ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৩৭)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:৪২  
আপডেট :
 ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:২৩

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৩৭)

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -৩৭)

তিন.

সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তী ভূমিকা

রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই গুরুতর আকার ধারণ করায় বিরোধীদলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা বারবার রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। ৫ জানুয়ারি ’৯৫ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা আমির হোসেন আমু (বর্তমান শিল্পমন্ত্রী), তোফায়েল আহমদ (বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী) ও মোহাম্মদ নাসিম (বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেডিডেন্টকে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বলেন। তখনও প্রেসিডেন্টের কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় ছিল না। এ অবস্থায় আমি মনে মনে স্থির করি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? প্রেসিডেন্ট এ পর্যন্ত কোন সংবাদপত্র বা সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেননি। আমাকে কি দেবেন? মাথার মধ্যে বেশ কিছুদিন এ বিষয়টি ঘুরপাক খেতে থাকে। বিরোধীদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য খুবই জরুরি। মাথায় এলো ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননের কথা। তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের সম্পর্ক আত্মীয়তার। অফিসে বসেই ভাবছিলাম, এমন সময় ওয়ার্কার্স পার্টির তরুণ নেতা নূরুল ইসলাম ছোটন ইত্তেফাকে আসেন (পরে তিনি বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন)। তাকে আমার সামনে বসতে দিয়ে কথাটা বলি। ছোটন আমার বক্তব্য খুবই সময়োপযোগী আখ্যা দিয়ে জানাল, মেনন ভাইয়ের (রাশেদ খান মেনন, বর্তমানে বেসমরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী) সঙ্গে তার রাতে দেখা হবে। রাতেই এ বিষয়ে কথা বলবেন। পরদিন ছোটন টেলিফোন করে মেনন সাহেবের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকার গ্রহণে তার সাহায্য চাইলেন। মেনন সাহেব জানালেন, তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন এবং আমাকে জানাবেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেনন সাহেবের বাসায় টেলিফোন করি। তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্ট সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। সময়ও দিয়েছেন। তারিখটা ছিলো ১৯৯৬ সালের ৯ জানুয়ারি। মাত্র একঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। মেনন সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি কৃতজ্ঞ। ৮ জানুয়ারি রাতে প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারি সোবহান সাহেবকে টেলিফোন করে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বললে তিনি কিছু জানেন না বলে উত্তর দিলেন। আমি হতাশ হলাম। কিন্তু সময়টা যেহেতু রাশেদ খান মেনন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারণ করেছেন তাই প্রেস সেক্রেটারি নাও জানতে পারেন। আমি সোবহান সাহেবকে বললাম, আপনি মেনন ভাইয়ের নাম করে প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করুন। আমি আবার যোগাযোগ করব। তিনি জানালেন, সকালে অফিসে গিয়ে তিনি খোঁজ নেবেন।

৯ জানুয়ারি, ৯৬ সকাল ৯টা। হরতালের দিন। ঘুম থেকে উঠে আমি বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। প্রেসক্লাব হয়ে বঙ্গভবনে যাবো। এমন সময় আমার টেলিফোন বেজে উঠলো। বঙ্গভবন থেকে সোবহান সাহেব। তিনি জানালেন, সাক্ষাৎকারের সময় ঠিক আছে। তুমি সময়মতো এসো। আর প্রেসিডেন্ট চান তোমাদের বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার সাহেবও আসুন। আমি তাকেও ফোন করে দিয়েছি। প্রেসিডেন্টের সাক্ষৎকার নেয়ার জন্য আমি চেষ্টা করছি, সারওয়ার ভাইকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। অবশ্য সময় সম্পর্কে কিছু বলিনি। কারন সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর বলবো। এসব কারণে সম্পাদককেও বলিনি। কেননা একবার কনফার্ম করে পরে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি অনেক বেশি। না পারলে ব্যর্থতার গ্লানি নিজের কাছেই থাকুক। অন্য কেউ জানলো না। সোবহান সাহেব ফোন রাখার পরই সারওয়ার ভাই টেলিফোন করলেন। আমি তাকে সব খুলে বললাম। তিনিও বললেন, বঙ্গভবন থেকে তাকে টেলিফোন করেছে। ঠিক হলো দু’জন একসঙ্গে যাবো। হরতালের মধ্যে সংবাদপত্রের ব্যানার লাগানো বেবি ট্যাক্সিতে নির্ধারিত সময়ের ১১ মিনিট আগেই আমরা বঙ্গভবনে গিয়ে পৌঁছলাম। দোতলায় সোবহান সাহেবের রুমে আধঘণ্টা অপেক্ষার পর প্রেসিডেন্টের রুমে ডাক পড়ে। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। প্রেসিডেন্ট ও সারওয়ার সাহেব দু’জনই বরিশালের লোক। তাদের জানাশোনা, সম্পর্ক রয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হলো। দু’জনই প্রশ্ন শুরু করলাম। আমি লিখছিলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং আলাপচারিতায় তিন ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নেয়া একান্ত প্রয়োজন।’ আরো বলেন, শিগগিরই তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক আহ্বান করবেন। আলাপচারিতায় প্রেসিডেন্ট বারবার একটি কথা বললেন বেশ জোর দিয়ে, ‘আমি সারাজীবন একজন সক্রিয় মানুষ। আমি কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার কোন কাজ নেই।’ তার আলাপে আন্তরিকতার ছাপ যেমন পাই তেমন একটি চাপা ক্ষোভ, উত্তেজনার গন্ধও পাই। একপর্যায়ে তিনি বলে ওঠেন, ও যধাব ধ ভষধসব রহ সু সরহফ. এ কথা বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন তা আমি তখন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম তার মনের মধ্যে আগুন ছিল। সাক্ষাৎকার শেষে বেবি ট্যাক্সিতে প্রেসক্লাবে সারওয়ার সাহেবকে নামিয়ে আমি সোজা বাসায় চলে যাই। সন্ধ্যার আগেই অফিসে পৌঁছে প্রথমেই সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসায় টেলিফোন করে জানলাম দুপুরে তিনি সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। আগের দিন কথা না হওয়ায় আমি তার বিদেশ যাওয়া সম্পর্কে জানতে পারিনি। কিন্তু এতবড় ঘটনা তাকে জানানো উচিত। তাই আমি জানতে চাইলাম তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়ে পৌঁছেছেন কিনা। বাসা থেকে জবাব এলো পৌঁছাতে বেশ রাত হবে। সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ হলো না। পরদিন ইত্তেফাকে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকার সবিস্তারে ছাপা হলো। এ সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে টেলিফোনে অভিনন্দন পেলাম। অগ্রজ ও অনুজ সাংবাদিকরাও অভিনন্দন জানালো। তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকার ছাপা না হওয়ায় মনে যে চাপা দুঃখ পুঞ্জীভূত ছিল তা প্রশমিত হলো অনেকটা। একদিন পর সম্পাদক সাহেব সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে টেলিফোনে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গটি জানতে চাইলেন। তাকে বিস্তারিত জানালাম। অনেক প্রচেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি তাও বললাম। তিনি যে বাইরে যাচ্ছেন তা আমি জানতাম না, একথাও বললাম।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ইত্তেফাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার। এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠক ডাকবেন। তদনুযায়ী তিনি শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ সব দলকেই আনুষ্ঠানিক বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হরতালের মধ্যে রিকশায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ধানমন্ডি থেকে বিরাট মিছিল নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সত্য বটে, বিরোধীদের কোন দাবিই প্রেসিডেন্টের কাছে গ্রাহ্য হয়নি। বিরোধীদলের মূল দাবি এবং ইত্তেফাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে প্রতিশ্র“তি দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়টি তিনি সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য রেফারেন্স হিসেবেও পাঠাননি। এরই মধ্যেই বিরোধীদলের আহূত অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। অসহযোগের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ১৯ মার্চ জাতীয় সংসদের বৈঠক আহ্বান করেন।

নিনিয়ানের সাক্ষাৎকার

১৯৯৫ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত তখন কনমওয়েলথের তৎকালীন মহাসচিব অ্যামেকা অ্যানিকুর প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গর্ভনর সার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় আসেন। উদ্দেশ্য বিবদমান দুই রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করা। একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। ১৯৯৫ সালে দীর্ঘ ৩৯ দিন তিনি ঢাকায় অবস্থান করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সাথে পৃথক পৃথক আলোচনা করেন। আবার দুই জোটের নেতৃবৃন্দকে এক টেবিলে আলোচনার জন্য বসান। কিন্তু তার এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। নিনিয়ান ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় অবস্থান করতেন। তিনি যতদিন ছিলেন প্রতিদিনই রিপোর্টারদের মেঘনায় যেতে হতো। মেঘনায় বৈঠকের পর বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু নিনিয়ান কোন সাংবাদিকের সঙ্গেই কথা বলতেন না। সরকার ও বিরোধী নেতৃবৃন্দ কখনও পৃথক ভাবে কখনও একসঙ্গে বৈঠক করতেন। বৈঠক শেষে তারা দ্রুত চলে যেতেন। অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কেউ কিছু বলতে নারাজ। এমনও হয়েছে নেতারা ঢুকেছেন মেঘনার গেইট দিয়ে, নিনিয়ানের সঙ্গে আলোচনা শেষে বের হয়ে গেছেন সংলগ্ন পদ্মার গেইট দিয়ে। ফাঁকি দিয়েছেন সাংবাদিকদের। কিন্তু এতে একদিনের জন্যেও মেঘনার গেইটে সাংবাদিকদের ভিড় কমেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর কোনদিন রাত ১২টারও পর একলাইনের বিফ্রিং নিয়ে অফিসে ফিরেছি। গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো আলোচনার সফলতার স্বার্থে। গোপনীয়তা রক্ষা করা নোতাদের কাজ, কিন্তু রিপোর্টারদের দায়িত্বও অগ্রগতি তুলে ধরা। ভিতরের কথা বের করা। যত গোপনই কিছু থাকুক না কেন সত্য খবর কোন রিপোর্টার বের করে প্রকাশ করতে পারলে ক্রেডিট তত বেশি। তাই নিনিয়ান কিংবা নেতারা মুখ না খুললেও রিপোর্টাররা ঠিকই খবর পেয়েছেন। তবে এ-সময় বেশকিছু অনুমাননির্ভর খবরাখবরও প্রকাশিত হয়েছে, যা সত্যের ধারে-কাছেও ছিল না। এতে মাঝে মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।

নিনিয়ানের সহকারী ড. আনাফু সর্বক্ষণ নিনিয়ানের সঙ্গেই থাকতেন। অপর সহকারী ড. ক্রিস্টোফার চাইল্ড খুব জরুরি কিছু থাকলে গেইটে এসে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের একলাইন, দুইলাইনের একটি ব্রিফিং দিতেন। গোলগাল চেহারার চাইল্ড একলাইনের ব্রিফিং দিতে এসে কথা বলতেন নানা বিষয়ে। টেলিফোন করলে তিনিই ধরতেন। রেকর্ডের মতো একই কথা বারবার বলতেন সবাইকে। চাইল্ড এলে আমরা তাকে ‘শিশু, শিশু’ বলে সম্বোধন করতাম। প্রথমে তিনি বুঝেননি, পরে জেনেছেন চাইল্ড এর বাংলা অর্থ ‘শিশু’। এরপর শিশু বললে তিনি খুশিই হতেন। আমার সঙ্গে চাইল্ডের বেশ ভাব ছিল। মাঝে মাঝে দুই-এক কথা অন্যদের চাইতে বেশি পেয়ে যেতাম এ কারণে। চাইল্ডেকে আমি প্রেস ক্লাবে নিমন্ত্রণ করলে তিনি খুব খুশি হয়ে তা গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি আমার বাসায় টেলিফোন করে নিমন্ত্রণের ব্যাপারে কথাও বলেছেন। কিন্তু সংলাপ ব্যর্থতার কারণে তাকে আর খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। চাইল্ড ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বলে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এলে আমার দাওয়াত অবশ্যই গ্রহণ করবেন।

নিনিয়ানে সঙ্গে প্রটোকল ডিউটিতে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এনায়েত মাওলা। দীর্ঘদেহী মাওলার সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না। কিন্তু নিনিয়ান আসার দু’একদিনের মধ্যে পরিচয় হয় ভালভাবে। সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার মাহবুব সাহেব (বর্তমানে এসবি’র ডিআইজি)। তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও এ সময়ে পরিচয় হয়। দু’জন নিনিয়ানের সঙ্গে প্রায় সর্বক্ষণই থাকতেন। প্রতিদিন সংবাদপত্রের রিপোর্ট সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। ইত্তেফাকসহ দু’তিনটি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত সংলাপ, সরকারি ও বিরোধীদলীয় অবস্থানসংক্রান্ত খবর মাওলা প্রতিদিন ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিনিয়ানকে শোনাতেন। প্রথম-প্রথম নিনিয়ান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমি প্রতিদিন তার দৈনিক কার্যসূচির খবর সংগ্রহ করতাম। আর এজন্য সর্বক্ষণ পিছনে লেগে থাকতে হতো। তার সব কর্মসূচি খুব গোপন রাখা হতো। কিন্তু প্রতিদিনই বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে যেতাম। খবর ছাপার পরদিন সহকর্মী রিপোর্টারা যেমন জানতে চাইতো কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছি, একইভাবে, নিনিয়ান, তার সহকর্মীরা এবং প্রটোকল ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদ্বয়ও আশ্চর্য হতেন। একদিন প্রটোকল কর্মকর্তা মাওলা জিজ্ঞেস করলেন, এসব খবর আপনি কীভাবে পেয়ে যান? জবাবে বলেছি খবর সংগ্রহ করাই তো আমার কাজ। আসলে নিষ্ঠাবান হলে কোন কিছু অসম্ভব থাকে না। আর রিপোর্টারদের বেলায় যোগাযোগ এবং ভাল সোর্স থাকাটা খুবই জরুরী। নিনিয়ানের থাকা-খাওয়াসহ সব কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হতো সরকারি পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে তার প্রতিদিনের কর্মসূচিসহ আলাপ-আলোচনার ফলাফল মনিটরিং করা হতো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোন কোন কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সদ্ভাব আগে থেকেই ছিল। তাই তাদের যখনই জিজ্ঞেস করেছি কিছু না কিছু খবর পেয়েছি। আবার এমন কিছু খবরও জেনে যাই যা তারা না ছাপার জন্য অনুরোধ করতেন। রিপোর্টারদের ভাল সোর্স তৈরি হয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে, আমি সোর্সের সাথে কোনদিন বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি। কাজেই আমার প্রয়োজনীয় খবর পেতে অসুবিধা হয়নি তেমন। নিনিয়ান একদিন বুড়িগঙ্গা সেতু, আহসান মঞ্জিল ও জাদুঘর পরিদর্শনে যাবেন বলে আগেই খবর পেলাম। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম নিনিয়ানের সঙ্গে কথা বলার। তাই এ খবর পেয়ে সুযোগের চেষ্টায় রইলাম। বুড়িগঙ্গা সেতু বা আহসান মঞ্জিল না গিয়ে আমি তার কর্মসূচি জেনে জাদুঘরের গেইটে সময়মত দাঁড়ালাম। দুপুর ১২টার দিকে নম্বরবিহীন গাড়িতে করে নিনিয়ান সহকর্মীদের নিয়ে জাদুঘরে আসেন। সোজা উপরে উঠে যান তিনি। আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রটোকল অফিসার মাওলা অবাক হলেন। কীভাবে খবর পেলেন, প্রশ্ন করলেন তিনি। আমার সাফ জবাব, খবর রাখাই তো আমার কাজ। তাকে জানাই আমি নিনিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এ জন্যেই এখানে এসেছি। মাওলা বলেন, এটা সম্ভব নয়। আপনি কথা বলতে গেলে আমাদের সমস্যা হবে। কিন্তু আমার কথা বলতেই হবে, কীভাবে বলবো? মাওলা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি নিনিয়ানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে জানাবেন। তাকে আমার কথা বলবেন। নিনিয়ান রাজি হলে আমাকে বলবেন। আমার আর কিছু বলার ছিল না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আশা ছাড়িনি।

১৯ নভেম্বর ’৯৫ সকাল ৯টা। টেলিফোন বেজে উঠলো। আমি তড়িঘড়ি টেলিফোন ধরলাম। টেলিফোনে মাওলা সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি মেঘনায় চলে আসুন। নিনিয়ানের সঙ্গে আপনার ব্যাপারে কথা হয়েছে। তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। আসতে হবে সাড়ে ৯টার মধ্যে। ৯টায় টেলিফোন, সাড়ে ৯টায় সাক্ষাৎকার। বাসায় স্ত্রী নেই, ছোট ছেলে ঘুমিয়ে। তাকে কার কাছে রেখে যাই। কিন্তু সাক্ষাৎকার মিস করা যাবে না। অনেকদিন চেষ্টার পর সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ হারানো যাবে না। নিনিয়ান ঢাকায় থাকার ৩৯ দিনই পারিবারিক সমস্যায় আমি ভারাক্রান্ত ছিলাম। এতদ্সত্ত্বেও আমি তার পেছনে ছায়ার মতো রিপোর্টের জন্য ঘুরেছি। রাত সাড়ে ১২টায়, ১টায় বাসায় ফিরেছি। শুধু নিনিয়ানের খবর নয়, বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির খবরও একই সময়ে সংগ্রহ করেছি। তা ছাড়াও ছিল সম্মিলিত বিরোধীদলের বৈঠক। বৈঠক শেষে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বর্তমানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ব্রিফিং। এতসব সমস্যার মধ্যে যদি সব খবর সংগ্রহ করতে পারি তাহলে আজ নিনিয়ানের সাক্ষাৎকারের সুযোগ পেয়েও যদি না যাই তবে আফসোসের সীমা থাকবে না। তাই আর দেরি না করে কাজের লোককে ছোট ছেলের বিছানার কাছে দাঁড় করিয়ে ছুটে গেলাম মেঘনায়। কাঁটায়-কাঁটায় সাড়ে ৯টায় পৌঁছে গিয়ে দেখি বৈঠকখানায় নিনিয়ান বসে আছেন সস্ত্রীক, সেখানে চাইল্ডও উপস্থিত। চাইল্ড আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন।

তাকেও বারবার সাক্ষাৎকারের জন্য অনুরোধ করছিলাম। কুশল বিনিময়ের পর চাইল্ড প্রথমে কথা বললেন। তিনি জানালেন, সংলাপ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন নয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। আমি হতাশ হলাম। কিন্তু এসেছি যখন কথা বলতেই হবে। আর এর মধ্যে কিছু বের করাই সাংবাদিকদের দায়িত্ব। এ সময় আরও দু’জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। নিনিয়ান ইলিশ মাছ পছন্দের কথা, রিকশায় উঠে খুশি হওয়া, বাংলাদেশের মানুষ ভাল ইত্যাদি নানা কথা বললেন। কিন্তু আসল কথা কই। এক পর্যায়ে সংলাপের সফলতা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, কালই এ বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন। তাই আজ এ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তবে বললেন, বাংলাদেশের জন্য এখন এক কঠিন সময়। এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদেরই করতে হবে। নিনিয়ানের সাক্ষাৎকার গ্রহণের কথা সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে অবহতি করলে তিনি বললেন, ভালই হয়েছে। জানতে চাইলেন সঙ্গে ফটোগ্রাফার কেউ ছিল কিনা? বললাম, ফটোগ্রাফারের সঙ্গে যোগাযোগের সময় ছিল না। তিনি বললেন, যেভাবেই হোক ছবি সংগ্রহ করে সাক্ষাৎকারের সঙ্গে যেন ছবি ছাপা হয়। পরদিন ইত্তেফাকে বেশ ভাল ভাবেই নিনিয়ানের সস্ত্রীক ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সাক্ষাৎকার ছাপার পর অন্যান্য কাগজের বেশ ক’জন রিপোর্টার কখন আমি এ-কাজ কীভাবে করেছি জানতে চাইলেন। আমার একই জবাব, লেগে ছিলাম। তাই পেয়ে গেছি। সেদিন আরও দু’টি ছোট কাগজে নিনিয়ানের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। তারা আগেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিনিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতি নিয়েছিলেন। আমার এত কিছু করার সময় ছিল না। আমি ছিলাম সুযোগের অপেক্ষায়। নিনিয়ানও জানতেন কোন সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা সবচাইতে বেশি। তাই তিনি বড় সংবাদপত্রকেই সাক্ষাৎকার দিতে আগ্রহী ছিলেন। আর এতে আমার সুযোগের সদ্ব্যবহার হয়েছে।

হরতাল আর সমঝোতার উদ্যোগ এবং শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার

সেপ্টেম্বর ’৯৫। সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সংসদে পদত্যাগকারী বিরোধীদলীয় সদস্যদের শূন্য আসনে উপনির্বাচনের আয়োজন করতে যেয়ে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। তবু মূল দাবি মেনে নেয়নি। এ-সময় বিএনপি’র পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে ৩০ দিন আগে সরকার পদত্যাগ করতে রাজি আছে। কিন্তু এ ৩০ দিনেও প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল থাকবেন বেগম খালেদা জিয়া। তার অধীনেই সরকারি ও বিরোধীদলের ৫ জন করে মন্ত্রী নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো দাবি অগণতান্ত্রিক’, দাবি তারা মেনে নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় সরকারি দল। বিরোধীদল ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতালের ডাক দেয়। এর আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয়বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস রবিন র‌্যাফেল ঢাকা এসে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। গভীর রাতে বৈঠকের খবর আমি সংগ্রহ করি। ইত্তেফাকে পরদিন বিশদভাবে তা ছাপা হয়। রবিন র‌্যাফেল ঢাকা অবস্থানকালেই শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বর্তমান প্রধান বিচারপতি অথবা সাবেক কোন প্রধান বিচারপ্রতির নেতৃত্বে ৩ মাসের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানান। ১৩ সেপ্টেম্বর ’৯৫ সংসদের অধিবেশন সমাপ্তির পর আমি কয়েকজন সাংবাদিকসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য জানার উদ্যোগ নিই। সংসদের যে ফটক দিয়ে খালেদা জিয়া বের হন আগেই তিনতলার লিফটের কাছে আমরা ক’জন গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দূর থেকে তিনি আমাদের দেখেন। সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ এসএসএফ কর্মকর্তারা। আমি আর দু’জন এর মধ্যেই এগিয়ে যাই। এসএসএফ সদস্যরা এগিয়ে আসার আগেই প্রশ্ন করে ফেলি। বেগম জিয়ার পায়ের অসুস্থতা নিয়ে হাঁটছেন কষ্ট করে। তিনি সরাসরি কোন কিছুর জবাব না দিয়ে বললেন, সময়মত সব বলবো। ততক্ষণে এসএসএফ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে ফেলে আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটি করলে তিনি কিছু বলার আগেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সেপ্টেম্বর মাসটা আন্দোলনে আন্দোলনে আর লাগাতার হরতালে কেটে যায়, টানা ৯৬ ঘণ্টা হরতাল পালিত হয়।

অক্টোবরে এসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এস মেরিল আবার উদ্যোগী হন। কথা বলতে থাকেন বিভিন্ন জনের সঙ্গে। তবে ৯ অক্টোবর আকস্মিকভাবে দেশের বিশিষ্ট পাঁচ বুদ্ধিজীবী সমঝোতার অন্বেষণে নেমে পড়েন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ফখরুদ্দিন আহমদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ কামালউদ্দিন হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ এবং ফয়েজ আহমদ টানা ৫ দফা খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার ব্যর্থ প্রয়াস চালান। খালেদা জিয়া বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি বলে দেন ৩০ দিন আগে সরকার পদত্যাগ করলে তিনি প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও বিএনপি’রই একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন। এ ব্যাপারে আপোস নেই। এ-প্রস্তাব নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে এলে তিনি দলীয় নীতিনির্ধারকদের নিয়ে বসে তাদের বলেন, আপনারা আগে জেনে আসুন একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে চান কিনা। বুদ্ধিজীবীরা শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরে জানতে চাইলে তিনি বলে দেন, ‘নিরপেক্ষ বলতে কিছু নেই। পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষ বলতে আমি কিছু বুঝি না।’ ইত্তেফাকে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য ১৭ অক্টোবর ছাপা হয়। আমি বুদ্ধিজীবীদের একজনের সঙ্গে কথা বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিপোর্টটি পেয়ে যাই। রিপোর্ট প্রকাশের পর হৈ-চৈ পড়ে যায়। বিরোধী শিবিরে তুমুল উত্তেজনা। যদি নিরপেক্ষ বলতে প্রধানমন্ত্রী কিছু না বোঝেন তাহলে আলোচনায় কী হবে? তবে আমার এ রিপোর্ট সম্পর্কে কেউ কেউ বলতে থাকেন আমি বাড়িয়ে লিখেছি। কোন কোন সাংবাদিক বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী একই কথা বলেন, সে বক্তব্যের রিপোর্টও আমি করেছি। যেসব সাংবাদিকের মনে সন্দেহ ছিল বেগম জিয়া এমন কথা বলতে পারেন না তাদের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে একদিন বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের বাসভবনে ছিলেন। সে সদস্য উপস্থিত সকল সাংবাদিকদের সামনেই বলেন বেগম জিয়া স্পষ্ট তাদের বলে দিয়েছেন, ‘নিরপেক্ষ বলতে কিছু নেই।’

সমঝোতার উদ্যোগ আর হরতালের পর হরতালের মধ্যেই আমি ১৯ অক্টোবর ’৯৫ বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অ্যাপায়েনমেন্ট পাই। সেদিনও হরতাল ছিল। সকাল ১১টায় সময় নির্ধারণ হয়। আগের দিন বার্তা সম্পাদক সারওয়ার ভাইকে অনুরোধ করি তিনি যেন সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত থাকেন। তিনি রাজি হন। পরদিন যথাসময়ে সারওয়ার ভাই, আমি ও রিপোর্টার রেজানুর রহমান (বর্তমানে আনন্দ আলো সম্পাদক) শেখ হাসিনার ধানমন্ডির বাসভবনে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোতলায় তার স্টাডি রুমে গিয়ে দেখি তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হরতাল সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। ঘরে তৈরি পিঠা দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হয়। এরই মধ্যে আসেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমদ। সাংবাদিক বেবী মওদুদও এ-সময়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ টুকটাক কথার পর সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু করি। আমিই প্রশ্ন করি এবং উত্তর লিখি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিএনপিকে আন্দোলনের মাধ্যমেই হঠাতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হবে।

বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগ তখনও চলছে। বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনার সূত্র ধরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আলোচনার প্রস্তাব করে চিঠি পাঠান শেখ হাসিনার কাছে। ২৮ অক্টোবর রাত ১০টা ২০মিনিটে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এ চিঠি নিয়ে বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে যান। মান্নান ভুঁইয়া চিঠি নিয়ে যাওয়ার খবর মুহূর্তেই সাংবাদিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আমি খবর পাই মান্নান ভুঁইয়া রওনা হওয়ার আগেই। সঙ্গে সঙ্গে আমি অফিস থেকে রওনা হই। সারওয়ার সাহেব নিজের গাড়ি নিয়ে আমাকে তড়িঘড়ি যেতে বললেন। আমি গিয়ে দেখি আজকের কাগজের একজন সাংবাদিক সেখানে হাজির। তিনি আগে থেকেই ছিলেন। দশ মিনিটের মধ্যেই বিভিন্ন কাগজের প্রায় ১৫ জন সাংবাদিক হাজির হন শেখ হাসিনার বাসভবনে। আসলে চিঠি নিয়ে যাওয়ার আগেই সেনসেশনাল নিউজ হিসাবে মেকানিজমের মাধ্যমে খবরটি সাংবাদপত্র অফিসে রটিয়ে দেয়া হয়। সে-সময় সরকারপক্ষ এ খবরটির গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করে। খালেদা জিয়ার চিঠি শেখ হাসিনা পেয়ে পরদিনই জবাব তৈরি করে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নেন। তোফায়েল আহমদকে দায়িত্ব দেয়া হয় শেখ হাসিনার চিঠিটি বেগম খালেদা জিয়ার হাতে পৌঁছে দিতে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানেন যে, প্রধানমন্ত্রী দেশের উত্তরাঞ্চলে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে চিঠি দেয়ার জন্য অ্যাপায়েনমেন্ট না পাওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও শেখ হাসিনার সহাকারী প্রেস সচিব নকিবউদ্দিন মান্নু চিঠিটি মান্নান ভুঁইয়ার বাসায় পৌঁছে দেন। খবর পেয়ে আমি রাত ১০টার দিকে মান্নান ভুঁইয়ার বাসায় পৌঁছি। তিনি তখন উপরে শুয়ে আছেন। নিচে এমপি আমানউল্লাহ আমান ও অন্য এক ছাত্রদল-নেতা অবস্থান করছেন। আমি নিচে থেকে টেলিফোনে উপরে মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি চিঠি পেয়েছেন বলে জানান। অফিসে গিয়ে চিঠির জবাব পেয়ে যাই। আর বেগম জিয়ার প্রথম চিঠিটিও ফ্যাক্সে কে বা কারা আমার নামে পাঠিয়ে দেয়। তবে চিঠিটিতে অসংখ্য বানান ভুল থাকায় সেগুলো গোল চিহ্ন দিয়ে পাঠানো হয়। চিঠিটি আমার নামে দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল। পরের দিন শুনেছি আমার নামের দৃষ্টি আকর্ষণের এ চিঠি বিভিন্ন সংবাদপত্রেও গিয়েছে। শব্দের মারপ্যাঁচ, একজনের চাইতে আরেকজনের বিনয়ী হওয়ার ভাষায় চিঠি চালাচালি চলতে থাকে কয়েকদিন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। চিঠি চালাচালির মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে।

৬ নভেম্বর ’৯৫ সর্বশেষ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, বিএনপি’র কোন নেতা ছাড়া অন্য কাউকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তিনি মেনে নেবেন না। ১১ নভেম্বর ৬ দিনের লাগাতার হরতাল শুরু হয়। একই দিন বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়া আবার বলেন, নিরপেক্ষ কেউ আছেন বলে তিনি মনে করেন না। একই বৈঠকে বেগম জিয়া বুদ্ধিজীবী ফয়েজ আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘বিরোধীদল নমনীয় হতে পারে। তারা মুখ রক্ষার জন্য কিছু চায়।’ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সভায় এ আলোচিত সংবাদ আমি একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহজেই পেয়ে যাই। পরদিন ইত্তেফাকে এ খবর ছাপার পর আবার হৈ-চৈ। বিশেষ করে ফয়েজ আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে ব্যাপক হৈ-চৈ। ফয়েজ আহমদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল। বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগ সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে প্রতিদিনই কম-বেশি খবর পেয়েছি। তিনি যতটুকু খবর দেয়া সম্ভব তা আমাকে দিতেন। তিনি আমাদের অগ্রজ প্রথিতযশা প্রবীণ সাংবাদিক (এখন জীবিত নেই)। তিনিও জানেন কতটুকুতে নিউজ হবে আর আমিও জানি কীভাবে নিউজে তা আনতে হবে। তাই তার সম্পর্কে বৈরীমূলক কিছু লেখা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না। আমি বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেগম জিয়া কর্তৃক তার উদ্ধৃতি দেয়া অংশই লিখেছি। কিন্তু তিনি পরদিন একটি প্রতিবাদ লিপিতে জানান, প্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের কথা তিনি বলেননি। তিনি প্রতিবাদ করলেও বিএনপি’র পক্ষ থেকে কেউ কিছু বলেনি বরং প্রতিবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর আমি আবার দু’জন স্থায়ী কমিটির সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। এভাবেই পাঁচ বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটে। আর সরকারের পক্ষে দু’বার তারিখ নির্ধারণ করেও উপনির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাস ২৪ নভেম্বর ’৯৫ দেশের ৫ম জাতীয় সংসদের বিলোপ ঘোষণা করেন। শুরু হয় নতুন সংকট। খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে শুরু করেন ট্রেন মার্চ। এদিকে নভেম্বর মাসের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে সকল দলের পূর্ণ অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে মতবিরোধ নিরসনের বক্তব্য দেয়া হয়। সক্রিয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতগণ।

বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত অব্যাহত প্রয়াস চালাতে থাকেন। ডেভিড মেরিল সরকারি ও বিরোধী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা বলতে থাকেন। পরে ইতালি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারগণ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দফায়-দফায় সাক্ষাৎ করে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের আবেদন জানান। তাদের সঙ্গে সংকট নিরসনের সম্ভাব্য উপায় নিয়েও আলোচনা হয়। এরই মধ্যে বিএনপি একদলীয়ভাবে নির্বাচন করে ফেলে ১৫ ফেব্র“য়ারি ’৯৬। নজিরবিহীন এ নির্বাচন। ভোটার ছিল না, কিন্তু বাক্স ভোটে ভর্তি হলো। বিএনপি, কর্মীদের প্রকাশ্যে ব্যালট পেপার সীল মারার খবর ও ছবি জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। ভোটের দিন বিরোধীদলের ‘গণকার্ফু’ ছিল। রাস্তাঘাটে মানুষ ছিল না। তবুও নির্বাচন হয়ে যায়। আর্মি, বিডিআর ও পুলিশের প্রহরায় অনুষ্ঠিত একদলীয় নির্বাচন সংকটকে যেমন বাড়িয়ে তোলে তেমনি সমাধানের পথও খুলে দেয়। কেননা যে বিএনপি কোনদিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে রাজি ছিল না, নিরপেক্ষ বলতে কিছু নেই বললেও তারা নিজেরাই একতরফাভাবে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে। এ বিলে নিরপেক্ষ সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে বিএনপি’র ক্ষমতার অবসান ঘটলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। সে নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। বেগম খালেদা জিয়া হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

আরএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত