ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

জেসিন্ডা: পিনখোলা গ্রেনেড ও জজবাধারী

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২১, ১৭:৫৩

জেসিন্ডা: পিনখোলা গ্রেনেড ও জজবাধারী
জেসিন্ডা ও তার বন্ধু। সংগৃহীত ছবি

দেশের রাজনীতি এখন পুরোটাই সরকারি দলের কব্জায়। বিরোধী দল তথা বিএনপি গুরুতর অসুস্থ! অসুস্থ দলটির অনেক নেতাও। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াসহ অনেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। ব্যস্ততায় শুধু দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল। হেফাজতের কাঁধে বন্দুক রেখে উগ্র ধর্মান্ধ, নুরুসহ বিশেষ চক্রের তলে তলে ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাস মামুনুলসহ হুজুরদের টাকা ও রিপুকান্ডে ডাহা ফ্লপ মেরেছে। এতে দেশের পুরো রাজনৈতিক চালচিত্র তালগোল পাকিয়ে গেছে। টিভি চ্যানেল, প্রেসক্লাব, শাহবাগ মোড়, পল্টন অফিস আর জিয়ার মাজারে ঘুরপাক খায় বিএনপি জোট, নুরু, খুরুর রাজনীতি। ফাঁকা ময়দান সরকারি দলের একক কব্জায়। কিন্তু ওখানেও হাইব্রিড বা অতিথি পাখি আর ত্যাগী, পোড়খাওয়াদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চুলছেড়া হিসাব-নিকেশ চলে। ভয়াল করোনাঘাতে আরও বেশি। গোষ্ঠী স্বার্থের দ্বন্দ্বতো আছেই। উপায়ইবা কী! প্রতিপক্ষ নেই বলে কী দলীয় মহড়া বা অনুশীলন কী বন্ধ রাখা যায়!

অপ্রিয় সত্য, আওয়ামী লীগের মেরুদণ্ড হচ্ছে, অসংখ্য ত্যাগী নেতা-কর্মী। এরা বেশিরভাগই ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। অতিথি পাখিরা সব চেঁটেপুটে খায়। ত্যাগীরা কনুইর গুতো খায় আড়ালে। এদের আত্মসম্মানবোধ যেমন তীব্র, তেমনি বুকভরা অভিমানও! দলের সুদিনে স্রেফ সংখ্যা, কিন্তু দুর্দিনে পিনখোলা গ্রেনেড! এরাই কিন্তু আওয়ামী লীগের মহাশক্তিধর রিজার্ভ ফোর্স। এদের টানা অবমূল্যায়ন আগামিতে সরকারি দলকে ভোগাতেও পারে। কারণ, টানা ক্ষমতার অবসাদ স্বস্তিকর নয়। আশা করি, শীর্ষ নেত্রী বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নেবেন।

চলুন এই ফাঁকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মহান লগ্নে হেফাজতি ম্যাসাকার স্বরণে একটু বিদেশ ঘুরে আসি। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ্যডার্ণের বিয়ে হবে শিগগিরই। তিনি খ্রিস্টান না, কোনো ধর্মেরই অনুসারী না। তার ধর্ম, মানব ধর্ম। পৃথিবীর সব ধর্মের মূল নির্যাস। একদম খোলামেলা জীবনচর্চা করেন। পছন্দের বন্ধুর সাথে লিভ টুগেদার করছেন ২০১২ সাল থেকে। একটি বাচ্চাও আছে। বাচ্চা নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনসহ রাষ্ট্রীয় সফরও সারেন। কেউ প্রশ্ন করেনি, বিয়ের আগে তুমি শিশু জন্ম দিলা কীভাবে? ভোটারেরাও তাকে অবৈধ সন্তানের (?) মা জেনেও বাক্সভরে দু'দফা ভোট দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন! জেসিন্ডা শুধু এগ্নিষ্ট না, তিনি লেসবিয়ান অধিকারের প্রবক্তাও! দেখেন, গুণের কত্তো বহর! আমাদের মতো কোনো মুসলিম দেশে হলে জেসিন্ডার কী হতো? চাবুকপেটায় ছাল-বাকল হারিয়ে ডালকুত্তার মজাদার ডিশ হতেন। অথবা অর্ধেক মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে খুনের ফতোয়া জারি হতো। তার বাপ-মা, সাত গোষ্ঠীকে এলাকাছাড়া করে হুজুর মাতব্বর, ক্ষমতাধররা দখল নিত ভিটেবাড়ি।

নিউজিল্যান্ডকে আল্লাহ পাক বেছে নেন, অফুরান প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রের নন্দনকানন গড়ার কাজে। যারা অকল্যান্ড, ক্রাইস্টচার্চ বা দেশটির যেকোন অংশের রূপ দেখেছেন, তারা হয়তো বলবেন স্বর্গের একটা অংশ ভুলে পৃথিবীতে নেমে এসেছে! মিথ্যা, শঠতা, ভণ্ডামি, ভাওতা, ওয়াদা খেলাপের মতো কোনো শব্দ দেশটির মানুষ চেনে না। শান্তি-সমৃদ্ধির রেকর্ডেও নেই কোনো দাগ। ক'বছর আগে ক্রাইস্টচার্চের দুটো মসজিদে জুমার জামাতে এক উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীর হামলায় ৫০ মুছল্লি খুনের দুঃসহ অপঘাতের পর প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা সবার আগে রাস্তায় নামেন। দেশটির মুসলিম কমিউনিটির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শোক ভাগাভাগি করে নেন। কলেমা পড়েন, সালাম দেন, কোরআনের সূরা পড়েন। টিভিতে আযান প্রচার হয়েছে। হামলার পরবর্তী শুক্রবারে হিজাব-নিকাব পরে অসংখ্য স্বদেশি মেয়ে ও নাগরিকের সাথে প্রতীকী জুমা আদায় করেছেন। শুধুমাত্র মুসলিম কমিউনিটির ভয় দূর করে, শোক-তাপ-ক্ষোভ মুছে দিতে এত ক্লেশ ও সাহসের পরিচয় দেন। সপ্তাহভর শোক পালনে তিনি দুপুরের লাঞ্চও বর্জন করেন। দেশটির অস্ত্র আইন সংশোধন করে স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন। এর আগে মাত্র ৩৮ বছরের জিরো ফিগার গালভাঙা জেসিন্ডাকে কেউ চিনতোও না। সেলিব্রিটি বা বিখ্যাত হওয়ার স্বাদ আহ্লাদও তার নেই। এমনকি নিজ দেশেও তারকা চরিত্র নন।

ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর টানা একমাস বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম দখলে রাখেন। মুসলিম বিশ্বে রাতারাতি সবচে উজ্জ্বল জীবন্ত আইকন হয়ে ওঠেন। তাছাড়া জাতিসংঘে ইসরায়েলের খুনী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে অবৈধ ইহুদি দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেন। যা সৌদি বা কোনো প্রভাবশালী মুসলিম দেশ করেনি, সাহসও পায়নি! ফলাফল, তাকে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম কবুল করার আহ্বান জানায় মুসলিম আহম্মক তরুণরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি মুসলিম ধর্ম কবুল করেছেন বলে ভুয়া অপপ্রচারণার ঝড় তোলা হয়। বুঝুন, এই মুসলিম জিহাদীরা কেডায়! জেসিন্ডা একজন লেসবিয়ান অধিকার নেত্রী, তিনি ৯ বছর ধরে লিভ টুগেদার করছেন প্রকাশ্যে! বিবাহ বহির্ভূত শিশুর জননী! ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আরো অনেক অনৈসলামিক কাজের সাথে যুক্ত। সব লেখাও যায় না। তাহলে? যাকে প্রকাশ্যে দোররা মারা বা মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে খুন করার কথা! তাকে ইসলাম কবুল করানোর এত বিশাল আয়োজন! আবার এখানে ফেবুতে ইসলামী জজবাধারীর এমন স্ট্যাটাসও দেখা গেছে, "জেসিন্ডা, তুমি ইসলাম কবুল করলে তোমাকে আমি নৈশভোজ খাওয়াব!" আব্দারখানা দেখুন! জেসিন্ডা যেন জোশধারীর দাওয়াতের টানে ভিসার লাইনে দাঁড়িয়ে যাবেন!

কী বুঝলেন! একজন অসাধারণ মানবিক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডার জন্য আমাদের জোশওয়ালাদের কেন এতো মহব্বত! কেন আজব টান! ব্যক্তিগত জীবনে জেসিন্ডা কে এবং কেমন, মিলিয়ে নিন একটু। এবার বলুন, আমরা মুসলিমরা কী পৃথিবীর সবচে' বড় আহাম্মক নই? সত্য, নৈতিকতা, বোধ- জ্ঞান- মানবিকতাহীন কোন মানুষ কী কখনো ধার্মিক হতে পারে? সম্ভবত আমাদের খোলের মগজে বিলবোর্ড হয়ে হামেশা জ্বলজ্বল করছে, ক্রিস্টাল স্বচ্ছ ৭২ হুরির খুশবুদার দেহবল্লরীর টেকবাঁক! আমাদের বোধ- মনন- মানবিকতা সব হুরি এবং বেহেশতের প্রতি নিবেদিত-মানুষের জন্য নয়! ধর্মান্ধতার অমানিশা পেরিয়ে কবে আমরা মানবিকতার আলোর কাফেলায় সামিল হবো? আদৌ তা কী সম্ভব! না, ফে বুর অসংখ্য জেহাদী পেজ, বিদেশে লুকানো নব্য জেহাদিদের হাওয়াই হুঙ্কার, হুজুর-খেজুরের জঘন্য মিথ্যা কাহিনি বানিয়ে নর্তন কুর্দন এবং নতুন করে হেফাজতি ম্যাসাকার তার জ্বলজ্বল সাক্ষী। ভয়ঙ্কর করোনা বা রোযা রমজানেও তাদের ন্যূনতম সংযম নেই।

সর্বশেষ: জেসিন্ডার আরেকটি দরকারি তথ্য দিয়ে শেষ করছি। জেসিন্ডা প্রচণ্ড আত্মাভিমানী! পার্টনার বা বন্ধু তাকে বিয়ের জন্য নিজে থেকে 'প্রপোজ' না করায় তিনিও চুপ মেরে আছেন এতো বছর। এখন বরফ ভেঙেছে-প্রপোজ করেছেন বন্ধু! এ্যন্গেজমেন্ট রিঙ পরা হয়ে গেছে। ব্যস্ততা কেটেছে। কদিন পর আনুষ্ঠানিক বিয়ে। জজবাধারী দাওয়াত দাতারা যেতে চাইলে ভিসার আবেদন করে রাখুন! অবশ্য করোনায় ফ্লাইট বন্ধ থাকায় বড় সমস্যাও বটে! অবশ্য জজবার ফু'এ চালু হতেওতো পারে!

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কবি

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত