ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:০৬

চেরি ফুলের দেশে

২০. কলকাতা হয়ে ঢাকা

বিমানে আমার টিকিট ছিল ফার্স্ট ক্লাসে। তাই মুরাদ আর মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণের পর মুজিব ও মুরাদ ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ায়। আমি ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার। তাই লাউঞ্জে বসে থাকি। কলকাতার প্যাসেঞ্জার নির্গমনের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে উপরে। মুজিবের ভাই ঢাকায় এক ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরিরত। তার ভাইয়ের নাম, ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে অনুরোধ জানায় যাতে ঢাকা এসে যোগাযোগ করে ঘটনা জানাই। তাদের বিদায় দিয়ে আমি লাউঞ্জে বসে থাকি। সাথে আরও দু’জন বাংলাদেশের তরুণ। তারা ব্যাংকক থেকে এসেছে। নিয়মিত ব্যাংকক আসা-যাওয়া করে থাকে। গল্প করছিলাম তাদের সাথে। এমন সময় দেখি মুজিব ও মুরাদকে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্তারা বাঁশি ফুঁকাতে ফুঁকাতে আবার বিমানের দিকে রওনা দিয়েছে। কাঁদছে মুজিব। মুরাদ নির্বিকার। ঘটনা কি জানার জন্য আমি এগুতেই মুজিব দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। অঝোরে কাঁদতে থাকে। বলে আমাকে বাঁচান। আমাকে বাঁচান। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম তাদের অন্যায় কী? জবাব, কলকাতার ভিসা নেই আর টিকিটও নেই, যাতে বাংলাদেশে যেতে পারবে। তাই যে বিমানে এসেছিল সে বিমানে তুলে দেয়া হবে। কেননা যারা এনেছে এখন দায়িত্ব তাদের। ভিসা ছাড়া যাত্রীকে তাদের গ্রেফতার করতে হবে অথবা ফেরত পাঠাতে হবে। এটাই নিয়ম। থাই এয়ারওয়েজের বিমান ছাড়ে ছাড়ে। ইমিগ্রেশন কর্তারা হৈচৈ করতে থাকেন।

আমি এবং অন্য দু’জন বাঙালি তরুণ ইমিগ্রেশন কর্তাদের কাছে জানতে চাই কোনোভাবে কিছু করা যায় কি না। বললাম, এরা প্রতারণার শিকার। কর্তাটি বললেন, আমাদের কিছু করার নেই। কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে প্রায়ই এমন হয়ে থাকে। অনেক বাঙালিকে আগে এমনভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ওখানে পাটালে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ব্যাংকক জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় তখন তাদের বিদেশে কারাগার জীবন। খবরও পাওয়া যায় না অনেক সময়। আমি কর্মকর্তাকে আমার পত্রিকার পরিচয় দিয়ে বললাম, দয়া করে একটা পথ বের করুন। আমাদের সামনে এদের এত বড় বিপদ হবে, দু’জন দেশের যুবককে বিদেশের জেলে নিয়ে যাবে এটা কীভাবে হতে পারে? কর্মকর্তা এক মিনিট চিন্তা করে বললেন, একটা পথ আছে যদি আপনারা বাংলাদেশে যাওয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করেন তাহলে রাখা যায়। তখন তাদের কাছে জানতে চাই কোনো ডলার আছে কিনা। মুজিব ১০ ডলার বের করে দিয়ে বলল, আর নেই। মুরাদ বলল, তার কোনো ডলার নেই। এখন কি রা যায়? চিন্তা করছি। বিমান আধা ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছে। ইমিগ্রেশন অফিসার বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত দিন। অগত্যা আমি বললাম, ঠিক আছে আমি টিকিট করে দিব। তখন দৌঁড়ে খবর দেয়া হলো বিমানে। বিমান ছেড়ে যাওয়ার পর মুজিব, মুরাদের চোখের পানি থামে।

জাপানে আমি চার সপ্তাহ থাকাকালে যে পরিমাণ দৈনিক ভাতা পেয়েছি কিছুটা সঞ্চয় করেছিলাম। ঢাকা বিমানবন্দরের শুল্কমুক্ত বিপণি থেকে কোন কিছু ক্রয় করার ইচ্ছায় অর্থ জমিয়ে রাখি। জমাকৃত এ অর্থের একটি অংশ দিয়েই তাদের দু’জনের টিকিট ক্রয় করে দেশে আসার ব্যবস্থা হলো। টিকিট করতে গিয়েও সমস্যা দেখা দিল। আমরা যে ফ্লাইটে আসব সে ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তাদের বললাম, পরের ফ্লাইটে আসার জন্য। অগত্যা না পেলে পরের দিন আসতে। ব্যাংককের জেলে থাকার চাইতে কলকাতা বিমানবন্দরে এক রাত থাকা ভালো। কিন্তু না তারা আমাকে কিছুতেই ছাড়ছে না। সাথে না নিয়ে এলে নাকি আবার জেলে নিয়ে যাবে। অবশ্য টিকিট না করা পর্যন্ত ইমিগ্রেশনের লোকজন ঘুরঘুর করছিল। তাদের কাকুতি-মিনতিতে নিয়মিত ব্যাংকক যাওয়া-আসা করা পুরান ঢাকার এক তরুণ আমার কাছ থেকে ডলার নিয়ে ইশারায় ইঙ্গিতে কথা বলে দুটো টিকিট করে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে জানায় এ জন্য ৫ ডলার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। বিমানে ওঠার পর মুজিব ও মুরাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

তারা এমন কপর্দকহীন ছিল যে বিমান বন্দরে নেমে বাসায় যাওয়ার জন্য খুঁজে আমার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে যায়। আমার স্ত্রী ও ছেলেরা বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছিল। মুজিবকে ভিতর থেকে বিদায় দেয়ার সময় বলে দিয়েছিলাম আমার নাম বলে গেটে আমার পরিবার-পরিজনকে খুঁজে যেন খবর দেয় আমি এসেছি। কেননা আমি শুল্কমুক্ত বিপণি হয়ে আসি দেরিতে। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে ঢাকার মাটিতে পা দিয়ে যে কি আনন্দ লাগছিল ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তার চাইতে বেশি আনন্দিত হই স্ত্রী-ছেলেদের সাথে মিলিত হয়ে। ছোট্ট ছেলে ফাহিম তখন আধো আধো কথা বলতে পারে। আমাকে দেখে এক লাফে কোলে। চোখে-মুখে আনন্দ। মুরাদ, মুজিব তখনও দাঁড়িয়েছিল। আমি আসার পর তারা বিদায় নেয়। আমার তৃপ্তি দু’জন দেশের তরুণকে দেশে নিয়ে আসতে পেরেছি। পরে মুজিব এসে আমার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে যায়।

আগের পর্ব (১৯) পড়ুন

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত