ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

নজরুল-প্রমিলা স্মৃতি বিজড়িত তেওতা জমিদার বাড়ি

  নিরঞ্জন সূত্রধর, শিবালয়(মানিকগঞ্জ)

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ১১:৪৫

নজরুল-প্রমিলা স্মৃতি বিজড়িত তেওতা জমিদার বাড়ি
ছবি: তেওতা জমিদার বাড়ি

বিদ্রোহ, প্রেম এবং সাম্যের বানী নিয়ে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তার সাহিত্যে নারী জাগরণ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ অনেক লেখা স্থান পেয়েছে। তিনি ভারত বর্ষে প্রথমবারের মতো পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বিদ্রোহের চরম পর্যায় ছিলো ভারত বর্ষ থেকে ব্রিটিশ উচ্ছেদ। তার বিদ্রোহী চেতনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক বিশাল অবদান রেখেছেন তিনি।

কবি তার সংগ্রাম ছাড়াতেই হয়তো মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়ির ব্যারিস্টার কিরণ শঙ্কর রায়ের বাড়িতে একাধিকবার আসা যাওয়া করেছেন। নজরুলের সাহিত্য চর্চার প্রেরণা এবং প্রেমের উৎস কবির সহধর্মিণী আশুলতা সেন গুপ্ত দোলন বা দুলি। আশুলতা সেনগুপ্ত ছিলেন তেওতা গ্রামের মেয়ে।

বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত এবং তার স্ত্রী গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান আশা লতা সেনগুপ্ত ১৯০৮ সালে তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তেওতায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। তার বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় নায়েব পদে চাকরি করতেন। কাকা ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন। ইন্দ্র কুমার চাকরি সূত্রে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে বাড়ি-ঘর করে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।

বসন্ত কুমারের পরিবার তেওতার বাড়িতে অবস্থান করতেন। হঠাৎ বসন্ত কুমারের মৃত্যুতে আশালতার মা অসহায় হয়ে পড়লে তার কাকা ইন্দ্র কুমার আশালতা ও তার মা গিরিবালা দেবীকে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে নিয়ে যান। কাজী নজরুল ইসলাম তার বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় বেড়াতে আসলে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে তার সঙ্গে আশালতার পরিচয় হয়।

ছবি ১: তেওতা জমিদার বাড়ি

নজরুল আশালতার টানে পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন এবং বিয়ের আগে তেওতায় আসেন দুই-তিনবার। শেষবার জেল মুক্ত হয়ে কুমিল্লায় আসলে আশালতা ও নজরুলের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এক পর্যায়ে নজরুল কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। সামাজিক চাপে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আশালতার মা গিরিবালা দেবী আশালতাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান।

১৯২৪ সালে গিরিবালা দেবীর একান্ত ইচ্ছায় নজরুল ও আশালতার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন ‘প্রমিলা’। যমুনা’র পাড়ে পঞ্চানন সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তেওতা জমিদার বাড়ির পরবর্তী বংশধর কিরণ শংকর রায় চৌধুরীও ছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনের আর এক সৈনিক। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের যে কয়জন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার কিরণ শংকর রায় চৌধুরী তাদের অন্যতম। গান্ধীজী, নেতাজি কিরণ শংকর, নজরুল এরা সকলেই ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ বিতারণে একাট্টা ছিলেন। তাই নজরুল প্রমিলার টানে যেমন তেওতায় একাধিকবার এসেছেন, তেমন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের পথ ধরেও হয়তো তেওতার জমিদার কিরণ শংকর রায় চৌধুরীর কাছাকাছি হয়েছেন।

ছবি ২: তেওতা জমিদার বাড়ি

উল্লেখ্য, ব্যারিস্টার কিরণ শংকর রায় চৌধুরী ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এসব দিক দিয়ে ঐতিহ্যবাহী তেওতার জমিদার বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

এদিকে, নজরুল প্রমিলা স্মৃতি বিজড়িত ঐ জমিদার বাড়ি, প্রমিলার জন্মস্থান এবং প্রমিলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তেওতা গ্রামে অবস্থিত। নজরুল প্রমিলার স্মৃতি বিজড়িত স্থানে তাদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রতিবছর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে।

শিবালয়ে নজরুল প্রমিলা ইনস্টিটিউট, নজরুল-প্রমিলা পরিষদ, নজরুল-প্রমিলা সাহিত্য সংসদ, প্রমিলা নজরুল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ওই সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তেওতায় প্রমিলা-নজরুল নামে পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার মত একই মর্যাদায় নজরুলের শ্বশুর বাড়িতে সরকারিভাবে নজরুল জন্ম-জয়ন্তী ও মৃত্যু বার্ষিকী পালন, নজরুল কমপ্লেক্স নির্মাণ, শিবালয়-জাফরগঞ্জ সড়কটি নজরুল-প্রমিলা সড়ক নামকরণ, মানিকগঞ্জ শহরে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ নামকরণ, মানিকগঞ্জ শহরে তেজেন মিত্রের বাড়িতে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন (ঐ বাড়িতে কবি ১৯৩৮ সালে অবস্থান করেন), নজরুল প্রমিলার স্মৃতি বিজড়িত স্থান জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ এবং নজরুল-প্রমিলার ভাস্কর্য স্থাপনা ইত্যাদি দাবী তোলা হয়।

ছবি ৩: তেওতা জমিদার বাড়ি

শিবালয় নজরুল-প্রমিলা সাংস্কৃতি গোষ্ঠীর সভাপতি অজয় চক্রবর্তী বলেন, নজরুল ও তার স্ত্রী প্রমিলার স্মৃতিধন্য তেওতায় সরকারি উদ্যোগে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে নজরুল সাহিত্য যেমন বিকশিত হবে এমনি এ স্থানটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়ে উঠবে।

তেওতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের জানান, তেওতা জমিদার বাড়িটি সরকারিভাবে সংস্কারের বিশেষ প্রয়োজন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী তেওতা জমিদার বাড়ি ঘুরতে আসা ভ্রমণ পিপাসু রাবিতা আক্তার, সেলিনা আক্তার, ফারজানা আক্তার ও সুমন শেখ জানান, তাদের বাড়ি জেলার ঘিওর উপজেলায়। তারা তেওতা বেড়াতে এসে অনেক আনন্দ পেয়েছেন। জমিদার বাড়ির অনেক কিছু দেখে অনেক ভালো লেগেছে। কিন্তু বাড়িটি সংস্কার করা হলে আরো অনেক ভালো লাগতো। বাড়িটি সংস্কার করার প্রয়োজন।

ঢাকা প্রত্ন-তত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় বলেন, আমরা তেওতা জমিদার বাড়িটি কিছুটা সংস্কার করেছি। আরো সংস্কার করা হবে। শুক্রবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিএম রুহুল আমিন রিমন বলেন, এ বাগিটি প্রত্ন-তত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়েছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত