ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

স্মোকি মাউন্টেন: যেন সাজেকের আরেক রূপ

  আকাশ মামুন

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:৩৩  
আপডেট :
 ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৩:১৮

স্মোকি মাউন্টেন: যেন সাজেকের আরেক রূপ

সামারের ছুটি। সবারই মন ফুরফুরে। সেই ফুরফুরে মনে আর একটু রঙ চড়াতে-ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলার মত শীতের জড়তা মুছে ফেলতেই, সাত দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা। সাউথ ডাকোটা থেকে নেব্রাস্কা, আইওয়া, মিজোরি, ইলিনয়েস, ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি, টেনিসি, আলাবামা হয়ে ফ্লোরিডা-সাড়ে পনেরশত মাইল। ২৭ জুলাই দুপুর তিনটায় যাত্রা শুরু ছয়জনের একটি দলের। কিছু শুকনো খাবার আর পুটলায় ভরে সাত দিনের উপযোগী কাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ভ্রমণ শুরুর সেলফি তুলে, রইরই করে বেরিয়ে পড়লো একটি ভ্যান। রিমন ও সাজু ফেসবুক চেকইন দিতে ভুললো না।

যাত্রাপথে খাবারের দায়িত্বে ছিল ফাহিমা ভাবি আর রাব্বানির। ক্যামেরায় ফরহাদুল ইসলাম। অডিও জকির দায়িত্বে ছিল রিমন। তার কাজই ছিল গান বাজিয়ে মাতিয়ে রাখা। স্পটিফাই থেকে বাংলা, হিন্দি ও ইংলিশ গানের একটা তালিকা আগেই সে করে রেখেছিল। বাংলা গানের তালে হেলতে দুলতে আর দুধারে ভুট্টা ক্ষেত দেখে জায়গাটা বাংলাদেশ বলে ক্ষণিক ভ্রম হতেই পারে। শরতের মত পরিচ্ছন্ন আকাশ-পেঁজা মেঘ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন দস্যি ছেলের পাড়া বেড়ানোর মত। বিরাম নেই। দূর পাহাড়ের ঢালের কোন এক গ্রাম্য বালিকাই তাকে স্থিতি দিতে পারে। থমকে দাঁড়িয়ে হয়তো জিজ্ঞেস করবে, এই ছুড়ি চল পালাই। চপলা বালিকা তো হেসেই কুটিকুটি-পালাবি তো ঘর কোথায়? মেঘ বালক তো মহা চিন্তায়। অভিমানে রাতের আধারে মুখ লুকাতে গিয়ে হয়তো দেখবে-মেঘ বালিকা হারিয়ে যায়নি। চাঁদ হয়ে তারই অপেক্ষায় আছে।

প্রবাস জীবনে বাংলাদেশি পরিবার যেন একান্ত আপনজন, এক টুকরো স্বর্গ। কি গল্প-আড্ডায়, কি খাবারের স্বাদে কিংবা দেশের স্মৃতি কাতরতায়। ভার্মিলিয়ন থেকে সাড়ে আটশত মাইল দূরে লুইভিল, ইন্ডিয়ানা। আপাত গন্তব্য সেখানেই-মৃদুল ভাইয়ের বাসা। কলাম্বিয়া পৌঁছাতেই রাত এগারটা। সিদ্ধান্ত হল এখানেই কোন সরাইখানায় রাত্রি যাপন শেষে কাল লুইভিলের পথে যাত্রা শুরু হবে। পরদিন দুপুর গড়িয়ে লুইভিল পৌঁছা গেল। উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢালে ছিমছাম বাড়ী ঘেরা লুইভিল। মনে হতে পারে মানুষ অবকাশ যাপনের জন্য হয়তো পাহাড়ি বাংলোতে আছে। কিন্তু সত্যিটা হলো-ওহাইয়ো নদীর তীরে পাহাড়ে ঘেরা লুইভিলে এটাই জনপদ। এই পাহাড় ঢালের আবর্তিত হয় এখানকার মানুষের জীবন। তবে এই পাহাড় বান্দরবন কিংবা রাঙ্গামাটির মত অজ পাহাড় নয়! ঝাঁকঝকে রাস্তা-আপনাকে দিবে আধুনিকতা আর প্রকৃতির মিশেলে বাঁচার এক স্বাদ।

আমরা পৌঁছানোর খরব আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। বাড়ীর দুই কনিষ্ঠ সদস্য ওয়াফি আর ফারিন। বাড়ীর সামনে গাড়ী ঢুকতে দেখেই-ভুদৌঁড়ে বাসার ভিতরে চলে গেল-খবর দিতে। মুহূর্তেই আবার দরজায় দাঁড়িয়ে। খেলার সাথি পেয়েছে-এই ভেবে চাপা উত্তেজনা-অবয়বে উপচে পড়া আনন্দের ঝিলিক। এই পরিবারের সাথে আমিই একমাত্র নবাগত-বাকীদের আগেই পরিচয় ছিল। আমাদের যাওয়ার কথা শুনে মৃদুল ভাই অফিস থেকে সোমবারের ছুটি নিয়ে রেখেছেন। রুমি ভাবীর রান্নার হাতের কথা আগেই শুনেছিলাম। খেতে বসে টের পাওয়া গেল। অর্ধসিদ্ধ, মসলাহীন খাবার খেয়ে জিভ অবসাদগ্রস্ততা ছেড়ে চট করে সাড়া দিয়ে উঠলো। নতুন বাসায় পরিমিতি বোধ বজায় রেখে খাওয়ার যে রেওয়াজ চালু আছে-সেটা ভুলে সামনে যা পাচ্ছি সাবাড় করতে থাকলাম। রাতে দেশের কথা উঠল। দেশের গণতন্ত্র, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়মের সাথে সম্ভাবনার কথাও চললো। তুমুল হতাশার মাঝে সবাই শেষ পর্যন্ত একটা আশায় পৌঁছলে যে-দেশ আগামী প্রজন্মের হাতে নিশ্চয় সমৃদ্ধ হবে।

বেলাচড়েছে। তেতে উঠেছে সূর্য। দুদিনের প্রায় ১০০০ মাইল ড্রাইভিংয়ের ধকলে শরীরে আলসেমি ভর করেছে। তাইতো উঠি উঠি করেতে করতে বেলা ১০ ঘটিকা। চালকের আসনে দুজন-সাজু আর ফরহাদ ভাই।রাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল আজ আমাদের স্মোকি মাউন্টেন যাত্রায় মৃদুল ভাইয়ের পরিবারের চারজন যোগ হচ্ছে।গন্তব্য ৩০০ মাইল দূরের দ্যা গ্রেট স্মোকি মাউন্টেন। পথে যাওয়ার সময় ডেনিয়েল বোন ন্যাশনাল ফরেস্টে ঢু মেরে যাওয়া। সকালের খাবার শেষ করে বেরুতে বেরুতে দুপুর হয় হয়।

ড্যানিয়েল বোনে ঢুকে আঁকা-বাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ী। বাম দিকে পাহাড়ে হেলান দিয়ে গাছের সারি দাঁড়িয়ে। ডান দিকে ছড়া বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের ধারা। পাথুরে সে ছড়ায় র‌্যাম্পিং করছে অনেকে-তারপর হাইকিংয়ের জায়গা। আবার পাহাড় দেয়াল তুলে আছে। ঘোড়ার চড়ার ব্যবস্থাও আছে। ১১ মাইল কেডস কোভ লোপের মধ্যে চোখে পড়বে আঠার শতকের বাড়ী। কেউ বসবাস করে না-দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। ছোট এক কামরার সে বাড়ী অনেকটা আমাদের দেশের কাঠের বিলুপ্ত দ্বিতল বাড়ীর মত। কাঠের সে বাড়ীতে চোখে পড়বে আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কি ভাবে ফায়ার প্লেসের মাধ্যমে ঘর গরম করা হতো। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে উন্মুক্ত স্থানে হরিণ। অবাধ ও সাবলীল হরিণের বিচরণ দেখে মনে হতে পারে এখানকার মানুষগুলি বুঝি হরিণের বন্ধু-অবলীলায় যাদের পাশাপাশি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কেডস কোভ থেকে বেরিয়ে স্মোকি মাউন্টেনের পথে। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি পড়ছে-আবার বৃষ্টি চলে গিয়ে ঝলমলে আকাশ। গন্তব্য ক্লিন্সম্যান ডোমের সাড়ে ছহাজার ফুট উঁচুতে। মৃত্যুবিক্ষুব্ধ চক্রাকার পথ বেয়ে ভূমি থেকে উঁচুতে উঠছে গাড়ী। শুরুতে অনেকটা রাঙ্গামাটির পাহাড়ের মত। উচ্চতাভীতি থাকলে নিচে তাকালে শরীর হিম হয়ে আসবে। হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ি শিলা জবরজংয়ের মত পাহাড়ের গায়ে হা হয়ে বেরিয়ে আছে। দেখে মনে হতে পারে এই বুঝি ধ্বসে পড়বে গাড়ীর উপর। পাহাড়ে গায়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হয়-কত প্রাচীন ইতিহাস লেখা আছে শিলার গায়ে। কেবল মনের চোখই তা পড়তে পারে-কল্পনা সেই গল্প অনুভব করতে পারে। বৃষ্টি কেটে গিয়ে পূর্বাকাশে রংধনুর দেখা মিললো। হ্রদয়ে এক প্রশান্তির ছোঁয়া বয়ে গেল। গতি চিহ্ন দেখে-নির্দিষ্ট গতি মেনে এগিয়ে চলছে গাড়ী। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে যে যার মত। কল্পনার মেমরী কার্ড ভরে নিচ্ছে পছন্দের দৃশ্যাবলী।

অপেক্ষার পালা কেটে আমরা চূড়ায় এসে থামলাম। গাড়ী থেকে নেমে দীর্ঘ একটা শ্বাস বুকে চেপে সুনীলের কবিতা আওড়ালাম-অনেক দিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার সখ/কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা আমি জানি না/যদি তার দেখা পেতাম/দামের জন্য আটকাতো না… প্রত্যেক মানুষই অহংকারী/এখানে আমি একা-এখানে আমার কোন অহংকার নেই/এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে। একঝাঁক মেঘ এসে ভিজিয়ে দিল চুল। ভাবনায় ছেদ পড়লো। মনে হল-এ যেন সাজেক। সাজেকের আর এক হারিয়ে যাওয়া ভাই। ধূয়ার মত চারদিকে মেঘ ভেসে চলছে। দর্শনার্থীরা যে যার মত দেখছে-ছবি তুলছে। আমার কেবই মনে হতে লাগলো-এই যে পাহাড়, যে সমতল থেকে উঠে এসেছে সমুদ্র নামক ক্ষত রেখে। যার বুকে দুঃখের জল-তার কথা কি পাহাড় মনে রাখে? তার দুঃখ কি কখনও অনুভব করে পাহাড়?কে জানে? হয়তো করে না। কিংবা হয়তো রাখে। তাইতো দুঃখের জল নিয়ে ছড়া বেয়ে নিরবধী বয়ে চলে সাগরের বুকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আলো চলে গেছে। হয়তো জ্যোৎস্না উঠবে রাতে। জ্যোৎস্না রাতে পাহাড় কেমন-দেখতে খুব ইচ্ছে ছিল। জ্যোৎস্না প্লাবনে পাহাড় ডুবে গেলে কেমন মাদকতা ছড়ায়-হৃদয়ে কোন হারানো ব্যাথার ভায়োলিন বাজে কি না-হুমায়ুন আহমেদের গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার খোঁজ পাওয়া যায় কি না-দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ফিরতে হবে রাত নামার আগেই। পিজিয়ন ফোর্জের কোন এক পান্থশালায় রাত কাটিয়ে পরের গন্তবের দিকে ছুটব আমরা।

পিজিয়ন ফোর্জথেকে মৃদুল ভাই পরিবারসহ বিদায় নিল। ছুটি শেষ-তাকে ফিরতে হবে কাজে। আমাদের গন্তব্য ফ্লোরিডার পেনসাকোলা বীচ। কক্সবাজার সী বীচের দেশের মানুষ-পাহাড় দেখে ফিরে আসবে-সমুদ্র দেখবে না-তা কি করে হয়! বীচে পৌঁছে যে যার মত সমুদ্র স্নানে ব্যস্ত। বালিতে রুদ্র স্নান আর সমুদ্র স্নান শেষে শরীরের বালি পরিস্কারের জন্য আছে ঝর্ণার ব্যবস্থা, পোষাক পরিবর্তনের জন্য আরামঘর-সুন্দর পার্কিং ব্যবস্থা। সাজু বীচের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করলো। পেনসাকোলা না দেখা-কক্সবাজার দেখা আমেরিকার বন্ধু মন্তব্য করলো-কক্সবাজারের সাথে কেমন করে তুলনা করবে? গাড়ীতে উঠে আলোচনা করে উত্তর দেওয়া হলো-“তোমাকে মনে রাখতে হবে কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রতট। তবে পেনসাকোলা সুন্দর”। ঠিকই_আভিজাত্য থাকলেও-বিশালতা নেই। মনে মনে আমি তৃপ্তি পেলাম-এই যে প্রজন্ম দেশ থেকে দূরে থেকেও দেশের কোন কিছুকে সুন্দর করে উপস্থাপন করে-অন্যকেও ছোট করে না। এই প্রজন্মের হাতে দেশ এগুবেই-নিশ্চিত। এরাই একদিন দেশকে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে নিবে। এই তৃপ্তি নিয়ে আকাশে চোখ মেললাম-নীল আকাশ। সমুদ্রের আকাশে উড়ছে গাংচিল। আমাদের গন্তব্য সাড়ে পনের হাজার মাইল দূরে।

আকাশ মামুন শিক্ষার্থী ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ডাকোটা [email protected]
  • সর্বশেষ
  • পঠিত