আড়াল ও স্মৃতির আলপিন
মোস্তফা কামাল পাশা
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২১, ২০:০১
চুপচাপ এবং আড়ালে থাকার মাঝে চমৎকার সব মজা ও সুখবর থাকে! নিজে চুপচাপ বা আড়ালের না, কীভাবে এবং কখন নিজের রূপান্তরটা ঘটেছে তাও বুঝতে পারিনি! অথচ সক্রিয় রাজনীতি এবং দৈনিক আজাদীতে অতি ছটপটে (ঠিক না সম্ভবত, অস্থিরই হবে) ছিলাম। শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যার অনিয়ম, অস্থিরতায় অতিষ্ঠ ছিলেন। তিনিতো ধীর-স্থির, সৌম্য, মিতভাষী মানুষ। পত্রিকার সব বিভাগে আমার দৌড়ঝাপ পছন্দ করতেন না। রাজনীতিতে বেশি মনোযোগতো একেবারেই না। কিন্তু তখন সময়টা ছিল বড্ড বৈরি। এরশাদের হুকুমে মিডিয়া চলে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পিআইডি'র টেলিফোন নির্দেশিকা নামের কুইনাইন নাজেল হয়। তেতো গিলেই পত্রিকার খবর ছাপাতে হয়। রাজনৈতিক তৎপরতাও গৃহবন্দী।
বিএসএস বা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা'র সরবরাহ করা খবরে এরশাদ, রওশন এরশাদ, ভাড়া নেয়া রাজকুমার শাদ এবং চামচাদের কীর্তিগাথাই থাকে ৯০% বাকি দশভাগ বিদেশি খবর! এসব জঞ্জালতো পত্রিকা পাঠকদের পেটে মোটেই হজম হয় না! আশ্চর্য, এসব এখন অনেকের কাছে ফিকশন! নাহলে মিডিয়ার গলা টিপে ধরা হয়েছে, অর্বাচীন মন্তব্য করে কীভাবে?
সংবাদকর্মী এবং মিডিয়া সংশ্লিষ্টরা ভালোই জানেন, এভাব পত্রিকা বা মিডিয়া বাঁচে না। পত্রিকা না বাঁচলে আমরাইবা কীভাবে বাঁচি! তো বিকল্পতো খুঁজতেই হয়। এই বিকল্পের সহজ অস্ত্র হিসাবে অসম্ভব ধীশক্তি ও সততার রোলমডেল বার্তা সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন সাধন কুমার ধর বেছে নেন অস্থিরচিত্ত এই বেপরোয়াকে। তো, শুরু হয় ডেস্কের সংবাদ সাজানোর রুটিন কাজের পাশাপাশি হরেক স্বাদের বিকল্প ডিশ পরিবেশনার বাড়তি দায়। আর পায় কে! রম্য রস, ঘুর পথের বিকল্প খবর, অনাহরিত মানবিক খবর, ছবি, ফিচার, রাজনীতির রসালো সালসা সব পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে যথেচ্ছ। খেলাধুলোর খবরে নানা মাত্রা আনেন, সহকর্মী ওসমানুল হক, নিজাম উদ্দিন পরে যুক্ত হয় দিবাকর ঘোষ। আবার ৯৪ এর হ্যাট্টিক বিশ্বকাপ জয়ের পরদিনই ব্রাজিল সুন্দরীকে চট্টগ্রামে বন্দর জাহাজ থেকে তুলে এনে মডেল বানিয়ে সব মিডিয়াকে টপকে যায় আজাদী। এর অনুসন্ধানী-প্রতিবেদকও আমি নিজে।
তো, এভাবে ৮৩ সাল থেকে টানা চলতেই থাকে। প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায়ও আমার বিশেষ ও রসালো এবং নানা আজব মাত্রার আইটেমগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করতেন সাধন স্যার। সম্পাদক সাহেবের জানে-জিগার দোস্ত তিনি। তাই সর্বত্র আমার অনাহুত ও জোরালো অনুপ্রবেশ বিধি বহির্ভূত হলেও মেনে নিতেন। অবাধ স্বাধীনতা সবসময় ভালো না। অফিস সূচি মানার কথা মনেই থাকতো না। যখন খুশি আসতাম, টর্নেডো গতিতে কাজ সেরে চলে যেতাম। লাই দিতেন সাধন স্যার। ফলাফল বুঝতে যথেষ্ট দেরি হয়। দায়, অপরিণত ব্রেনের। যখন বুঝি, তখন সঙ্গে সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা দিই, ৯৭ সালের মে মাসে। এতে সবচে' বেশি কষ্ট পান সাধন স্যার ও সহকর্মী তফজ্জল ভাই। তফজ্জল ভাই সম্পাদক (বর্তমান) শ্রদ্ধেয় এম এ মালেক সাহেবেরও বন্ধু। সাধন স্যার পদত্যাগের অন্তবর্তি একমাসের ছুটির সময় রাইফেল ক্লাবে ডেকে নিয়ে আমাকে অনেক করে বুঝান। এটা ওনার নিয়মবিরুদ্ধ কাজ, তবুও একজন আর্বাচিনকে ভালোবেসে কাদায় নামেন। না বলিনি, হ্যাঁও না। চলে আসি। জানি, এই কষ্ট তিনি কখনো মুছতে পারেননি।
সব চুকেবুকে গেলে এমনকি আমার নতুন ভেঞ্চার দ্রুত ডোবার পর তফজ্জল ভাই একদিন বাসায় নিয়ে যান। ভাবিও খুব পছন্দ করতেন। চমৎকার মহিলা তিনি। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে নতুন করে আজাদীতে যোগ দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। দায়িত্ব নেন, সব ব্যবস্থা তিনি করবেন। তখন সত্যি সত্যি আমি কপর্দকহীন, পথহীন পথিক। না বলিনি আবার সাড়াও দেইনি।
এখন মাইনাস জনসংখ্যার যুগ। অর্থাৎ এক সন্তান নীতি। অথচ আমার তখন ছোট ছোট চার সন্তানের ভরাট সংসার। থাকি ভাড়া বাসায়। কোথাও চাকরি নেব না মনে মনে পণ করি। সাধন স্যারের শিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবহারের শপথ নেই। পেরেছি, নিশ্চিতই। নিজের পথচলা কত কঠিন ও অসহনীয় ছিল, সময়ে বলবো। তো, মাইনাস নিয়ে একটু বলি। সুহ্নদদের ভালোবাসা বা অবজ্ঞায় আমার সব সন্তান সর্বোচ্চ শিক্ষিত এবং চলমান রেওয়াজ অনুযায়ী পদ-পদবী, আর্থিক স্বচ্ছলতায় ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। ঘরে তিন ছেলে-মেয়েও মাইনাস নীতির। তিন রাজপুত্র নাতি নিয়ে তাদের সোনার সংসার। ছোট ছেলে এখনো সংসার পাতেনি। তাই, মন্তব্যও নাই। আলাদা চার ফ্ল্যাটে বসবাস হলেও শিকড়ের টান পোক্তই আছে সবার।
আবারও জংশন ধরে চলছে ট্রেন। কী করবো, মৃত্যুর গুহা থেকে ফিরে আসার লেজুড় সহজে কাটবেই না। হ্যাঁ, চুপচাপ থাকার মজা, সত্যিই আলাদা। "আমি হেন, তেন, মহামহিম, বিশ্বজয়ী, এইছা জয়ী, ওইছা জয়ীও"! এখন সবাই-ই মহামহিম। বানানোর তবলচিও প্রচুর। যদি শক্ত কোনো ঠিকানায় লেঙুর বন্ধক থাকে, সেবা দেয়ার সুযোগ থাকে! দুঃখ, ইনাদের যদি ভুলে পাছায় হাত যায়, শুকনো 'ইয়ে'তে ঠোক্কর লাগবেই। তো চুপ বা আড়ালে থাকার মজা বুঝবেন কী করে! এই দু'কাজে চাই, ভয়ঙ্কর রোখ এবং দুর্দান্ত লড়াই দেয়ার সাহস- যোগ্যতা। অথবা হতে হবে, দেশসেরা মাফিয়া ডন। আমি কি বা কে, কারো আগ্রহ থাকার কথা না। তবুও থাকলে নিজেরাই ধারণা করে নিন, প্লিজ। আবার কথা হবে এই প্রসঙ্গে। গেল রাতের ঘুমটা এক কথায় সুপার-ডুপার, খাসা কষ্ট-আলোচিত চরিত্রগুলোর মাঝে সম্পাদক এম এ মালেকসহ নিজাম আর দিবাকর এখনো আজাদীতে আছেন। বাকি সবাই জীবিতের অগম্য ভুবনের অতিথি!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট