ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৩)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৪:২৬  
আপডেট :
 ০৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৪:৩০

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৩)

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -২৩)

সাময়িকভাবে কেউ কেউ কারণে-অকারণে পিছ পিছ ঘুরে সুবিধা নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু মালিকরা মালিকই থাকেন। কর্মচারী কর্মচারীই। বরং এ ধরনের লোকের জন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়। অসত্যকে যারা সত্য বলে পার পেতে চান সাময়িকভাবে তারা সুবিধাভোগী হন। তবে একথাও সত্য যে, কেউ কেউ নিরলস শ্রম ও মেধা দিয়ে নির্মোহভাবে কাজ করে প্রতিষ্ঠানকে ওপরে তুলে ধরেন, সুনাম ছড়িয়ে দেন। তারা অন্তর্মুখী। এমনিতেই তাদের মূল্যায়ন হয়, প্রচার করতে হয় না। কিন্তু এ শ্রেণীর লোক যারা মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে বেশি বেশি ঘুরঘুর করেন না, তারা আবার ছিটকেও পড়েন। তবে তাদের চাকরির অভাব হয় না। অবশ্য কোনো কোনো সময় একজনের ভাল কাজের সুবিধাভোগী আরেকজন হয়ে ওঠেন। আমাদের সমাজে এমন নজিরের অভাব নেই।

এসব কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশ প্রতিদিন ভাল চলছে। দিন দিন প্রচারসংখ্যা যেমন বাড়ছে ব্যবসাও বাড়ছে। মালিক-কর্তৃপক্ষও খুশি। আগেই বলেছি, সব প্রতিষ্ঠানেই নানা ধরনের জটিলতা থাকে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে। এসব মানিয়ে নিয়েই কাজ করতে হয়। চাকরি করতে হলে এসবের বিকল্প নেই। কিন্তু আমি মনে হয় সেই ধাঁচের বিপরীতে অবস্থান করছিলাম। কাগজ বড় হয়ে গেছে, নাম-ধাম সম্মানও অনেক। সুযোগ-সুবিধাও ভাল। কিন্তু কিছু কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। শুধু সুযোগ-সুবিধাই কি মানুষের জন্য সবকিছু? আমি মনে করি ‘না’। তবে একথা বলে রাখা ভাল, মালিক-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কখনো তেমন মতবিরোধ হয়নি। পত্রিকার প্রচার, চালুসহ যে কোন বিষয়ে আমি যা বলেছি মালিক পক্ষ কখনও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। কেননা তারা দেখছেন, পত্রিকা ভালভাবে চলছে। তাই মালিকপক্ষের কাছ থেকে যখন যা চেয়েছি তা পেয়েছি। তবে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে, একটি দৈনিক প্রত্রিকা এবং তার সম্পাদক সম্পর্কে বিরূপ প্রায় একই ধরনের একাধিক রিপোর্ট ছাপানোর বিষয়টি আমার পছন্দ ছিল না। কেননা ঘুরেফিরে প্রায় একই বিষয়ে কয়েকদিন পরপরই রিপোর্ট করা হতো। এ রিপোর্টগুলো ছাপার জন্য কর্তৃপক্ষীয় আদেশ আসত। নতুন কিছু হলে আমার আপত্তি থাকতো না। ঘুরেফিরে একই ধরনের খবর। আমি এ বিষয়ে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানায়, ওই পত্রিকাটি তাদের দুঃসময়ে তাদের বিরুদ্ধে অনেক রিপোর্ট করেছিলো। তাদের মতে ওই রিপোর্টগুলো সত্য ছিল না। এ সময় তারা আরেকটি দৈনিকের কথাও উল্লেখ করে।

বসুন্ধরার মালিক স্পষ্টই জানান, সংবাদপত্রের ব্যবসায় তাদের আসার ইচ্ছা ছিল না। শুধু তাদের বিরুদ্ধে ওই পত্রিকা দু’টির লেখালেখির কারণে পত্রিকা বের করতে বাধ্য হন। একটি পত্রিকা ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে টানা নিউজ করার বিষয়টির সাথে আমি একমত হতে না পারলেও মালিক পক্ষের যুক্তির পর আমার বলার বা করার কিছু ছিল না। এছাড়াও আমার আপত্তি বা রক্তক্ষরণ ছিল মালিকের নাম ব্যবহার করে কারও কারও অতিরিক্ত খবরদারি। পত্রিকার স্বার্থে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে মালিককে এ-কথাগুলো আমি কখনও বলিনি। হজম করেছি। নিজ হাতেগড়া পত্রিকার কোন ক্ষতি হোক, কোন সময়ই চাইনি। বলতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিদিন আমার সন্তানের মতো। নিজ সন্তানের কোন ক্ষতি কি কারো কাম্য হতে পারে? আর আমি দেখেছি, একই গ্রুপের আরেকটি কাগজ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রথম থেকেই আমি এ ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। তাই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়েই কাজ করেছিলাম। কিন্তু একদিনের একটি ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। প্রতিদিন বিকালে আমি সংবাদসংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করতাম। বৈঠকটি মূলত পরদিন পত্রিকায় কী কী নিউজ ছাপা হবে, কীভাবে ছাপা হবে ইত্যাদি নিয়ে। সেদিনও বৈঠকে বসেছি। বার্তা সম্পাদক যথারীতি দিনের নিউজের তালিকা আমার হাতে দিলেন। প্রতিদিনের মতো সবাই মিলে পরদিনের পত্রিকার পরিকল্পনা শুরু করি। এমন সময় নতুন যোগ দেয়া এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হঠাৎ করে আগের দিন ছাপা হওয়া একটি নিবন্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানতে চান এ নিবন্ধ কার অনুমতিতে ছাপা হয়েছে?

আর লেখকের নামের বিশ্লেষণে ‘মহানায়ক’ কেন? আমি বিস্মিত। আমি সম্পাদক। পত্রিকায় যা ছাপা হয় দায় দায়িত্ব সম্পাদক হিসেবে আমার আর প্রকাশকের। আর পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি মেনে কোনো নিবন্ধ ছাপাতে সম্পাদককে কারো অনুমোদন নিতে হবে এটি কেমন কথা? এমনটিতো কখনও শুনতে হয়নি। আর নিবন্ধটি ছিলো একটি বিশেষ দিন উপলক্ষে লেখা। লিখেছেন একজন বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা। বর্তমানে মন্ত্রী। এসব দিবসে যার লেখা আনার জন্য অনেক পত্রিকার লোক গিয়ে বাসায় বসে থাকেন। আর আমরা বলতেই পেয়ে গেছি। গণঅভ্যুত্থানের ‘মহানায়ক’ হিসেবেই তিনি পরিচিত। তার এমন প্রশ্নে আমার মতো ওই বৈঠকে উপস্থিত অন্যরাও হতবাক। পত্রিকায় আমার পর যার অবস্থান ছিল তিনি বললেন, তার লেখাতো আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। আর তিনিতো গণঅভ্যুত্থানের ‘মহানায়ক’ সবাই জানেন। সবাই লেখেন। নিবন্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ওই সাংবাদিক আরও কিছু বলতে চাইলে অন্যরা থামিয়ে দেন। আমি এই একদিন সম্পাদক হিসাবে নিজেকে অনেক অসহায় বোধ করেছি। আমার অবস্থান থেকে কোন অভিযোগ, অনুযোগ করা যথার্থ নয়। তাই সেদিন থেকে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণায় ছিলাম। তার এ-ধরনের ব্যবহারের কারণও জানার চেষ্টা করি। আমার জানা মতে, ওই নিবন্ধ লেখক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপানকারী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের ভাল সম্পর্কই ছিল। নিয়মিত ওই নেতার বাসায় যাতায়াত ইত্যাদি ছিল। পরে কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো কোনো সমস্যা হতে পারে। যে কারণে ওরকম বিরূপভাব। আর অনেকদিন চাকরিহীন অবস্থায় থেকে হঠাৎ করে আগের চেয়ে ভাল বেতন, সুযোগ-সুবিধার চাকরি পেয়েও তিনি একটু বেপরোয়াই হয়ে থাকতে পারেন। তিনি ভাল রিপোর্টার ছিলেন। ভাল কলামিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিনে চাকরি হওয়ার পর তার ব্যবহার, চাল-চলন পাল্টে যায়। কারণ ওই সাংবাদিক আগেও এক পত্রিকায় আমার সঙ্গে কাজ করেছে। তখন এমন দেখিনি। আর আমার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল চমৎকার। দারুণ আড্ডাবাজ। রোমান্টিক। কিন্তু হঠাৎ যেন বদলে যান মানুষটি। আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়ে আসার পরও তার বেপরোয়া ভাব অব্যাহত থাকে বলে জেনেছি। মালিকপক্ষের সাথে সুসম্পর্কের দোহাই ছিল এর মূল কারণ।

কিন্তু তিনিও বেশিদিন টিকলেন না। ভিতরে ভিতরে অনেকেই তার এত বেপরোয়া গতি মেনে নিতে পারেনি। লোকটি মেজাজী, তবে এতটা জটিল নয়। তার মেজাজের সুযোগ নেয় অন্যরা। আগেই বলেছি, মালিককে বন্ধু ভাবা ঠিক নয়। বন্ধু ভেবে সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু মালিক অবশ্যই তার প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখবেন। চাকরি করতে হলে কর্মচারী হয়েই কাজ করতে হবে। ওই সাংবাদিকের বেলায়ও তাই হয়েছে। যে কোন করণেই হোক তাকে পদত্যাগ করতে হয়। পদত্যাগের পর তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযুক্ত করেন ওই রাজনৈতিক নেতাকে। যার নিবন্ধ ছাপার জন্য সম্পাদককে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছিলেন। কিছুদিন ওই নেতার বিরুদ্ধে (বর্তমান মন্ত্রী) তার লেখালেখি, কথা-বার্তা চলে। পরে শুনেছি আবার তার কাছে গিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ জার্নাল/কেআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত