ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

থাইল্যান্ড ভ্রমণের ইতিবৃত্ত

  ভ্রমণ ডেস্ক

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০৪

থাইল্যান্ড ভ্রমণের ইতিবৃত্ত

থাইল্যান্ড (Thailand) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের পরেই অবস্থিত। বিখ্যাত সাদা হাতির দেশ নামেই দেশটি অতি সুপরিচিত। আমাদের অতিথি লেখক ইমাদ আশরাফ গত ঈদের ছুটিতে ৫ দিন থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ও পাতায়া ঘুরে এসে জানাচ্ছেন তার অভিজ্ঞতা।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, থাইল্যান্ডে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা পাওয়া যেমন অতটা সহজ নয়, তেমনি অতটা কঠিনও নয়। নিয়ম মেনে কাগজপত্র ঠিক রেখে সত্য তথ্যের ভিত্তিতে আবেদন করলে ভিসা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। টুরিস্ট ভিসা আবেদন করতে মোট খরচ পরবে ৩৭৪০ টাকা এবং ভিসা পেতে প্রায় ১৫-২৫ দিন পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। যেদিন ভিসার জন্য আবেদন করা হবে ওইদিন থেকে হিসাব করে মোট তিনমাসের জন্য সিঙ্গেল এন্ট্রি টুরিস্ট ভিসা দেয়া হয় যার প্রথম দিনগুলো পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায়।

ভিএফএস-এর ওয়েবসাইট থেকে আপনারা থাইল্যান্ড এর ভিসা আবেদনের সকল নিয়মাবলী ও কাগজপত্র নামিয়ে ভিসা আবেদন করতে পারবেন এবং তা পূরণ করে আবার নিকটস্ত ভিএফএস সেন্টারে জমা দিতে হবে। থাইল্যান্ড এর বিমান ভাড়া যাওয়া-আসা সর্বনিম্ন ১৩-১৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৮-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। অতি কম মূল্যে টিকেট পেতে প্রায় ২ মাস আগেই টিকেট কেটে রাখতে হবে যা ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়াসহ হিসাব করলে মোটামুটি কঠিনই বলা যায়। আমি প্রায় একমাস আগে টিকেট কাটি এবং আমার যাওয়া-আসা টিকেটের মূল্য পড়েছিল প্রায় ২৩ হাজার টাকা। ঈদের ছুটিতে যাওয়ায় টিকেটের মূল্য এমনিতেও একটু বেশি ছিল। সেই হিসেবে আমি কমেই পেয়েছি বলতে হবে।

অতপর ১৩ তারিখ মধ্যরাত ১:১৫ মিনিটেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমার থাইল্যান্ড পথে যাত্রা শুরু হয়। থাইল্যান্ড সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের চেয়ে ১ ঘন্টা এগিয়ে থাকে এবং সেই হিসেবে থাইল্যান্ড সময় প্রায় ভোর ৫টায় আমি ব্যাংককের ডনমুয়েং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দরে নেমে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রথম কাজটাই হবে একটি সিম কিনে নেয়া। বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিভিন্ন অফার দেখে আপনার পছন্দমতো একটি সিম এয়ারপোর্ট থেকেই কিনে নিতে পারবেন। আমার কাছে ট্রুমুভের (Truemove) ৮ দিনের ১৩ জিবি ইন্টারনেট প্যাকেজটি ভালোই মনে হয়েছে। তারপর গন্তব্য ব্যাংককের নানা এলাকা।

নানা এবং অশোক এই দুই এলাকাতেই বেশীরভাগ পর্যটক হোটেল নিয়ে থাকেন। হোটেল বুকিং আগে থেকে করা থাকাই ভালো। আগোডা (Agoda) মোবাইল এপ্লিকেশন থেকে ডিসকাউন্টে আপনারা ভালো মানের এসি হোটেল বুকিং দিতে পারবেন। আমি থেকেছি নানা এলাকায় রয়্যাল এশিয়া লজ (Royal Asia Lodge) এই হোটেলটিতে। ভাড়া দুইজনের রুমের জন্য পড়েছে প্রতিরাত প্রায় ২৩০০-২৫০০ টাকা। যদিও আমি একাই থেকেছি, তবুও দুইজনের রুম ভাড়া করেছি কারণ একজনের জন্য ইন্টারনেটে বুকিং করতে গেলে ওরা ডরমিটরিতে দিয়ে দেয় যেখানে একসাথে ৬-৮ জন মানুষ থাকতে হয়। একা হওয়ার কারণে অজানা মানুষের সাথে থাকার ইচ্ছা হয়নি, পাশাপাশি দুইজনের রুমে থাকলে নিজের ইচ্ছামতো রুমে মুভমেন্ট করা যায় যা আমার কাছে অতীব জরুরি মনে হয়েছে। এবার আসি ভ্রমণের বর্ণনায়।

প্রথম দিন থাইল্যান্ডে চলাচলের জন্য সবছেয়ে সাশ্রয়ী ও দ্রুতগামী যান হলো BTS Sky ট্রেন। BTS ট্রেনের রুট সম্পর্কে আগে থেকেই Google Map থেকে ভালো আইডিয়া নিয়ে নিবেন নতুবা গন্তব্যে পৌঁছুতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যেতে পারে। প্রথমেই ডনমুয়েং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এসি বাসে করে চলে যেতে হবে Mo Chit BTS Station-এ। বাস বিমানবন্দরের গেট থেকে বের হয়েই পাওয়া যাবে এবং না বুঝলে কাউকে জিজ্ঞেস করে নিবেন। Mo Chit BTS Station থেকে স্কাই ট্রেনে করে সরাসরি চলে যাবেন Nana BTS Station-এ। নানা-এর ঠিক পরের স্টেশনই হলো Asok BTS Station. হোটেলের ঠিকানা অনুযায়ী আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে নেমে যাবেন। আমার হোটেলটি ছিল Nana BTS Station থেকে মাত্র ৬০০ মিটার দূরত্বে। হোটেলের টুকটুক (আমাদের দেশে যা টমটম নামে পরিচিত) দিয়ে ফ্রি-তেই বা হেটেই হোটেলে চলে যেতে পারবেন। থাইল্যান্ডে সব হোটেলের লক অটো হওয়ায় চেকইন-চেকআউট সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট সময়ের (চেকআউট সময় দুপুর ১২টা) পর অটোমেটিকভাবেই দরজা লক হয়ে যাবে যা চাইলেও বাইরে থেকে খোলা যাবেনা। তবে চাইলে কিছু অতিরিক্ত খরচ করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেও চেকইন নিতে পারেন। ক্লান্ত থাকার দরুন আমি হোটেলে সময়ের (চেকইন সময় দুপুর ২টা) আগেই চেকইন নিয়ে নেই। তখন ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আমি বের হয়ে যাই ব্যাংকক (Bangkok) পরদর্শনের উদ্দেশ্যে।

বরাবরের মতোই আমি Google Search ও Google Map এর সাহায্য নিয়ে আমার পরিকল্পনা ঠিক করে নেই। প্রথম গন্ত্যব্য দ্য রয়্যাল গ্র্যান্ড প্যালেস (The Royal Grand Palace) যা কিনা থাই রাজার বাসভবন হিসেবে পরিচিত। একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি। যেকোনো যায়গায় গেলেই আপনার টিকেট কিনতে হতে পারে এবং টিকেটের মূল্য নেহায়েত কম নয়, বরং আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে।

যাইহোক, গ্র্যান্ড প্যালেস আসলেই দেখার মতো যায়গা। বৌদ্ধমূর্তি সহ অনেক সুন্দর স্থাপনা দেখেতে পাবেন। পরবর্তী গন্তব্য ঠিক একটু দূরেই Wat Pho মন্দির। এখানেও বৌদ্ধদের অনেক সংস্কৃতি ও স্থাপনা দেখতে পারবেন। এই সব স্থানের ছবি পর্যায়ক্রমে আমার ফেসবুক টাইমলাইনে আপলোড করা আছে। আপনারা চাইলে সেখান থেকে একটা আইডিয়া নিতে পারবেন। নানা থেকে এই স্থানগুলোতে আমি থাইল্যান্ড এর Grab Moto ব্যবহার করে গিয়েছি যা আমাদের বাংলাদেশের পাঠাও কিংবা উবার এর মতো। BTS ট্রেনের পর Grab Moto টাই মোটামুটি সাশ্রয়ী বলা যায়। এরপর প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমি নানার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে পরে আশোক এরিয়ার কাছে চলে যাই যেখানে Terminal 21 একটি বিখ্যাত শপিং মল রয়েছে। আসলে শুধু শপিং মল বললে ভুলই বলা হবে। নিজের কাছে মনে হবে সত্যি বুঝি কোন বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। একটা নয় দুটো নয়, বেশ কয়েকটি শহরের নামে প্রতিটি ফ্লোরের নাম দেয়া আছে। আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। আপনারাও গেলে ঘুরে আসবেন। ঘুরাঘুরি শেষ করে আমি আমার হোটেলে ফিরে আসি।

দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়দিন ছিল আমার পাতায় যাওয়ার প্লান। পাতায়া (Pattaya) যাওয়ার জন্য আমি দুপুরকেই বেছে নেই এবং সকাল সময়টা ব্যাংকক এই আরেকটু শহর ঘুরতে বের হই। ব্যাংককের মূল বানিজ্যক এলাকা বলতে যা বোঝায় তার নাম সিয়াম। সিয়াম আসলে থাইল্যান্ড এর পূর্ব নাম। নানা থেকে ট্রেনে করে সহজেই সিয়াম চলে যাওয়া যায় এবং সময় ও লাগে মাত্র ১০-১৫ মিনিট। সিয়ামে গেলেই দেখতে পাবেন সিয়াম সেন্টার, সিয়াম প্যারাগন, সিয়াম ডিসকভারি নামের তিনটি বড় বড় শপিং মল আর একটু সামনেই আছে MBK Center নামের জনপ্রিয় শপিং মল। সিয়ামের শপিংমল গুলোতে আপনি একটার ভিতর দিয়েই আরেকটায় যেতে পারবেন। ঘুরতে ভালোই লাগবে। দেখার মতোই যায়গা। চাইলে সিয়াম ডিসকভারি-তে মাদাম তুসো মিউজিয়াম ও সি লাইফে ঘুরতে পারেন। তবে টিকেট এর দাম কিন্তু অনেক। এসব ঘুরাঘুরির পর আমি হোটেলে চলে যাই এবং পাতায়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। চাইলে আপনি আপনার লাগেজ পাতায়া থেকে ফেরত আসা পর্যন্ত ব্যাংককের হোটেলে জমা দিয়ে যেতে পারবেন।

পাতায়া যেতে হলে প্রথমেই নানা থেকে ট্রেনে করে চলে যাবেন একামাই (Ekamai) ষ্টেশনে যেখানে নামলেই আপনি পেয়ে যাবেন ব্যাংককের ইস্টার্ন বাস টার্মিনাল যেখান থেকে বাসের টিকেট করে সরাসরি পাতায়া চলে যাবেন। দুপুর ১টায় রওনা দিয়ে পাতায়া-তে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছুতে প্রায় ৫টা বেজে যায়। বাস থেকে নেমে আমাদের দেশের Maxi বা লেগুনা গাড়ীর মতো নিল রঙয়ের গাড়ীতে করে চলে যাবেন আপনার গন্তব্যে। চাইলে মোটরসাইকেলে করেও যেতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে ভাড়া একটু বেশি পড়বে। এখানেও আমি আগেই আগোডা (agoda) মোবাইল এপ্লিকেশন থেকে হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম। আমি উঠি Max Hotel নামে একটি হোটেলে যা পাতায়া বীচ রোডের সই-১৩/২ নং-এ পড়েছে। একটু বিশ্রাম নিয়েই আমি চলে যাই Ripley’s Believe It or Not দেখতে যা আমার হোটেলের খুব কাছেই অবস্থিত। সবসময় মাথায় মোটা অংকের টিকেটের কথা মনে রাখতে হবে। ঘুরাঘুরি করে একটু বীচের পারে হেঁটে আর খাওয়াদাওয়া সেরে আমি হোটেলে ফিরে আসি।

তৃতীয় দিন তৃতীয়দিন সকালেই আমার প্রধান গন্তব্য পাতায়ার বিখ্যাত কোহ-লার্ন (Koh Larn) আইল্যান্ড বা দ্বীপ। মোটরসাইকেল বা লেগুনার মতো গাড়ীতে করে বা হোটেল আরও কাছে হলে হেঁটেই চলে যেতে পারেন কোহ-লার্ন যাওয়ার ফেরিঘাটে যা Walking Street পার হয়ে একটু সামনে গেলেই পাওয়া যাবে। টিকেট একদম ফেরিঘাটে গিয়েই নিতে হবে এবং এখানেই টিকেটের মূল্য সবচেয়ে কম যা মাত্র ৩০ থাই বাথ। টিকেট কেটেই লঞ্চে করে সরাসরি চলে যান কোহ-লার্ন দ্বীপে। সাথে নয়নাভিরাম সমুদ্রের সৌন্দর্য চোখে পরার মতো। কোহ-লার্ন দ্বীপে পৌঁছেই দেখতে পাবেন এর ম্যাপ দেয়া আছে। যদিও এই ম্যাপ দেখে কোথায় ঘুরবেন তা ঠিক করার মতো সময় নেই। এখানে প্রায় ৮/৯টি বীচ রয়েছে। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম আমি যাব সামায় (Samae) বীচে। নেমেই মোটরবাইক বা লেগুনা জাতীয় টুকটুক করে চলে যেতে পারবেন যেকোন বীচে। সামায় বীচে আমার অসাধারণ সময় কেটেছে। পানি খালি চোখেই সবুজাভ নীল বর্ণের দেখায় যা এককথায় অসাধারণ। পানি এতো পরিষ্কার যে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বীচে গোসল করে একটু হাঁটাহাঁটি আর ছবি তুলে আমি আবার ঠিক আগের মতো করেই পাতায়তে ফিরে আসি।

কোহ লার্ন, পাতায়া কোহ-লার্ন দ্বীপে যেতে আসতে আপনার সময় লাগবে ৪০+৪০ মিনিট। আর মাঝে আপনি যতক্ষণ দ্বীপে সময় কাটাবেন সেটা আপনার ইচ্ছার ব্যাপার। প্রায় দুপুর ৩টায় আমি পাতায়াতে পৌঁছাই এবং দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ৪টার দিকেই বের হয়ে যাই পাতায়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর্ট মিউজিয়াম “আর্ট ইন প্যারাডাইজ” (Art in Paradise) এর উদ্দেশ্যে।

মোটরবাইক দিয়ে আমি মিউজিয়াম দেখতে চলে যাই। এই জাদুঘরে যাওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি যা মিস করেছি তা হলো সঙ্গ। মনে হয়েছে শুধুমাত্র ছবি তোলার জন্য হলেও একজন সঙ্গী দরকার ছিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো এখানে যাবার পূর্বে অবশ্যই Art in Paradise নামে মোবাইল এপ্লিকেশন নামিয়ে নিবেন। এবং যাবার আগেই “পাতায়া”র সব এনিমেশন গুলো ডাউনলোড করে নিয়ে যাবেন। নতুবা ওখানে গিয়ে প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যাবে। এনিমেশনের সাথে বাস্তবের চিত্রের সংমিশ্রণে নিজের ছবিগুলো নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগবে। আমি অন্যদের তোলা ছবি দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। নিজে খুব একটা তুলতে না পারলেও এনিমেশনগুলোর ছবি তুলে এনেছি যা আপনারা আমার প্রোফাইলে গেলেই দেখতে পারবেন। ডাউনলোডের কারণে আমার বেশখানিক সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ওখানে আমার ভালোই সময় পার হয়ে যায়।

তারপর রাত প্রায় ৮টায় আমি রওনা হই রাতে পাতায়া শহরের ভিউ দেখার উদ্দেশ্যে একদম সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়ায় মোটরবাইকে করেই যেতে হবে। রাতে পাতায়া শহর দেখতে আসলেই ছবির মতো দেখায়। চারদিকে আলোর খেলা সাথে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া বাঁকা রাস্তা রাতের বেলায় দেখতে আসলেই চমৎকার দেখায়। এখানে মাত্র ১৫মিনিট সময় পরেই রওনা দেই আবার আমার হোটেলের পথে। রাতের খাবার সেরে একটু ভালোমত বিশ্রাম নিয়ে পাতায়র বিখ্যাত Walking Street দেখতে রওনা হই । হেঁটে বীচের পার ঘেঁষেই চলে যেতে পারবেন Walking Street-এ। এই স্থান আসলে রাতেই বেলাতেই জেগে উঠে। দিনের বেলা এখানে কিছুই দেখার নেই। এই যায়গায় অবশ্য পরিবারের মানুষ নিয়ে ঘুরতে যাওয়াটা একটু চিন্তার ব্যাপার। তবে কাছাকাছি মানসিকতার জুটিরা অনেকেই এই যায়গা একসাথেই ঘুরতে বের হয়। এখানে গেলেই বুঝতে পারবেন আপনি যেন এক অন্য দুনিয়ায় চলে এসেছেন। পাতায়া গিয়ে Walking Street ঘুরতে যাবেন না এটা কল্পনা করাও বোকামি হবে। কারো ইচ্ছা হলে ব্যতিক্রমী অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারবেন। যাইহোক ঘুরাঘুরি শেষ করে আমি ঐদিনের মতো হোটেলে ফিরে চলে আসি।ঞ্চ

চতুর্থ দিন চতুর্থদিন ছিল পাতায়কে বিদায় জানানোর দিন। প্রতিবার কক্সবাজার গেলেও ফিরে আসার সময় মনের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভূত হয়। অদ্ভুত হলেও সত্যি পাতায়াকে বিদায় জানাতে আমার এর থেকে বেশি খারাপ লাগছিল। যেহেতু ১২টা পর্যন্ত চেক-আউট করার সময় ছিল, তাই সকালে উঠেই বীচে চলে যায় এবং বেশ কিছুক্ষণ বীচের পাড়েই হাঁটাহাঁটি করি। এরপর চলে যাই পাতায়ার বিখ্যাত একটি শপিং মল সেন্ট্রাল ফেস্টিভ্যাল-এ। এর একদম উপরতলায় একটি কেএফসি রেস্টুরেন্ট আছে যেখান থেকে সকালের পাতায়ার সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। অসাধারণ ভিউ।

কেএফসি-তে নাস্তা করে আমি হোটেলে এসে চেক-আউট করে রওনা হই আবার আমার গন্তব্য ব্যাংককের পথে। মোটরবাইক বা টুকটুক করে চলে যেতে হবে পাতায়ার বাসস্ট্যান্ড-এ। তারপর আগের মতোই ব্যাংককে ফিরে আসতে হবে। ব্যাংককে এসে ঐদিন আর অন্য কোথাও না গিয়ে কিছু শপিংয়ের জন্য চলে যাই সিয়ামের MBK Center শপিং মলে। এতো বড় শপিং মল যে রাস্তা হারিয়ে কোথায় যে হারিয়ে যাবেন নিজেই টের পাবেন না। হেটে ঘুরতেই পায়ে ব্যাথা হয়ে যায়। এতোই বড় যে আমি ওদের MBK Directory হাতে নিয়ে খুঁজে খুঁজে ঘুরেছি। ওখানেই রাত হয়ে যাওয়ায় রাতের খাবার খেয়ে ঐদিনের মতো হোটেলে এসে এক লম্বা ঘুম দেই।

পঞ্চম দিন পঞ্চমদিন ছিল আমার থাইল্যান্ড-এর শেষদিন। একা হয়েও যে পরিমাণ ঘুরেছি তা-তে নিজের মধ্যে একরকম ভালোই তৃপ্তি কাজ করছিল। আমার ফ্লাইট ছিল রাত ১১টায় তাই আমার কাছে ঘুরাঘুরি করার জন্য সারাদিনই পড়ে ছিল। হোটেলে আবার দুপুর ১২টার মধ্যেই চেক-আউট করতে হবে। তাই আমি সকালে ১০টায় হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলেই আমার ব্যাগ জমা দিয়ে চেক-আউট করে ফেলি। ব্যাগ জমা দিয়ে যাওয়ার আইডিয়াটা আমার কাছে চমৎকার লেগেছে।

আমি রওনা হই ব্যাংককের একটি অসাধারণ পার্ক যা Lumphini Park নামে পরিচিত। নানা থেকে সিয়ামে বা ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ষ্টেশনে গিয়ে ট্রেন লাইন পরিবর্তন করে সিলম (Silom Line) লাইনের BTS ট্রেনে করে চলে যেতে হবে সালা ডায়েং (Sala Daeng) ষ্টেশনে। প্রধানত পর্যটকরা BTS এর যে লাইনে বেশি চলাচল করেন সেটি সুকুমভিত লাইন (Shukumvit Line) নামে পরিচিত। যাইহোক সালা ডায়েং-এ নেমে একটু হেটে গেলেই পেয়ে যাবেন বিখ্যাত সেই Lumphini Park। একটি পার্ক যে এতো অসাধারণ হতে পারে তা এখানে না আসলে হয়তো দেখাই হতো না। বুড়োদের থেকে শুরু করে সব বয়সীদের জন্য আছে আড্ডা দেয়ার মতো সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। বড় গ্রুপ করে আসলেও সবাই একসাথে বসে আড্ডা দেয়ার মতো করেও অনেক বসার যায়গা রয়েছে। আছে লেক, যেখানে চাইলে বোটিংও করতে পারবেন। আছে বাচ্চাদের জন্য আলাদা করে দেয়া মজার মজার রাইড। এতো সুন্দর হাঁটার রাস্তা যে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার যা চোখে পড়েছে তা হলো ওদের পার্ক ব্যবস্থাপনা। এতো সুবিশাল পার্ক তবুও চোখে একটু ময়লাও ধরা পড়বে কিনা সন্দেহ। ব্যাংকক গেলে অবশ্যই একবার এই পার্কে ঘুরে আসবেন। অন্তত এটা বুঝতে পারবেন একটা শহরে আসলে কীরকম পার্ক থাকা উচিৎ। আমি যদিও সকালের সময় গিয়েছিলাম, আমি এটা নিশ্চিত যে বিকেলের বেলা গেলে আর ফিরে আসতে ইচ্ছা করবে না।

এরপর আমি ফিরে আসি ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ষ্টেশনে। হেঁটেই চলে যাই কাছের একটা ছোট্ট যাদুঘর Jim Thomson House Museum দেখতে। এটা মূলত Sir Jim Thomson এর নিজের গড়া কাঠের বাড়ি যিনি কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থাইল্যান্ডে পারি জমান। এখানে আসলে কিছু ব্যাতিক্রমী চিত্রকর্ম আর বুদ্ধের কিছু পুরনো মূর্তি ছাড়া দেখার কিছু নেই। চাইলে আপনারা এটা বাদও দিতে পারেন। পকেট থেকে ২০০ থাই বাথ বেঁচে যাবে। যাইহোক, ব্যাংককে আমার শেষ গন্তব্য ছিল বিখ্যাত চাটুচাক উইকেন্ড মার্কেট (Chatuchak Weekend Market) যা মো চিত (Mo Chit) BTS স্টেশেনের কাছে অবস্থিত। ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ষ্টেশন থেকে সিয়াম এসে চলে যেতে হবে (Mo Chit) BTS স্টেশেনে। এরপর নেমে হেঁটেই চলে যাওয়া যাবে Chatuchak Weekend Market-এ। এখানে গিয়ে আপনারা অনেকটা ঢাকার নিউমার্কেটের মতো অনুভূতি পাবেন। যদিও এই পুরো মার্কেটটি বরাবরের মতোই অন্যান্য স্থানের মতো অনেক পরিষ্কার। এখানেই দেখতে পেলাম বিদেশি ভিক্ষুক, যারা কিনা শুধু শুধুই ভিক্ষা করেনা। প্রত্যেকেই কোন না কোন একটা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দেখিয়েই ভিক্ষা করে থাকে। এর মধ্যে আছে গান, অভিনয়, যেমন খুশি তেমন সাজো টাইপ সাজ ইত্যাদি। এখানে গেলে আপনারা ইচ্ছামতো অনেক বিচিত্র ধরনের রাস্তার খাবার চেখে দেখতে পারবেন। চাইলে কেনাকাটা করার সুযোগ তো খোলাই রয়েছে। এখানে ঘুরাঘুরি শেষ করে আমি আবার আমার হোটেলে ফিরে যাই। তারপর ব্যাগ নিয়ে রওনা হই বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।

শেষ মুহূর্তের দুঃখ বলতে এটাই বলতে হয়, বিমানে আমার টিকেটের লাগেজ নেয়ার অনুমতি ছিলনা। আর হাতের বা কাঁধের ব্যাগে আপনি ১০০ মিলিঃ থেকে বেশি কোন তরল জিনিস বহন করতে পারবেন না। আমি যদিও যাওয়ার সময় এটা জানতাম, আসার সময় একটু-আধটু শপিং তো করেছি। তাও তা ছিল আমার মায়ের জন্য। কিন্তু থাই লায়ন কর্তৃপক্ষ আমার জিনিসগুলো বের করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। সামান্য কিছু টাকা ক্ষতি হলেও খুব বেশি ক্ষতি হয়নি কারণ আমি মূলত বলার মতো কিছুই কেনাকাটা করিনি।

খরচ ও ভ্রমণ টিপস থাইল্যান্ড ভ্রমণ ছিল আমার জীবনের প্রথম কোথাও একা ভ্রমণ। তাই ব্যাপারটা আমার কাছে একটু চ্যালেঞ্জিংও ছিল। এই আমার বর্ণনার সাথে আর ফেসবুকে আপলোড করা ছবির সাথে মিলিয়ে ঘুরাঘুরি করা ও খাবারদাবারের একটি খুব ভালো আইডিয়া পেয়ে যাবেন। অবশ্যই মনে রাখবেন, পকেটের টাকা খরচ করার একটি উৎকৃষ্ট(!) দেশ হলো থাইল্যান্ড। এখানে আপনার যাওয়া-আসা সহ সব মিলিয়ে অনেক বেশি টাকাই খরচ করতে হবে। আর আমার মতো একা ঘুরতে গেলে তো হলোই।

আমার ব্যক্তিগত হিসাবে সব মিলিয়ে আমার খরচ পড়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকার আশেপাশে। ৪৫০০০ হাজার টাকার থাই বাথ (১৫০০০ থাই বাথ) আমি বাংলাদেশ থেকেই নিয়ে যাই যা থেকে আমার প্রায় ৬০০০ টাকা ফেরত এসেছে। আপনারা চাইলে ডলারও নিয়ে যেতে পারেন। থাইল্যান্ডে বিমানবন্দরসহ প্রচুর মানি এক্সচেঞ্জ পাওয়া যায় যেখানে কোন ফি ছাড়াই থাই বাথ নিতে পারবেন এবং খরচ মোটামুটি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেলেও একই বলা যায়। আমি ঈদের সময় তাও একদম শেষ মুহূর্তে থাই বাথ কিনি যার দরুন এখানেও আমার প্রায় ২০০০-২৫০০ টাকার মতো গচ্চা গেছে। এর সাথে যোগ হবে আমার বিমান ভাড়া প্রায় ২২০০০ টাকা ও ভিসা করানোর খরচ প্রায় ৩৮০০ টাকা। থাইল্যান্ডে খাবার খরচ মোটামুটি বাংলাদেশী টাকার হিসেবে বেশিই বলা যায় যা মিলপ্রতি প্রায় বাংলাদেশী টাকায় ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।

থাইল্যান্ডে ব্যাংকক কিংবা পাতায়াতে প্রচুর Street Food পাবেন এবং প্রচুর ফলের জুসও তুলনামূলক কম খরচেই পাবেন। তাই এসব খাবারও খেয়ে দেখবেন। মজার ব্যাপার এখানে McDonalds ও KFC’র মতো চেইনস্টোর গুলোতে অন্যান্য স্থানের তুলনায় খরচ কম বলা যায়। ছোটখাট শপিং যেমন চকলেট, জুসসহ টুকটাক বাজার সাশ্রয়ী মূল্যে করার জন্য বাংলাদেশের স্বপ্ন-আগোরার মতো দেখতে 7 Eleven, Family Mart ইত্যাদি ছোট ছোট শপ থেকে প্রচুর কেনাকাটা করতে পারবেন।

ব্যাংককে খাবারের জন্য Bumrugrad International Hospital এর আশেপাশে অনেক বাংলাদেশী-ইন্ডিয়ান-এরাবিয়ান রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাবেন। পাতায়া বীচ রোডের শেষ প্রান্তে Walking Street শুরু হবার একটু আগেই এরকম অনেক রেস্টুরেন্ট পাবেন। খোলামেলা ভাবেই থাইল্যান্ডে বারে বিভিন্ন ধরণের দেশি-বিদেশি ড্রিংক্স পাওয়া যায় এবং যে বা যারা ইচ্ছা তা কিনতে পারবেন। থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ থেকে যে বিমানগুলো যায় তার মধ্যে থাই লায়ন সবচেয়ে সাশ্রয়ী। চেষ্টা করবেন কমপক্ষে ১.৫ থেকে ২ মাস আগেই বিমানের টিকেট কিনে ফেলতে তাহলে অনেক কমের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।

থাইল্যান্ড যাওয়ার আগে অবশ্যই ভালোমত Google Search, Google Map, YouTube-এসব দেখে একটা ভালো আইডিয়া নিয়ে যান, তাহলে অনেকটুকু সময় বেঁচে যাবে। অতিপ্রয়োজনীয় কিছু মোবাইল এপ্লিকেশন যেমন Google Map, Agoda, Grab, Uber, Line, Art in Paradise ইত্যাদি ইন্সটল করে নিন।

অবশেষে এটাই বলতে চাই, বিদেশ গেলে আমার যে জিনিসটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যে আমাদের দেশটা কেন অন্যান্য দেশগুলোর মতো এতোটা পরিষ্কার বা বালুমুক্ত না! আমরা আসলে নিজেরা চাইলেই পারি এই অবস্থার একটা পরিবর্তন করতে। এক-দশ বছরে না হোক, একটা প্রজন্ম পরে হলেও আমাদের দেশটা ঐ পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে আমি সবসময় স্বপ্ন দেখি। তাই চলুন নিজেরাই আগে নিজেদের বদলাই। থাইল্যান্ড সংক্রান্ত উপরে বর্ণীত তথ্যের বাইরে আরও কিছু জানার থাকলে আমার সাথে কমেন্টে বা ইনবক্সে যোগাযোগ করতে পারেন। সবাই ভালো থাকবেন। আপনার ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক। Happy Travelling. Think Green. Live Green. Life is short; enjoy it till the last moment. Never miss an opportunity. Take Care.

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত