ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

উপকূলীয় জীবনের পক্ষসমর্থনে টেকসই বেড়িবাঁধ অপরিহার্য

  সাইফুল ইসলাম সায়েম

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২১, ১৮:৫২

উপকূলীয় জীবনের পক্ষসমর্থনে টেকসই বেড়িবাঁধ অপরিহার্য

দেখতে দেখতে মাস অতিবাহিত হলো ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের। গতমাসের এ সময়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, যার প্রভাব আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবর্তী মানুষ। আজও তারা আঁতকে ওঠে সেই ভয়াল দৃশ্যর কথা মনে পড়লে।

পানিবন্দি মানুষ, মাথার উপরে খোলা আকাশ, পায়ের নিচে হাঁটু সমান নোনা জল- এ অভিজ্ঞতা কি ভোলা যায়! অবহেলিত উপকূলীয় মানুষদের গৃহপালিত পশু নিয়ে একই ঘরে পরিবারসহ বসবাস করতেও দেখা গিয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পরবর্তী সময়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল দেশের দক্ষিণাঅঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপকূলীয় উপজেলার মানুষের সঙ্গে। দেখেছি তাদের বুকফাটা কান্না। তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, উপকূলবাসী ঝড়কে ভয় পায় না, ভয় পায় নাজুক বেড়িবাঁধকে। ঝড়ের থেকেও বেশি ক্ষতি হয়, যখন ভেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ের চারদিক পানিতে প্লাবিত হয়। তাই উপকূলীয় অঞ্চলের প্রত্যেক মানুষ চেয়েছে, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হোক।

উপকূলীয় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো যখন রাস্তায় নামে এই বেড়িবাঁধের জন্য, তখন তাদের কষ্টের কথাগুলো শুনে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু যাদের হৃদয় ছোঁয়ার কথা, তাদের ছোঁয় না। তারা সময় এলে প্রতিশ্রুতি দেন বাঁধ হবে, খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল এখনো খুঁজে পায়নি উপকূলীয় মানুষগুলো।

দেশের দক্ষিণাঅঞ্চলের শেষ উপজেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী। এর চারদিক নদ-নদীবেষ্টিত। শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের অকেজো বেড়িবাঁধ এই জনপদকে ঘিরে রেখেছে। বর্ষা মৌসুমে আবহাওয়া বিরূপ হলে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে অকেজো বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে এই অঞ্চলের লোকালয়ে। ফলে এই উপকূলীয় জনপদের বেশকিছু জায়গা রূপ নেয় স্থায়ী জলাবদ্ধতায়।

শুধু তাই নয়, মাঝে মধ্যে গ্রীষ্ম মৌসুমেও বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে যায় টেকসই বেড়িবাঁধাহীন এই নদীবেষ্টিত লোকালয়ে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষতি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখানকার বসবাসরত শতাধিক পরিবার। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমা তিথির জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদীবেষ্টিত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই উপজেলাটির ২৫টি গ্রাম।

প্রশাসনের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে উপজেলাটির বিভিন্ন এলাকায় ৫ হাজার ৫১০ মিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে, অতীতে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্পান, ফনি ও বুলবুলের তান্ডবে চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা, চরলতা, চিনাবুনিয়া ও চরমোন্তাজের চরআন্ডাসহ কয়কটি এলাকার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে ক্ষতির পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলছে।

ক্ষতিগ্রস্ত এই নিম্নাঞ্চলের মানুষের দাবি, দূর্যোগ থেকে রেহাই দিতে স্থায়ীভাবে টেকসই এবং উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রয়োজন। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হতে পারে যে কোনো সময়ে। একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এখানকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে কৃষি ও মৎস্য চাষ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে উপজেলাটিতে মৎস্যখাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা এবং কৃষিখাতে সীমাহীন ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

কিছুদিন আগে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে জনগণের রোষানলে পড়েছিলেন সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা। সেখানে তিনি উপকূলীয় মানুষের আর্তনাদ শুনে অভিনব উপায়ে জাতীয় সংসদে ‘আর কোন দাবি নাই, ত্রাণ চাই না; বাঁধ চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড গলায় ঝুলিয়ে নিজ এলাকার মানুষের দাবির কথা তুলে ধরেছেন। জাতীয় সংসদে তার এ দাবির মধ্যদিয়ে উপকূলের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলিত হয়েছে। উপকূলবাসীও দীর্ঘদিন ধরে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষের সাধারণ একটি চাওয়া পূরণ করা যাচ্ছে না কেনো? উপকূলীয় এলাকায় যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি, তা নয়। বহু এলাকায়ই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, আবার তা ভেঙে যাওয়ার পর সংস্কারও করা হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে এগুলো টেকসই না হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়র তো বটেই, অনেক সময় জলোচ্ছ্বাসই প্রতিরোধ করতে পারে না।

অভিযোগ আছে, এক শ্রেণীর অসাধু ঠিকাদারদের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সংযোগ রয়েছে, তারাই বারবার এসব বাঁধ নির্মাণের কাজ পায় বিভিন্ন মাধ্যমে। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাঁধ টেকসই হয় না। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের এ চক্রটি ভাঙতে হবে। বাঁধ নির্মাণে অতীতে যারা অনিয়ম করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের লাইসেন্স বাতিল বাধ্যতামূলক করা হোক।

টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব জমি না থাকলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরি তহবিল গঠন, বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা এবং বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তাহলেই উপকূলীয় জনপদের মানুষ দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে পারবে।

শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

  • সর্বশেষ
  • পঠিত