়। কনে পরে সাদা কিমানো আর অন্যরা রং-বেরং এর কিমোনো। আর বর পরে কালো রং-এর সাথে অন্য কোন রং-এর কিমোনো। জাপানের বিয়ে মানে আমাদের মত হৈ চৈ, মহা উল্লাস নয়। বর ও কনের নিকটাত্মীয়রা বিয়েতে শুধু উপস্থিত থাকে। কনেকে নিয়ে কনে পক্ষ প্রথমে তীর্থস্থান শেরিন আসে। প্রতি শেরিনে পারিবারিক কক্ষ আছে। কনেকে এখানেই সাজানো হয়। বরকেও অন্য কক্ষে সাজানো হয়। বিউটি পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান এনে সাজানোর রেওয়াজ। বর-কনে সাজানোর পর পুরোহিত মন্ত্র পড়িয়ে বিয়ের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। পরে মিষ্টি বিতরণ। একপক্ষ অপরপক্ষের সাথে পরিচিত হয়। বর ও কনে বাইরে নিয়ে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ছবি তোলা হয়। প্রথমে বিবাহের যুগল ছবি পরে পারিবারিক। ছবি তোলার জন্য বাইরে থেকে ফটোগ্রাফার আনতে হয়। ছবি তোলার পর বিশ্রাম নিয়ে গিয়ে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর কনেকে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। জাপানের প্রত্যেক নব দম্পতি বিয়ের পর হানিমুনে যায় দেশের বাইরে। সাধ্যমতো ইউরোপ, আমেরিকা অথবা এশিয়ার কোনো দেশে। প্রচলিত আছে যে একমাত্র হানিমুনের সময়টুকু ছাড়া জাপানি স্ত্রীরা স্বামীকে এত আপন করে আর কাছে পায় না। হানিমুন শেষে আবার কাজে ডুবে যায়। জীবন চলে জাপানি স্বাভাবিক গতানুগতিক ছকে। এক হিসাবে জানা গেছে, জাপানের প্রতি দম্পতি তাদের বিয়েতে গড়ে ৭ মিলিয়ন ইয়েন ব্যয় করে। বিয়ে সে দেশে খুবই ব্যয়বহুল।

দু’টো বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে আমরা মধ্য কিওটোতে টেক্সটাইল প্রদর্শনী দেখতে আসি। স্থায়ী প্রদর্শনী। বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে আসে। কাপড় ক্রয় করে। এখানে একটা মঞ্চ রয়েছে। মঞ্চে জাপানি বিভিন্ন তাঁতের কাপড় প্রদর্শনী হয়। ছয় তরুণী মডেল বিভিন্ন রং-এর কাপড় বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে প্রদর্শন করে। সাজসজ্জা ও মেকআপে মঞ্চের আলোতে তাঁদের পুতুলের মতো মনে হয়। তাঁত প্রদর্শনীর পর আমরা যাই হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে। এখানে হাতে তৈরি জিনিসের সমাহার, সাথে গহনা, ক্যামেরা, ইলেকট্রোনিক্স-এর দ্রব্য অনেক। ৬ তলা ভবনের প্রতি তলায়ই বিবিন্ন ধরনের দ্রব্য। এখানে আবার দেখা হলো ডা. সেলিমের সাথে।

দু’টুকরো চিকেন আর একটা বিফ বার্গার, প্রায় সবাই এক ধরনের লাঞ্চ করে কিওটো তথা জাপানের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মন্দিরে যাই। কাঠের ঘরে এক হাজার একটা মূর্তিসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মীয় মূর্তি রাখা আছে। জাপানি ভাষায় একে পবিত্র সেনজুসাংগেনডো) ঝধহলঁংধহমবহফড় বলা হয়। ১১৬৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সম্রাট ছড়ংযরৎধশধধি-এর আমলে এ মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দিরটি ১১৮ মিটার লম্বা। ১৮ মিটার প্রশস্ত মন্দিরের মধ্য হলে মূল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। যাকে ক্যানন নামে ডাকা হয়। ১১টা মুখ এবং এক হাজার হাত আছে এ মূর্তির। বৌদ্ধ মন্দির থেকে আমরা যাই কিওটো শহরের মধ্যভাগে আদি জাপানি রেস্তোরাঁয়। জাপানে এখন পশ্চিমা বাতাস। খাবার-দাবারেও এ ছোঁয়া লেগেছে। পশ্চিমা স্টাইলে জাপানি মিক্সড খাবারই বেশিরভাগ হোটেলে পরিবেশিত হয়। এফপিসি’র পক্ষ থেকে কিওটোতে আদি জাপানি রেস্তোরাঁয় নৈশভোজের আয়োজন। তখনও সূর্য অস্ত যায়নি। আমরা ছোট এক ভবনের দোতলায় গিয়ে ফ্লোরে বসি। চেয়ার-টেবিল নেই। ফ্লোরে চাটাই পাতা। মাঝে গ্যাসের চুল্লি। ডিম রাখা আছে ঝুড়িতে।

আমাদের চুল্লির দুই পাশে লাইন ধরে বসানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই এল কিছু ভেজিটেবল এবং গরুর মাংস। তারপর নুডলস। ভেজিটেবল টুকরো করে কাটা। আর মাংস পাতলা পিস করা। ম্যাচের কাঠি দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দিলেন দুই বৃদ্ধা হোটেলের কর্মচারী। তারপর আমাদের রান্না করে খেতে বললেন। আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। কীভাবে রান্না করব? কীভাবে খাব? আজ নির্ঘাত উপবাস করতে হবে। আমার সাথের ফেলোরা সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এফপিসি’র ইয়ানো সান সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এসব জাপানের খুবই সুস্বাদু খাবার। মূল্যও অনেক বেশি। এই বলে ইয়ানো সান একটা ডিম ফুটিয়ে কাঁচা খেয়ে ফেলে। তারপর তেলের মতো এক ধরনের তরল পদার্থ গ্যাসের চুলার উপর ঢেলে ভেজিটেবলের টুকরা এবং নুডলস ছেড়ে দিল। আধা সিদ্ধ তুলে সে নিজেও নিল, অন্য দু’জনকেও খেতে দিল। দক্ষিণ আফ্রিকান প্রলা প্রথমে খেয়ে বলল, আসলেই টেস্ট। পরে আমরা যার যার চুলা ধরিয়ে কড়াইতে চড়িয়ে খাবার তৈরি করি। আমি বললাম কাঁচা ডিম অসম্ভব, আমি খেতে পারব না। তাই কড়াইতে ডিম ভাজি করি। গরুর মাংস সত্যিই অপূর্ব স্বাদের ছিল। লম্বা পাতলা পিস করা গরুর মাংস মসলা দিয়ে মাখানো। ভেজে ভেজে আমি অনেক খেয়েছি। আমরা দুই ঘণ্টা এ জাপানি হোটেলে বসে বসে রান্না করে খাই এবং যার যার দেশের গল্প করি।

রাত ৮টার দিকে রেস্তোরাঁ থেকে ফেরার সময় আলো জলমল লেকের ধারে দেখি সারি সারি যুবক-যুবতী। ব্যাপারটি আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। ইয়ানো সানকে জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা, এখানে এভাবে বসে আছে কেন? ইয়ানো সান বলল, এরা সবাই প্রেমিক-প্রেমিকা। তিনি জানান কিওটোর লেকের এ স্থানকে লাভার্স প্লেস (প্রেমিকদের স্থান) বলা হয়। লেকের পশ্চিম ধারে শত শত প্রেমিকযুগল এখানে আসে প্রতিদিন। কেউ এখানে এসে প্রেমবন্দী হয়, আবার কেউ কেউ আগে প্রেমবন্দী হয়ে আসে। প্রেমের জন্যই এ স্থান। ইয়ানো সান জানালো মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিটি যুগলই দুই মিটার করে দূরত্ব বজায় রেখে বসে। অর্থাৎ এমন করে প্রেমিক যুগলের বসার স্থান করা আছে যাতে প্রত্যেক তাদের যুগল অন্য যুগলের চাইতে দুই কিলোমিটার দূরে থাকে। কর্তৃপক্ষই এমন ব্যবস্থা করেছেন। যাতে গোপন কথাটি গোপনই থাকে। অন্য যুগল শুনতে না পারে। দূর থেকে তাদের বেশ সুন্দর লাগছে। কি নির্ঝঞ্ঝাট প্রেমের স্থান। এই মুহূর্তে যেন তাদের কোনও চিন্তা নেই। শুধু প্রেম আর প্রেম। চলবে...

আগের পর্ব (১৫) পড়ুন

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত