ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

প্রকৃতি: তিমির হন্তা আলোক রশ্মিমালা

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২১, ১৭:৫৩

প্রকৃতি: তিমির হন্তা আলোক রশ্মিমালা

বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি শুধু নন- তিনি ‘একমে অদ্বিতীয়ম’ও বটে। বাংলা কবিতায় প্রিয় বাংলার নিসর্গ, রূপ ও রূপকল্প দু’টোই প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলা মায়ের এত রূপ, ঐশ্বর্য হৃদয়ের আকুলতায় ছেঁকে আনার দায় আর কোনো কবি এমনকি কবিগুরুও হয়তো নেননি। নিয়েছেন বনলতা সেনের কবি জীবনানন্দ দাশ।

ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করা বাংলার আত্মমগ্ন কবিকে জীবনকালে কত না ক্লেশ-যন্ত্রণা সইতে হয়েছে! কেউ তার খবর রাখেনি! মৃত্যুটাও কতো নিষ্ঠুর বাংলার রূপ-বিভায় মোহিত এই কবির! ট্রামের চাকার নিচে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে তাকে! কেন, এর উত্তর জীবনানন্দপ্রেমী ও গবেষক সবার জানা। এক গবেষক তার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিমির হন্তা আলোক রশ্মিমালা’!

কী আশ্চর্য, তিনিতো দেশ ছাড়া পৃথিবীর কিছুই দেখেননি। তার ফতুয়ার পকেট বা ব্যাঙ্কে কোনো টাকাই ছিল না, ছিল না কোনো কর্পোরেট প্রমোটরও! চিনতই না কেউ! বাংলাই ছিল তার সবকিছু। স্বর্ণসন্ধানী হয়ে কবিতায় বাংলার রূপের স্বর্ণমুকুট সাজিয়েছেন সোনার হরফে! আসলে পৃথিবীর সব রূপ আমার প্রিয় বাংলার জল-মাটিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে! জল-জংলা-ঝিরিতে, খেতে-বিলে, খাল-নদীতে, পুকুর-দিঘিতে, পাহাড়-অরণ্যে, নৃ-জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতিতে, হ্রদ-সাগরে, আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব রূপ। আমরাতো অন্ধ, দেখিই না। দূর্বাডগার শিশিরবিন্দু বা লজ্জাবতী লতার গোলাপি ফুল, রক্তলাল একফোঁটা ঘাসফুল! ছোট্ট প্রজাপতির নাচানাচি, সবুজ ঘাস ফড়িংয়ের দূরন্ত লাফ- ডানা ছড়ানো আকাশচারী উদাস শঙ্খচিল কিছুই না।

লুটেরার টাকা বা প্রমোটর আছে। ঘন ঘন উড়াল দেয় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কাছের ভারত বা নেপালে। আরো বড়রা সুইজারল্যান্ড, ইউরোপ, নিউজিল্যান্ড, ইউএসএ-তে। করোনার থাবায় এখন কিছুটা বিরতিকাল চললেও পরে হুড়মুড় করে খুলে যাবে। এ তুলনায় জীবনানন্দ দাশ কতোনা অসহায়! পৃথিবীর কোনো দেশ, শহর, নগর লোকালয়, ট্যুরিস্ট রিসোর্ট, লাক্সারি ইয়ট, সাগরতলের কাঁচঘেরা রেস্তোরাঁ, সোনার পাতমোড়া পাঁচতারা হোটেল, ইকো বা থিমপার্ক কিছুই দেখেননি। কখনো বিমানে চড়েননি, ডেজার্ট সাফারি কী জানেন না! আহারে বেচারা। অথচ তার কবিতার উম ছাড়া প্রেম জমে ক্ষীর হয় না! জীবনানন্দ ছাড়া কবিতা আসরের রসালো ডিশ জমেই না!

সকাল এগারটায় শ্রাবণ আকাশে মেঘ-রোদের খেলা দেখে ‘বেচারা কবি’কে বড় বেশি বেশি মনে পড়ছে! আমি যেন তার নিঃশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছি। তার কবিতার সুবাসে ভরে যাচ্ছে নিজের বুক। আকাশে উড়ন্ত মেঘ দঙ্গলে ‘বনলতা’র পিঠছড়ানো রেশমি চুলের সুবাস পাচ্ছি! সাথে বুকভরা অক্সিজেন। আহা কতো টাটকা তরতাজা অক্সিজেন! অথচ এই মুহূর্তে অক্সিজেনের অভাবে অসহ্য শ্বাসকষ্টে নাভিশ্বাস উঠেছে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের! হাঁফ তোলার মতও বল পাচ্ছেন না অসংখ্য ধনী ও স্বচ্ছল মানুষ-আপনজনও!

কোভিড-১৯ এর নিষ্ঠুর ছোবল দেশের বড় বড় কর্পোরেট উদ্যোক্তাদেরও ছাড় দিচ্ছে না। অনেকে চলে যাচ্ছেন বড়ই করুণভাবে। করোনা কব্জা করার দু’দিন আগেও এদের কেউ কেউ ছিলেন টগবগে কর্মপাগল শীর্ষ কর্পোরেট নির্বাহী। শ্বাসকষ্টে একটু স্বস্তি পেতে কারো কারো জন্য বেশ ক’টি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর, চীন থেকে উড়িয়ে আনা হয় সবচে’ নামী বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি তারা। অক্সিজেন স্যাচুরেশান বাড়াতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে শ্বাসকষ্ট কমানোর দামে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের সব সম্পদ কেউ কেউ বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিছুতেই কিছু হয়নি। অসহ্য কষ্টের পর্বত বুকে চেপে চলে গেছেন। আত্মীয় পরিজন কাছে ছিলেন না! এত সম্পদ, বিত্ত কিছুই এদের অক্সিজেন স্যাচুরেশান উপরে তুলতে পারেনি।

আমরা হয়তো বুঝছি না, অর্থ-বিত্ত নামের দৈত্যের চুম্বক টানে পা পা করে নিজেদের ধংসের দরজায় টেনে নিয়ে যাচ্ছি! প্রকৃতি, বনভূমি, পাহাড়, নদী, ঝিল, বিল, জলাশয় লোভের টানে দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছেই! প্রাকৃতিক অক্সিজেন সরবরাহ ডিপো ধ্বংস করে চট্টগ্রাম নগর কেন্দ্র সিআরবি ঘিরে আলিশান বিলাসবহুল প্রাইভেট হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ গড়ার জেদ ধরে বসে আছি। করোনার ভয়াল ছোবলও প্রাকৃতিক অক্সিজেনের মূল্য বোঝার মতো বোধের তালা খোলেনি, কত বড় নির্বোধ আমরা!

আসুন না, একটু মানবিক হই। প্রকৃতিকে খানিক সময় দেই। চোখ মেলে বাড়ির চারপাশটা অন্তত একবার দেখে নেই। কে জানে, হয়তো লোভ দানোর আছর ও বিপুল ভোগের ভয়াল আত্মাহুতির মোহ টুটে যেতেও পারে। প্রিয় দেশটাকে নতুন করে ভালোও বাসতে পারি-আরেকবার, গভীর মমতার উমে!

দূর্বাঘাস ডগার শিশিরবিন্দুর ঝলমলে মুক্তো, ঘাস ফড়িংয়ের লাফ, ছোট্ট রক্তবিন্দু ঘাসফুল আমাদের জীবনান্দের মতো না হোক, নিজের মতো করে প্রকৃতিকে ভালবাসতে শেখাবে নিশ্চয়ই।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত