ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩০ মিনিট আগে
শিরোনাম

শোকের মাস ও ভিআইপি সংস্কৃতি

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩৬

শোকের মাস ও ভিআইপি সংস্কৃতি

দু'বন্ধুর সংলাপ!

'চ্যাটাং' চড়ের শব্দ! ধুশ শা-কামড়! মশা!'

'এডিস নাকি? হায় হায় এক্ষুনি ব্লাড টেষ্ট করতে হবে'!

-'আরে ধূর থামতো, এটাতো উইপোকা দেখছি!'

-'আস্ত খবিসতো, খামাকা ভয় পাইয়ে দিলি!'

-'ভয়াল করোনার সাথে শক্তি সংহত করছে ডেঙ্গু, ভয়ের কথাইতো!'

হ্যাঁ জনাব, একটু মস্করা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে সংক্রমিত!

জাতীয় শোকের মাস আগস্ট। বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দেয়া সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুধু নয়। আরো কয়েকটি দুনিয়া কাঁপানো খুন ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে এ মাসে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ'র সমাবেশে গ্রেনেড বৃষ্টি, ২০০৫ এর ১৭ আগস্টে দেশব্যাপী ৬৪ জেলায় একযোগে তথাকথিত বাংলাভাই ও শায়খ রহমান নেতৃত্বাধীন জেএমবি জঙ্গিগোষ্ঠীর বোমা হামলার স্বাক্ষীও আগস্ট মাস।

৭৫ এর ১৫ আগস্ট সর্বকালের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সদ্যস্বাধীন পুরো জাতিকে অন্ধকারের ভয়াল বিভীষিকার আবর্তে টেনে নামানো হয়। যার ক্ষত কোনকালেই মুছবে না। অন্ধকারের গর্ভে জন্ম নেয়া বিএনপি এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতার চরম দুশমন জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে ঘটে বাকি দুই বর্বরতম খুণ ও দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলার ঘটনা। ২১ আগস্ট সরকারি এজেন্সির সহযোগিতায় পরিচালিত গ্রেনেড-গুলি হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। দলের অন্যতম শীর্ষ নেত্রী আইভি রহমানসহ মারা যান ২৪ নেতাকর্মী। আহতের সংখ্যা অগুনতি। এখনো গ্রেনেড স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন বহু নেতাকর্মী। তাই আগস্ট মানেই বাঙালি জাতি ও দেশের জন্য ভয়াল এক মাস। এর মাঝে জাতীয় পর্যায়ে শোকের নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে ১ আগস্ট থেকে। কঠিন করোনা লকডাউনে ডিজিটাল প্লাটফরমেও।

অপ্রিয় সত্য আড়ালের উপায় নেই, টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দলটি অনেক বেশি মেদবহুল হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন গণমূখী আওয়ামী লীগের ব্রত ও গতি থমকে গেছে। পুরো দল এবং সরকার জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্ভর। এতে নানা বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগছে দেশবাসী। সারা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে তুলে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ভয়াল করোনা সংক্রমণের দেড় বছরে বিশ্ব অর্থনীতি নাজুক, ধুঁকছে বহু উন্নত দেশও। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড শক্ত রেখেছেন তিনি। এটা অসম্ভব এক মিরাকল বটে! শুধু তাই না, দ্রুত বিভিন্ন সূত্র ও দেশ থেকে টিকা সংগ্রহ করে গণহারে টিকা প্রদান কর্মসূচিও চলছে দেশে। শুরু হয়েছে টিকা উৎসবও! যা অনেক শুভ উন্নত দেশ এখনো পারেনি।

সঙ্কট কিন্তু অন্যখানে। উন্নয়নের সাথে তাল রেখে দেশ পরিচালনার জন্য একটি চৌকস, দক্ষ, নিবেদিত দেশপ্রেমিক টিম এখনো দেশে গড়ে উঠেনি। বারবার কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে। সরকারকে ব্যাকআপ বা ফিডব্যাক সহায়তা দেয়ার মতো যোগ্য দলীয় নেতৃত্বও কেন জানি গড়ে উঠছে না! অপ্রিয় হলেও সত্য, জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিযাত্রার মহাসড়কে আরো দ্রুত এগিয়ে যেতে বিষয়টাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কিন্তু কিছু অপরিণামদর্শী নেতা ও মন্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে খোঁচ-পাচড়া ভাইরাসে জর্জরিত হচ্ছে পুরো দল। সর্বশেষ হেলেনা জাহাঙ্গীর কাণ্ডে তা একদম পরিস্কার। কিছু নেতার আশীর্বাদ ধন্য হয়ে হেলেনা কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং দলের কেন্দ্রীয় মহিলা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ বাগিয়ে নেন। প্রতারণা ও অভিনয়ে দক্ষ এই ভাইরাস নানা ঘাটের জল খেলেও আওয়ামী লীগের সাথে দূরতম যোগাযোগও ছিল না। হঠাৎ পদ-পদবী পেয়ে তিনি খুলে বসেন নানা দোকান। আর নেতারা তাকে আশীর্বাদ দিতেই থাকেন। আটকের পর কিছু বয়সী নেতার সাথে তার একান্ত ও অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল হয় দ্রুত। হেলেনা, শাহেদ, সাবরিনা, জিকে শামীম, সেলিম প্রধানেরা জেলে গেলেও দলে এরকম ভাইরাস এখনো প্রচুর। ধরা খাওয়ার আগে এরা দল ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে সব ধরনের অপকর্মের গার্বেজ ট্রেন চালিয়ে যায় যথেচ্ছ! ধরা পড়লে গার্বেজের ঢাকনা খুলে নোংরার গন্ধ ছড়ায় পুরো দেশে, নইলে সবাই ভিআইপি! নেত্রীকে যারা সহযোগিতা দেবেন, দল সুসংগঠিত ও দেশ এগিয়ে নেয়ার কাজে, তারা যদি বারবার এমন ভুল করেন, তাহলে দায়টা নেবে কে? প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাব বিশ্বব্যাপী পজেটিভ ইমেজের কারণে করোনা ভ্যাক্সিন যোগাড়ের মতো কঠিন কাজ সম্ভব হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা অনিয়ম কিন্তু ঘুরেফিরে মিডিয়া শিরোনামে থাকছেই।

প্রসঙ্গটা টানতে পুরানো আর্কাইভ ঘুরে আসা যাক। ঘটনাগুলো দু'বছর আগের। কিন্তু খুবই স্পর্শকাতর। পূর্ব ইউরোপীয় দেশ রুমানিয়া। দেশটিতে একজন ১৪ বছরের কিশোরি অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটে। অপহরণের কয়েকদিন পরও পুলিশ আলেকজান্দ্রা ম্যাকাসানু নামের কিশোরিকে উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়ায় পুরো দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাজধানী বুদাপেস্টে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। পরে কিশোরীর লাশের হাড়গোড় মিলে একটি পরিত্যক্ত গ্যারেজে। ডিএনএ পরীক্ষার পর লাশ শনাক্ত হয়। অপহরণকারী খুনীও দ্রুত আটক হয়। পুরো দেশে তোলপাড় তোলা ঘটনাটি থিতু হওয়ার আগে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই মোগা'র একটি ছোট্ট মন্তব্য, তাকে গদি ছাড়তে বাধ্য করে। প্রধানমন্ত্রী ভিউরিকা ভেনশিলার নির্দেশে মাত্র সপ্তাহ আগে পাওয়া মন্ত্রীর চেয়ার ছাড়তে হয় মোগাকে। আটক ৬৫ বছরের খুনী কিশোরিকে একলা পেয়ে রাস্তা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে এই বর্বরতা ঘটায়। এর আগেও লোকটি আরেক তরুনীকে একই কায়দায় যৌন নিপীড়নের পর খুন করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোগার নির্দোষ মন্তব্য ছিল, অজানা-অচেনা কারো গাড়িতে এভাবে উঠা উচিত হয়নি আলেকজান্দ্রার। এটা পরিবার থেকে তাকে শেখানো হয়নি। দেশটির শিক্ষামন্ত্রী ইকেতিরানাকেও একই লঘু পাপে মন্ত্রীত্ব থেকে 'পত্রপাঠ' বিদায় দেয়া হয়। আমাদের দেশের বিবেচনায় মন্তব্যটা একেবারেই সাধারণ! আর রুমানিয়ায় হলো কিনা দু'মন্ত্রীর পতন!

প্রায় একই সময়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজধানী ডেঙ্গু কবলিত হওয়ার পর বলেন, 'যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকুউটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে!' অপর অনুষ্ঠানে বলেন, 'প্রতিদিন দেশে ১৫ জন দুর্ঘটনায় মারা যায়। দিনে ১০ জন সাপের কামড়ে মরে। কয়েক মাসে মাত্র ৮ জন ডেঙ্গু রোগির মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমরা এসব খবর রাখি না!' কেমন চাঁছাছোলা মন্তব্য, ভাবুন একবার! তিনি মশা মারার বল সিটি কর্পোরেশনের কোর্টে ঠেলে দিয়ে সপরিবারে মালয়েশিয়ায় ব্যক্তিগত সফরে পাড়ি জমান। এই সফর নিয়েও হয় লুকোচুরি! তার জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রী মানিকগঞ্জে বন্যার্তদের ত্রাণ দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ঢাকায় আছেন! শেষ পর্যন্ত প্রথম আলো আসল খবর ফাঁস করে দেয়ার পর চাপে পড়ে মন্ত্রী মহোদয় ৩ দিন আগেই ঢাকা ফিরতে বাধ্য হন। ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে মোড় নেয়ার পরও তিনি কেন মালয়েশিয়া গেছেন? এক সংবাদকর্মীর এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রুদ্ধ মন্ত্রী জাহিদ মালেক তাকে থামিয়ে দেন! রুমানিয়ার ঘটনার সাথে মিলালে এটা স্পষ্ট, দেশ উন্নতির মহাসড়কে উঠলেও মন্ত্রী, আমলাা, কামলা, নেতারা আছে জন্জালের ভাগাড়ে! এরা কী বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার টেকনোক্রাট! একই বছর একজন যুগ্ম সচিবের জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকে ফেরি! অ্যামবুলেন্সেই বাড়তি রক্তক্ষরণে মারা যায় কোমলমতি কিশোর তিতাস।

হালে কভিড-১৯ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জোরালো সংক্রমণে দেশজুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সাথে যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। এডিশ মশা মারার উপযুক্ত ওষুধের বদলে বাড়তি কথার খই ভাজছেন দায়িত্বশীল কিছু ব্যাক্তি! করোনা বিস্তারে এমনিতেই হাসপাতাল, ক্লিনিকে ঠাঁই নেই, রোগির সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। এর সাথে ডেঙ্গুর জুটি! এতসব দুর্যোগ সামাল দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি, দল ও প্রশাসনের। কিন্তু তারা সমন্বিত সুরক্ষা ব্যূহ তৈরি না করে উপহার দিচ্ছেন রসালো সব ড্রামা! দায়টা কী একা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার?একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া এতসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠার মতো যোগ্য, দক্ষ নিবেদিত নেতৃত্ব ও জনবল নিয়ে সন্দেহের দোলাচালে পুরো জাতি! এটা স্বীকার করতেই হবে, জনসংখ্যার বিশাল চাপ দেশের সহন ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। জনসংখ্যাকে জন সম্পদে রূপান্তরিত করার সক্ষমতা আপাতত আমাদের নেই। আরো সর্বনাশা খবর হচ্ছে, ঘাতক ভাইরাস মশক ও জনসংখ্যা স্ফীতির সাথে পাল্লা টেনে বাড়ছে, ভিআইপির সংখ্যা। বাড়তি জনসংখ্যা ও মশকের মতো ভিআইপি যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে পুরো দেশই যে অচল হয়ে পড়বে। তাই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে নির্দয়ভাবে ভিআইপি ছাটাই করা এখন সময়ের দাবি। কঠিন আইন তৈরি করে হলেও।

সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকে কেন দেখতে হবে! রাষ্ট্রীয় তহবিলের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সরকার ও প্রশাসনযন্ত্র কেন পোষা হচ্ছে? অতীত সাক্ষী, প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসাকালীল সময়েও দেশের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষ তাঁকেয়ে মনোযোগ দিতে হয়েছে! কেন? এত বড় মন্ত্রীসভা, এমপি, মেয়র, নানা পদাধিকারী, প্রশাসন, এতগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তাহলে কেন আছে! জাতীয় শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রকমারি অনুষ্ঠান! রকমারি নতুন নতুন মানুষ, সংগঠন! আবার শত শত দোকানের সাথে 'লীগ' নামের লেজুড় অথবা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যের নাম ঝুলছে! এগুলোর মালিকের সাথে চেনা অচেনা অসংখ্য নেতা, ন্যাতা, উঠতি ন্যাতার হাস্যোজ্জল ছবিও ঝুলে-সবখানেই। প্লিজ এসব থামান। মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় বঙ্গবন্ধু পাঠচক্রের আয়োজন করে মেধাবী, সৎ দেশপ্রেমিক কর্মী ও দায়িত্বশীল নাগরিক গড়ে তোলার জরুরি কর্মসূচি হাতে নেয়া এখন সময়ের দাবি। রাজনীতির ক্ষয়রোগসহ, ভোগ আসক্তি নির্মূল, মেধা- মনন ও যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে এর কোনই বিকল্প আপাতত নেই।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • পঠিত