ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৩৬)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৪৮  
আপডেট :
 ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:৫০

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৩৬)

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -৩৬)

সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে কথা শেষের ১০ মিনিটের মধ্যে বাংলাবাজারের মনোয়ারুল ইসলাম (এখন আমেরিকা প্রবাসী) সংসদ ভবন থেকে আমার কাছে টেলিফোন করে জানায়, শাহজাহান ভাই, আপনি কী নিউজ দিয়েছেন, যাতে সংসদ ভবনে হৈ-চৈ পড়ে গেছে। আমি জানতে চাই কিসের হৈ-চৈ। মনোয়ার জানায়, এখানে কেউ কেউ বলাবলি করছেন বিএনপি তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েছে। আমি তাকে জানাই, এমন কোন খবর আমার কাছে নেই। আমি সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে একটি নিউজ নিয়ে আলোচনা করেছি মাত্র। তার নির্দেশ চেয়েছি এর বেশি কিছু নয়। মনোয়ারের সাথে কথা শেষ করে আমি বাতেন ভাইয়ের কাছে সাক্ষাৎকারটি দিয়ে বলি সম্পাদক সাহেবের সাথে এ-ব্যাপারে আমার আলোচনা হয়েছে। আপনিও কথা বলে নিতে পারেন। ভালভাবে যাবে বলেছেন। তিনি পড়ে হেডিং দিয়ে সংবাদটি ছেড়ে দেন। পরদিন এ সংবাদই প্রধান সংবাদ হবে।

আমি নিজের ডেস্কে এসে বিরোধীদলের বৈঠকের খবরের জন্য বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি ডায়াল করার আগেই ফোন আসতে থাকে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, এমনকি ঢাকার বাইরে খুলনা ও বগুড়া থেকেও স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকরা ফোন করলেন। তাদের সবারই একই জিজ্ঞাস্য, সরকার কি দাবি মেনে নিয়েছে? এর মধ্যে সংগ্রামের আজম মীর (এখন নয়া দিগন্তের যুগ্ম সম্পাদক), ভোরের কাগজের কাদির কল্লোল (এখন বিবিসি’র প্রতিনিধি) টেলিফোন করে বললো, আপনি কোথা দিয়ে কী করলেন আমরা কিছুই জানলাম না। বলারই কথা, কেননা তাদের সঙ্গে দু’বেলা নিয়মিত সাক্ষাৎ হয়। মাঠে একসঙ্গে কাজ করি। কিছুক্ষণের মধ্যে দৈনিক বাংলা থেকে জহির ভাই (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন) টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, কী বলেছেন নাজমুল হুদা। আমি বিনয়ের সঙ্গে জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করলাম। জহির ভাইও আর কিছু জানতে চাননি। কাউকে আমি সাক্ষাৎকারের বক্তব্য জানাইনি। সাবাইকে বলেছি কাল ছাপা হলে দেখবেন।

রাত সাড়ে ১০ টায় সম্পাদক সাহেব টেলিফোন করে বললেন, শোন, নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকার ছাপা হবে না। মন্ত্রী নিজেই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। আমি হতবাক হলাম। দুঃখিত হলাম। একজন রিপোর্টার হিসাবে সে মুহূর্তে আমার যেন মৃত্যু হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, এমন খবর একজন রিপোর্টারের জীবনে দু’একটি পাওয়াও কঠিন। আমি বিষন্ন বদনে বসে রইলাম। ঠিক ১১টার সময় টেলিফোন এলো মন্ত্রী নাজমুল হুদার। তিনি খুবই ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, সাক্ষাৎকারটি ছাপাবেন না, আমি দুঃখিত। মঞ্জু সাহেবকেও বলেছি। তার কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল তিনিও মর্মাহত। আমার গলার স্বর বের হচ্ছিলো না, তবুও জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, কেন এমন হলো? তিনি বললেন, খবরটি সবাই জেনে গেছে। বুঝতেই পারছেন এখন অবস্থা। তার সঙ্গে আমার আরও কিছু কথা হলো। সব কথা বলা যাবে না। রিপোর্টার হিসেবে আমরা অনেক ঘটনার সাক্ষী, অনেক কিছু দেখি, অনেক কথা শুনি। কিন্তু সবকিছু সবসময় বলা ও লেখা যায় না।

রাত সাড়ে ১১টায় আমি অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় এলাম। ভারাক্রান্ত মন দেখে স্ত্রী বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। খেয়ে সটান শুয়ে পড়লাম। আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক টেলিফোন করলেন। ছাপাই যখন হবে না তখন আমি অতি আপন দু’একজনকে বিষয়বস্তু সবিস্তারে বললাম। পরদিনও মন খুব খারাপ ছিল, যথারীতি প্রেসক্লাব, নিনিয়ানের অবস্থান ও সংসদ ভবনে গিয়েছি। সর্বত্রই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। সাক্ষাৎকার ছাপা না হওয়ায় অনেক বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অফিস, ব্যাংক ও আদালত পাড়ায়ও এ নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হয়েছে। পরদিন দুপুরে আবার আমি তথ্যমন্ত্রীর অফিসে টেলিফোন করলাম। তার সঙ্গে অল্পবিস্তর কথা হলো। আমি ততক্ষণে জেনেছি সরকারের বেশ কয়জন মন্ত্রী নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত ও শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন।

তথ্যমন্ত্রী জানালেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে তখনও কিছু বলেননি। সেদিন এভাবেই কেটে গেল। কিন্তু পরদিন সকালে যখন দৈনিক পত্রিকাগুলো নিয়ে পড়তে বসলাম তখন ইনকিলাবে দেখি আমাকে দেয়া আগের দিনের তথ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার হুবহু ছাপা হয়ে গেছে। এতে আমি আরও দুঃখ পেলাম, আমরা ছাপাতে পারিনি, অথচ অন্য কাগজে ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটি কৌশল করেছে নাজমুল হুদা সাক্ষাৎকার তাদের দিয়েছিল এমন বলেনি। যথাসম্ভব মনে পড়ে শিরোনাম ছিল, যে সাক্ষাতকার ছাপা হয়নি...। যা হোক সেদিনই নাজমুল হুদার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা ও বক্তব্য জানতে পারেন সবাই। বাতিলকৃত সাক্ষাৎকারটি ছাপা হওয়ার পর বিএনপি’র ভিতরের কট্টরপন্থীরা নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে কেউ-কেউ এমনও বলেছেন, যে রিপোর্টার সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাকেও দেখতে হবে। আমি সব খবর পেলাম নানা সূত্রে। তবে মোটেও চিন্তিত ছিলাম না। কারণ নাজমুল হুদা যে-সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার কাগজপত্র আমার কাছেই আছে। আর ইত্তেফাক কথামতো সাক্ষাৎকার ছাপেনি। ইনকিলাব নিজস্ব সোর্স থেকে সংগ্রহ করে ছেপেছে। আমি আগেই বলেছি নাজমুল হুদা এক কথার লোক। সোজাসুজি কথা বলতেন। প্যাঁচে যেতেন না।

ইনকিলাবের বক্তব্যকে তিনি তার বক্তব্য হিসেবে স্বীকার করে নেন। ফলে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয়। তবুও তিনি পিছপা হননি। নাজমুল হুদার পদত্যাগের পরেও এ নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে। সরকারি দলের কেউ-কেউ আমার নাম উল্লেখ করে বলেন, রিপোর্টার খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে, এ বিষয়ে দেখা উচিত। বিভিন্নভাবে আলোচনাও হতে থাকে। এ খবর বিরোধীদল পর্যন্ত গড়ায়। একদিন গভীর রাতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা জানালেন, তোমাকে নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। নাজমুল হুদার বিষয়টিকে সরকার সিরিয়াসলি নিয়েছে। সম্ভবত তদন্তও হবে। হয় তোমাকে রাজসাক্ষী, না হয় রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হবে। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে জানতাম। কিন্তু এতটা সিরিয়াস জানতাম না। যাহোক শেষ পর্যন্ত নাজমুল হুদা সকল দায়-দায়িত্ব স্বীকার করায় এ বিষয়টি আর বেশিদূর গড়ায়নি। শুধু তাকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। পদত্যাগের পর তিনি তার ধানমন্ডির বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারের কারণে তার মন্ত্রিত্ব গেছে তাই আমি দূরে দূরে ছিলাম। কিন্তু তিনিই আমাকে সামনে ডেকে নিয়ে যান। মনে হলো সবকিছুকে অত্যন্ত সহজভাবে নিয়েছেন। সেদিন তিনি তার বাসায় আমাদের মিষ্টিমুখও করিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীদের মধ্যেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হল। সুদূর আমেরিকায় চিকিৎসাধীন গোলাম সারওয়ার (তখন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক ছিলেন, এখন সমকাল সম্পাদক) টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, তুমি কি এমন সাক্ষাৎকার নিয়েছিলে যে আমেরিকায় বাংলা পত্রিকাগুলোতেও লেখালেখি ও নানা মহলে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি তাকে সবকিছু খুলে বললাম।

দু’দিন পরের ঘটনা। সকাল সাড়ে ১০টায় সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন সরকার দলীয় (বিএনপি) সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানকে দেখতে যাই। আমি জানতাম না তিনি অসুস্থ ছিলেন। আগের দিন ইউএনবি’র রাশেদ (বর্তমানে ইটিভি’র বার্তা প্রধান) টেলিফোন করে অসুস্থতার খবর জানিয়ে বলেন, আখতার ভাই আমাকে যেতে বলেছেন। রাশেদ, আমি এবং আরেকজন সাংবাদিক তাকে দেখতে যাই। আখতার সাহেব তখন হৃদরোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের বেডেই তিনি দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজের মতামত লিখেছেন, তা বিবৃতি আকারে দিতে চান। আমি পড়ে দেখি তার মতামত সরকারের বিরুদ্ধে যায়। ভাবলাম আবার কোন ঝামেলায় পড়ি। যাহোক তার সঙ্গে কথা বলে বিবৃতিটি নিয়ে এলাম। অন্যদের সঙ্গে কথা ছিল সেদিন বিবৃতিটি দেবো না। সবাই একসঙ্গে পরদিন দেবো। কিন্তু আমি অফিসে পৌঁছে সম্পাদক সাহেবকে মেজর আখতারের বিবৃতির কথা জানালে তিনি দিয়ে দিতে বলেন। পরদিন ইত্তেফাকে তার বিবৃতিটি ছাপা হয়। ইউএনবি প্রচার করেনি এবং অন্য কোন কাগজেও ছাপা হয়নি। রাশেদ পরদিন আমাকে ধরলো। আমি তাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। রাশেদ শান্ত হলো। পরে অবশ্য বিএনপি সদস্য নূরুল ইসলাম মনিও সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছিলেন।

আরেকটি ছোট ঘটনা। নাজমুল হুদার সাক্ষাতকার গ্রহণের দিন বিরোধীদলের বৈঠক শেষে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে ফোন করে বললেন, আমি অফিসে আসছি, তুমি সাক্ষাতকারের একটি ফটোকপি করে রাখ। আমি দেখব কি বলেছে। আমি ফটোকপি করে রাখি। অফিসের নিচে এসে তিনি আবার ফোন করে বললেন, কপিটি নিয়ে নিচে যেতে। নেমে দেখি গাড়ির ড্রাইভিং আসনে তিনি আর পাশে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি তখন এনডিপি নেতা এবং এমপি ছিলেন। তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সাথে তিনিও যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসি হওয়াদের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের একজন। মঞ্জু সাহেবের হাতে ফটোকপি তুলে দিলে তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরে যান।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ জার্নাল/কেআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত