ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

মানব কম্পিউটার

  ইতিহাস-ঐতিহ্য ডেস্ক

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:১৩

মানব কম্পিউটার
শকুন্তলা দেবী

আমাদের এই পৃথিবীতে অনেক বৈচিত্র্যময় মানুষের বসবাস। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটা মানুষকেই কোনো না কোনো বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে এই বিশাল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তবে মানুষের প্রয়োজন সেই বিশেষ ক্ষমতাকে শনাক্ত করা ও তা পরিমার্জন করা। আর ঠিক এজন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা। কথায় আছে না প্ররিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি।

আজকে এমনই একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষের কথা বলব, যিনি তার কঠোর শ্রমের মাধ্যমে সারাবিশ্বের মানুষের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন। শুধু তাই নয় তাকে বলা হয়েছে ‘মানব ক্যালকুলেটর’ অথবা ‘মানব কম্পিউটার’। বলছি ভারতীয় লেখিকা এবং মানব কম্পিউটার শকুন্তলা দেবীর কথা। গণনা করার অসাধারণ ক্ষমতার কারণেই বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি লাভ করেন ‘মানব কম্পিউটার’ হিসেবে।

বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য তাকে ১৯৮২ সালে ‘গিনেজ বুক অভ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গণনা করার বিশেষ ক্ষমতার পাশাপাশি গাণিতিক বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েও তার ছিল যথেষ্ট ধারণা। এ অসাধারণ প্রতিভাবান শকুন্তলা দেবীর জীবনের কিছু বিশেষ অংশ নিয়ে আজকের এই লেখাটি।

উল্লেখ্য, ‘বিশ্বের দ্রুততম মানব কম্পিউটার’-এর শিরোপা এতদিন পর্যন্ত শকুন্তলার হাতে ছিল যে বিশ্বরেকর্ডের কারণে, তা সম্প্রতি ভেঙে দিয়েছেন ভারতের হায়দ্রাবাদের নীলকান্ত ভানু প্রকাশ।

৪ নভেম্বর, ১৯২৯ সালে ভারতের বেঙ্গালুরুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার পরিবার ছিল রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ। তার বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখনই তার গণনা করার অসাধারণ প্রতিভা দৃষ্টিগোচর হয়। শকুন্তলার পিতা একটি সার্কাসে কাজ করতেন।

তিনি লক্ষ্য করলেন, তাসের খেলায় তিনি যতই চেষ্টা করুন না কেন, নিজের মেয়েকে হারানো ছিল তার পক্ষে অসম্ভব। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই জটিল জটিল অঙ্ক কষে ফেলতেন ছোট শকুন্তলা। একসময় তার পিতা সার্কাস ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যান ও রোড শো করেন, যেখানে শকুন্তলা তার বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তা দেখাতেন।

শকুন্তলা যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ ৫ বছর বয়সেই নিজের আয়ত্তে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এতে সে ব্যবহার করতো না হাতের আঙ্গুল। শুধু মুখে মুখেই সমাধান করে দিতে পারত। এসব শেখার জন্য তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার দরকার হয়নি।

মাত্র ছয় বছর বয়সে প্রথমবারের মতো অনেক বড় পরিসরে জ্ঞানীগুণীদের মাঝে মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ পান তিনি। বলা বাহুল্য, উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই এ গণনা করার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। এর দু’বছর পর আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো নিজের এই বিশেষ গুণটি তুলে ধরেন তিনি। শকুন্তলা তার পিতার সাথে লন্ডনে চলে যান ১৯৪৪ সালে। দেশের বাইরে প্রথমবারের মতো নিজের বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন এরপর থেকেই শুরু হয় বিশ্ব জুড়ে তার খ্যাতি অর্জন করার সফর।

অসাধারণ মানসিক দক্ষতা

শকুন্তলা খুব সহজেই বের করতে পারতেন তিনের বর্গমূল, উচ্চতর বর্গমূল এবং করতে পারতেন সব বড় বড় সংখ্যা গুণ। ১৯৫০ সালের দিকে ইউরোপে এবং ১৯৭৬ সালে নিউইয়র্কেও তিনি তার অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৭৭ সালে সাউদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১ অঙ্কের একটি সংখ্যার ২৩তম বর্গমূল মাত্র ৫০ সেকেন্ডে বের করে সকলকে বিস্মিত করে দেন। তার উত্তর ছিল ৫৪৬,৩৭২,৮৯১; যা নিশ্চিত করা হয় তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কম্পিউটার ইউনিভ্যাক-১১০১ এর মাধ্যমে। মাত্র ৫০ সেকেন্ডে শকুন্তলা এ উত্তর দিতে পারলেও বিশেষজ্ঞদের ইউনিভ্যাকে একটি বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করতে হয় এর সঠিক উত্তর বের করার জন্য। আর ইউনিভ্যাকের এ অঙ্ক কষতে সময় লাগে ৬২ সেকেন্ড।

গড়লেন বিশ্বরেকর্ড

১৯৮০ সালের ১৮ জুন আরেকটি বিস্ময়কর গণিতের সমাধান করেন শকুন্তলা। যুক্তরাজ্যের ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনে শকুন্তলাকে দেওয়া হয় ১৩ অঙ্কের দু'টি সংখ্যাকে গুণ করতে। তবে সংখ্যাগুলো কোনটিই ছিল না পূর্বপরিকল্পিত । গুণটি ছিল ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০×২,৪৬৫,০৯৯,৭৪৫,৭৭৯। এই গুণ করতে তার সময় লাগে মাত্র ২৮ সেকেন্ড। পরদিনই ‘দ্য বুলেটিন' পত্রিকায় তার এই রেকর্ডের কথা প্রকাশ করা হয়। তার এ রেকর্ড ১৯৮২ সালে ‘গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ তাকে স্বীকৃতি দেয়। আর সেইসাথে ‘বিশ্বের দ্রুততম মানব কম্পিউটার’ হওয়ার খেতাব পান তিনি। এছাড়াও অনেকগুলো পুরস্কার ও সন্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।

লেখক শকুন্তলা দেবী

শকুন্তলা দেবী বেশ কিছু বই লিখে গেছেন তার জীবদ্দশায়। এর মধ্যে অন্তত ছ’টি বই এরকম ছিল, যা পরবর্তী প্রজন্মকে গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তার বইগুলো দেখলেই বোঝা যায়, বিভিন্ন গাণিতিক বিষয় যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত, যেমন- ত্রিকোণমিতি ও লগারিদম সম্পর্কেও জানতেন তিনি। তার সেরকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও এসব বিষয়ে এত দক্ষতা কীভাবে এল, তা নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন বই পড়ার মাধ্যমে এসব বিষয়েও পারদর্শী হন শকুন্তলা। উল্লেখ্য, তিনি একটি ক্রাইম থ্রিলারও লিখেছেন, যার নাম ‘পারফেক্ট মার্ডার’।

তবে জ্যোতির্বিদ্যার প্রতিও শকুন্তলার ছিল অগাধ আগ্রহ। তিনি এ বিষয়ে বেশ জ্ঞান অর্জন করেন এবং তিনি একটি জ্যোতির্বিদ্যার উপর ‘অ্যাস্ট্রোলজি ফর ইউ' লিখেন। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি আর্টিকেল অনুসারে, শকুন্তলা একদিনে প্রায় ৬০ জন ব্যক্তির সাথে দেখা করতেন, যারা তাকে নিজেদের জন্মের তারিখ, সময় ও স্থান বললে তিনি তাদের জীবন সম্পর্কে যেকোনো তিনটি প্রশ্নের জবাব দিতেন।

বৈবাহিক জীবন

১৯৬০ সালের দিকে শকুন্তলা দেবী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন পরিতোষ ব্যানার্জির সাথে। অনুপমা ব্যানার্জী নামে তাদের ঘরে একটি মেয়ে হয়। ডিভোর্সের পর শকুন্তলাই তাকে পেলে-পুষে বড় করেন। তবে বিয়ের কয়েক বছর পরই ভেঙে যায় তাদের বিয়েটি। বলা হয়ে থাকে পরিতোষ সমকামী ছিলেন যার কারণে তাদের বিয়েটি ভেঙে যায়। আর সেজন্যই শকুন্তলা দেবীও উদ্বুদ্ধ হন সমকামিতা নিয়ে গবেষণা করতে । ২০০১ সালের একটি তথ্যচিত্র ‘ফর স্ট্রেইটস অনলি’-তে এই দাবি করা হয়। সেই সময়ে সমকামিতা শুধু সমাজের চোখে নয়, বরং আইনের চোখেও ছিল নিকৃষ্টতম অপরাধ। সেই সত্তরের দশকে শকুন্তলা সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটান যেন তাদের মন-মানসিকতা ও জীবনযাপনের ধরন বুঝতে পারেন। তার এই দীর্ঘ সময়ের গবেষণার ফল ছিল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব হোমোসেক্সুয়ালিটি’বইটি।

১৯৭৭ সালে, এই বইটি প্রকাশিত হয় তবে সেই সময়ে বইটি সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানসিকতার কারণে সেরকম স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পায় তার বইটি। ভারতে সম্ভবত সমকামিতা সম্পর্কে এত বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে সেরকম বই এটিই প্রথম। অন্যদিকে শকুন্তলার মেয়ে অনুপমা ব্যানার্জী দাবি করেন তার পিতা পরিতোষ সমকামী ছিলেন না। বলা হয় যে, শকুন্তলা তার বইয়ের প্রচারের জন্য অথবা কেন এরকম বই লেখার সাহস করলেন বা কেন এই বই লেখার জন্য অনুপ্রাণিত হলেন সেসব প্রশ্নের ঝড় থেকে বাঁচতেই এটা বলে ফেলেন।

‘মানব কম্পিউটার’ উপাধি

বিবিসির একটি অনুষ্ঠানে নিজের অনন্য প্রতিভা প্রদর্শন করেন, ১৯৫০ সালের ৫ অক্টোবর। লেসলি মিচেল ছিলেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে। তখন তার সুনাম আরো বেড়ে যায়। একসময় তিনি ‘মানব কম্পিউটার’ উপাধি লাভ করেন। শকুন্তলা দেবী মোটেও পছন্দ করতেন না এই উপাধি। তবে তার মতে, মানুষের মস্তিষ্কের শক্তি-সামর্থ্য ও দক্ষতা একটি কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি। মানুষ আর কম্পিউটারের মস্তিষ্কের তুলনা করা অযৌক্তিক।

তবে এ সাক্ষাৎকারে ঘটে একটা মজার ঘটনা। শকুন্তলা অনবরত জটিল সব গণিত করার মাধ্যমে উপস্থিত সকলকেই চমকাতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করেই হয় একটা ঝামেলা, যখন শকুন্তলা ও বিবিসির হিসাবে অমিল দেখা যায়। শকুন্তলাও মানতে রাজি না, তার হিসাবে কোন ভুল হয়েছে। তাই আবার নতুন করে সব হিসাব-নিকাশ করে মিচেল ঘোষণা করেন যে, শকুন্তলার হিসাবে কোন ভুল হয়নি, বরং তাদের পক্ষ থেকেই ভুলটা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এরকম আরো একটি ঘটনা ঘটে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে। আর এবারও শকুন্তলা নয়, বরং ভুল প্রমাণিত হয় কর্তৃপক্ষ।

মহাপ্রয়াণ

নানা বিষয়ে প্রতিভার পরিচয় প্রদর্শন করে, ২০১৩ সালে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শকুন্তলা। সেখানে প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার কথা বলেছিলেন। চিকিৎসা চলাকালীন তার হৃদপিণ্ডও আক্রান্ত হয়। তারপর ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল শকুন্তলা দেবী নিজ জন্মস্থান তথা বেঙ্গালুরুতে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা যান। এই সময় তার বয়স ছিল ৮৩ বছর। এছাড়া মৃত্যুর বেশ আগ থেকেই হার্ট ও কিডনির বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত