ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০১:৫১

চেরি ফুলের দেশে

১৯. ফেরার পথে ব্যাংককে

নারিতা থেকে ঠিক ৬ ঘণ্টার বিমান ভ্রমণ করে ব্যাংককে পৌঁছি স্থানীয় সমসয় সন্ধ্যা সোয়া ৬টায়। ব্যাংককের ভিসা ছিল না। তাই আগের মতো লাইনে দাঁড়াতে হল। দীর্ঘ লাইনের শতকরা ৯০ জনই বাঙালি। দেখেই বোঝা যায় এরা আদম। দু’একজন আদম ব্যবসায়ীকে পরিচিত মনে হল। লাইনে দাঁড়িয়ে কথা হয় নারায়ণগঞ্জের নজরুলের সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় যাচ্ছে। উত্তর দিতে পারেনি সে। একজনকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল তিনি জানেন। একই কথা আরও কয়েকজনের। ভিসা অফিসের সামনেই পরিচয় হয় ঢাকার এক আদম ব্যবসায়ীর সাব এজেন্টের সাথে। নিয়মিত ব্যাংকক আসা-যাওয়া করেন তিনি। আমাকে দেখে জানতে চায় কোত্থেকে এসেছি। আমি পরিচয় চাইলে জানায়, আমাকে তিনি চেনেন। তার কাছ থেকেই শুনলাম অনেক কাহিনী। কেমন করে আদম ব্যবসায়ীরা ব্যাংককে লোক নিয়ে আসে। কেমন হোটেলে রাখে। অতি নিম্নমানের হোটেলে এক রুমে ৭ জনকে রেখে তাদের মালয়েশিয়া বা অন্য কোথাও চালান দেয়ার চেষ্টা করে। ব্যাংকক থেকে ৪/৫শ’ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত শহর হাজ্জাই নিয়ে যায় গাড়িতে। সেখানে আবার অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে কেউ যেতে পারে, কেউ পারে না। আবার যারা যায় তাদেরও সবার চাকরি হয় না। প্রতারণার শিকারে পরিণত হয়ে যায় জেলে। বিদেশের স্বপ্নভঙ্গ হয়। জেলে মৃত্যুর প্রহর গুণে। ব্যাংককে নিয়ে আদম ব্যাপারীরা সবার টিকিট, পাসপোর্ট এবং ডলার নিয়ে নেয়। অসাধু আদম ব্যবসায়ীরা ফিরতি টিকিট ভাঙ্গিয়ে টাকা উঠিয়ে ফেলে। আর পাসপোর্ট অন্যের কাছে বিক্রি করে। এভাবে সর্বস্বান্ত হয় অনেকে। তাদের কেউ কেউ ব্যাংককে ভিক্ষাবৃত্তি করে, কেউ জেলে আবার কেউ বিমানবন্দরের আশেপাশে ঘুরে। কোন বাঙালি পেলে সাহায্য চায় কেউবা ভয় দেখিয়ে অর্থ নিতে চায়। সে আমাকে জানাল বাইরে আপনিও দু’একজন এমন পেতে পারেন। তার কথা শুনে আমি হতচকিত হয়ে যাই। আসলে কিভাবে প্রতারণা হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে এসে স্বদেশীরা কি বিপদেই না পড়ছে। কিন্তু উপায় নেই।

ইমিগ্রেশন পার হয়ে নিচে এসে সরাসরি পর্যটনের অফিসে যাই। কিন্তু তাদের হোটেলে রুম পাওয়া যায়নি। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষের বুথে যাই। পাঁচতারা, হোটেল পাওয়া যায় শুধু। এত অর্থ দিয়ে থাকার কোন মানে নেই। ব্যাংককে আগে আমি কারও সাথে যোগাযোগ করে যাইনি। তাই দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কি করব। ট্যাক্সি নিয়ে কি সোজা শহরে যাব? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই একজন বাঙালি আমার কাছে এসে জানতে চাইলেন কোত্থেকে আমিও তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি জানালেন বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। জাপান যেতে চান। কিন্তু ভিসা নেই। ব্যাংকক থেকে চেষ্টা করবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে মাসুদ রানা এর আগে সৌদি আরবে থেকে এসেছেন ৩ বছর। দেশে ভাল লাগে না। তাই আবার বিদেশে যেতে চান। ক’দিন আগেও ব্যাংককে এসেছিলেন। যেতে পারেননি। আবার এসেছেন। এবার নাকি তিনি কিছু লাইন করে এসেছেন। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন কোথায় থাকব? আমি বললাম, চিন্তা করছি। তিনি বললেন, চলুন শহরে যাই। দেখি কোথায় থাকা যায়। তাকে বিশ্বাস করা যায় কি যায় না একনজর দেখে নিলাম। প্রতারক মনে হল না। তবুও বেশকিছু সময় তার সাথে কথা বললাম। বুঝতে চেষ্টা করি। দু’জনে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০ টাকা দিয়ে ব্যাংকক বিমানবন্দরে দুটো কোকাকোলা পান করি। রাত ১০টায় দু’জনে বিমানবন্দরের একটি ট্যাক্সি দিয়ে রওনা হই শহরের দিকে। সাড়ে ১১টায় পুরাতন ব্যাংককের একটি রেস্ট হাউজে এসে পৌঁছি। রেস্ট হাউজটি দেখেই মনে হল ভাল হবে না। রুমে গিয়ে দেখি যা ভেবেছি তাই। কিন্তু কোন উপায় নেই। দু’জনে দু’রুম ভাড়া নিয়ে রাতটা কোনরকম কাটিয়ে দেই। আমি আর রাতে কোন কিছু খাইনি। রুচি ছিল না। বিমানে যা খাওয়া হয়েছিল। সোহেল রানা হাতমুখ ধুয়ে রাত ১২টায় খেতে গেলেন। আমি শুয়ে পড়ি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে কাপড় পরতে পরতে হোটেল কক্ষটির চারদিকে প্রথমবারের মতো চেয়ে দেখি। রাতে নির্জীব হয়ে পড়েছিলাম। এখানে থাকা মোটেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু করারও কিছু ছিল না। তাই সকালে উঠে অন্য হোটেলের সন্ধানে যাব বলেই একবারে তৈরি হয়ে নেই আর কক্ষটি দেখি দেয়ালে বাংলায় বেশ কিছু লিখা দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যাই সামনে। কিছু কিছু লিখা পড়ে থ’ হয়ে যাই। ব্যাংককের হোটেলে বাঙালি সন্তানদের করুণ আর্তি। এসব লেখা দেখেই বোঝা যায় আদম ব্যবসায়ীদের অবিশ্বাস্য প্রতারণার চিত্র। বিদেশের মাটিতে গিয়ে কেমন অসহায় হয়ে পড়ে সোনালি প্রত্যাশায় যারা বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। মুন্সীগঞ্জের আলম লিখে রেখেছে ‘কোথায় যাচ্ছি, জানি না, দেশে কোনদিন ফিরতে পারব কিনা জানি না।’ শেরপুরের জামান লিখেছে ‘মা তোমার দেখা আর কোনদিন পাব কিনা জানি না। ‘রোজগার করে পাঠাব বলে বিদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম, এখন মনে হচ্ছে সবই ভুল।’

দেয়ালের লিখা পড়ে গা রি রি করছিল। মনটা ভীষণ খারাপ হযে গেল। এমন সময় তৈরি হয়ে সোহেল রানা এল। সোহেল রানাকে দেখালাম দেয়াল লিখন। তিনি বললেন এমন অনেক আছে। কত বাঙালির যে আকুতি আছে ব্যাংককের ছোট ছোট হোটেলের দেয়ালে তার হিসাব নেই। ব্যাংককের বাতাস ভারী হয়ে যায়, হোটেলের দেয়াল যেন এ দুঃখের ভার সইতে পারে না। কিন্তু তবুও আদম ব্যবসায়ীদের মন টলে না। দেশীয় অনেক যুবককে সর্বস্বান্ত করে কিছু আদম ব্যবসায়ী কাট মারে। এতে বাঙালি আদম সন্তানরা যায় জেলে কিংবা ভিখারি সেজে পালিয়ে বেড়ায়। বিদেশের সোনালি হাতছানি ফিকে হয়ে যায়, মৃত্যুর দিকে পা বাড়ায় টগবগে অনেক তরুণ।

সোহেল রানাকে নিয়ে ৮টার মধ্যে হোটেল ত্যাগ করি। বেশ ভারী বলে ব্যাগ বইতে কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তায় বের হয়ে দু’পাকিস্তানির সাথে দেখা। তাদের জিজ্ঞেস করলাম আশপাশে মোটামুটি ভাল হোটেল আছে কিনা। একজন একটা নাম বলে হাত দিয়ে সামনে দেখালেন হোটেল। কিন্তু বেশ দূরে মনে হয়। ২৫ বাথ দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে পৌঁছে দেখি সিট নেই। সেখান থেকে আরেক হোটেলের নাম নিয়ে আবার ২৫ বাথ দিয়ে ট্যাক্সিতে যেয়ে পৌঁছি। ট্যাক্সিওয়ালা দ্রুত নিয়ে গেল। মনে হল দূরত্ব খুবই কম। কিন্তু উপায় নেই। ৮শ’ বাথ করে দু’জন দু’কক্ষ ভাড়া নেই। ব্যাগ রেখে কিছু কেনাকাটার জন্য বের হয়ে দেখি আমরা যে হোটেলে প্রথম এসেছিলাম এটা ঠিক সামনেই। রাস্তার এপার-ওপার। অথচ ট্যাক্সিওয়ালা ঘুরিয়ে অন্যদিক দিয়ে এখানে আমাদের নিয়ে এসে ২৫ বাথ নিয়েছে। শুনেছিলাম ব্যাংককে প্রতারণা কম, কিন্তু নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ব্যাংককের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের মধ্যে খারাপ প্রকৃতির লোক আছে। ব্যাংককের বিভিন্ন মার্কেটে সোহেল রানাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরেছি। বড় বড় সুপার মার্কেটে বিদেশিদের প্রচুর ভিড়। জিনিসপত্রের মূল্য বেশ কম। কেনাকাটার ইচ্ছা থাকলেও তেমন করা সম্ভব হয়নি। বেশ সস্তায় কাপড় পাওয়া যায় ব্যাংককে।

জাপানে দীর্ঘদিন খাবারের বেশ কষ্ট হয়েছে। ব্যাংককে আমাদের দেশি খাবারের অনেক হোটেল আছে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই। ভারতীয় মালিক। প্রচণ্ড ক্ষুধার মধ্যে রাতে এক হোটেলে যেয়ে ম্যানুতে দেখি মুরগির মাংস, ডাল এবং ভাত আছে। তাই অর্ডার দিলাম। ১৫ মিনিট পর গরম গরম রান্না চিকন চালের ভাত আর মুরগি এল। বেশ তৃপ্তির সাথে খেয়ে নেই। খেয়ে সোজা হোটেলে এসে শুয়ে পড়ি। সকালেই রওনা দিব ঢাকার উদ্দেশে। সোহেল রানা থাকবে ব্যাংককে কিন্তু এ হোটেলে থাকতে পারবে না। তাই তার জন্য কম দামের হোটেল রাতেই ঠিক করে দিয়ে আসি।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে নেই। আগের দিনই এক ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে রেখেছিলাম। ৮টায় কাউন্টারে এসে পৌঁছে দেখি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সোহেল রানাকে রাস্তার হোটেলে নামিয়ে দিয়ে ব্যাংকক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছি সাড়ে ১০টায়। ১২টায় বিমান, থাই এয়ারওয়েজে কলকাতা হয়ে ঢাকা। ব্যাংকক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন আর শুল্ক মুক্ত বিভিন্ন দোকানে ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হলো বাংলাদেশের দুই যুবকের সাথে। আমাকে তারা এসে জিজ্ঞেস করেন আমি বাংলাদেশের কিনা। পরিচয় হওয়ার পর তাদের কাহিনী শুনলাম। একজনের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরে। অন্যজনের মানিকগঞ্জের সিংগাইরে। মুজিবুর রহমান ও মুরাদ। মুজিবের দেশ আমার নিজ জেলায় এবং পাশের থানায়। আমার বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজনকেও সে চেনে। তার পরিচিত বলে জানায়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মীয়তার ভাব জন্মে। ২৭/২৮ বছর বয়সী মুজিবের কাছে ব্যাংকক বিমানবন্দরেই জানতে চাই কেন এখানে এসেছিল। জবাব, মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য। সে ব্যাংককে এসেছিল। নিকটাত্মীয় এক আদম ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মুজিব ও মুরাদসহ আরও ৪ জন ১০ দিন আগে ব্যাংকক আসে। ব্যাংকক থেকে প্রায় ৪শ’ কিলোমিটার দূরে হাজ্জাই সীমান্তে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে ৪ দিন। কিন্তু তাদের যাওয়া সম্ভব হয়নি। আগে থেকে কোনো চাকরি রেডি করেনি আদম ব্যবসায়ীরা। যে কারণে ফেরত। কিন্তু দেশে ফেরত আসাও সম্ভব নয়। কেননা টিকিট নেই। কলকাতা পর্যন্ত টিকিট আছে। আদম ব্যাপারীরা বাকি অংশের টিকিট নিয়ে টাকা তুলে নিয়েছে। তাই মুরাদ ও মুজিব কলকাতা এসে ঢাকায় আত্মীয়দের টেলিফোন করে জানাবে তাদের অবস্থা। কলকাতা থেকে আবার ব্যাংককে যাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য না হয় ঢাকা ফিরে আসবে। তারা জানালেন, এমন অনেকে আছেন যাদের টিকিট এবং পাসপোর্ট আদম ব্যবসায়ীরা নিয়ে গেছে। যাতে তারা এখন রাস্তায় রাস্তায় না খেয়ে ঘুরে। হাজ্জাই সীমান্তের কাছে অনেক বাঙালি তরুণ মালয়েশিয়া যাওয়ার অপেক্ষায় সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে আছে বলেও তারা জানান। তাদের কাউকে আশ^াস দিয়ে রাখা হচ্ছে শীঘ্রই পাঠানো হবে বলে। আবার কাউকে ফেলে রেখে আসা হয়েছে। তারা জানায়, মানুষ বিকিকিনির হাট বসে থাইল্যান্ডের সীমান্ত শহর হাজ্জাই। বাঙালি, পাকিস্তানি, নেপালি, বার্মিজ ও ভারতীয়দের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে এসব ঘটনা শুনে অবাক হতে হয়। চলবে...

আগের পর্ব (১৮) পড়ুন

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত