ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

নালায় ডোবে মানুষ: ‘আশা কুহকিনী’

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২১, ১৫:৫৯

নালায় ডোবে মানুষ: ‘আশা কুহকিনী’

আসলে কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। ঘোড়ার আন্ডায় শত বছর তা দিলেও বাচ্চা ফুটেনি-ফুটবে না। আন্ডাতো নেই, বাচ্চা কোত্থেকে নাযেল হবে, কনতো! একইভাবে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতাসহ কোনো পুরানো অসুখ সারবেই না-বরং বাড়বে। সামান্য বৃষ্টিতেই নালা নর্দমায় পাহাড়গলা মাটির বানের তোড় নামবে- মানুষ মরছে- মরবেই! এতে ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া কার কী- মিডিয়া শিরোনাম দখল ছাড়া? মাত্র মাসেই নালার তীব্র স্রোতের টানে মারা গেছেন ৩ জন! ক’দিন আগে মুরাদপুরে ভেসে যাওয়া চকবাজারের সব্জি ব্যবসায়ীর লাশও মিলেনি!

আসলে হিসাবটা খুব সোজা, পলিথিন উৎপাদন, পাহাড় কাটা, গাছ কাটা, খাল-নালা, পুকুর, দিঘি, সরকারি জমি, নদী, সড়ক, ফুটপাত দখল কেউ থামাতে পারেনি, পারবেও না। কে থামাবে? যারা থামাবে, তারাইতো খাদক, দখলদার, উৎপাদক, সুবিধাভোগী। তারা নিজে বা প্রতিনিধিরা দেশ ও সরকার চালায়। তো, কী করে আশা করেন?

ছোট্ট ক’টা উদাহরণ দিই। সিডিএ নগরীকে জলাবদ্ধতা রোগের চিরসমাধান দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছেন। তিনি জলাবদ্ধতা স্থায়ী নির্মূলে হাজার হাজার কোটি টাকার মহাপ্রকল্প পাশ করেছেন। বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে সিডিএ। সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান দৌড়ঝাপ করে প্রকল্পগুলো সিটি কর্পোরেশনেকে এড়িয়ে আগেভাগে পাশ করিয়ে নেন। খুব ভালো কথা, নেত্রী আমাদের কল্যাণ চান, চান চট্টগ্রাম বাঁচুক ভালভাবে- তাহলেই দেশ বাঁচবে।

প্রায় ৭ বছর আগেই এই বিশাল বরাদ্দ এনেছে সিডিএ। কিন্তু ওই সময়ে সিডিএ ডজন ডজন পাহাড়, নিবিড় সবুজ বনানী, হাজার হাজার প্রাচীন গাছগাছালি কচুকাটা করে বাইপাশ বানিয়েছে। মিডিয়া অজ্ঞাত কারণে প্রায় চুপ ছিল! অথচ পাহাড়ে টানেল খুঁড়ে সড়কটিতে দেশের প্রথম দৃষ্টিনন্দন সোজা টানেলওয়ে করা যেত। এতে পাহাড়-গাছপালার ক্ষতি হতো সামান্য। তা না করে প্রচুর উঁচু ও সবুজ পাহাড় কেটে বানিয়েছে বায়েজিদ-ফৌজদার হাট বহু বাঁকের বাইপাশ সড়ক। এখন কাটা পাহাড়গুলো বৃষ্টির নরম আদর পেলেই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। বন্ধ করে দিচ্ছে যুগল সেল্ফির মনোরম স্পট, বাইপাশ রোডটির একাংশ। পুরোটা কবে মাটির কফিনবন্দি হয়, নগরবাসী আছে অপেক্ষায়।

হাজার কোটি টাকা অপচয় করে যারা চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক নিসর্গকে ‘মিলিটারি হেয়ারকাট’ দিয়ে আধা ন্যাড়া করেছে, তারাই কিনা চট্টগ্রামকে করবে জলাবদ্ধতা মুক্ত! ভাবুনতো একবার। হ্যা, সিডিএ’র চেয়ারম্যান বদল হয়েছেন। নগরীর বনেদী ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের অত্যন্ত সজ্জন ও সৎ জহিরুল আলম দোভাষের মত খাঁটি মানুষটি দায়িত্বে আছেন। ঠিক আছে, কিন্তু একা কী করবেন তিনি? আগের সাজানো রদ্দি কাঠামো ভেঙে নতুন দায়বদ্ধ পরিষদ ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়া কী সহজ? অসম্ভব একদম। তো এতবড় বরাদ্দ এমন কাঠামোর হাতে পড়া মানে, গল্পের কুমিরের বাচ্চাকে শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালায় পাঠানো নয় কী? জলাবদ্ধতা নির্মূল প্রকল্পগুলো ঝুলে আছে, সময় বাড়ছেই, চাওয়া হচ্ছে বারবার নতুন বরাদ্দ।

সুখবর হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ইন্জিনিয়ারিং কোর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু দখলে থাকা প্রায় অর্ধশত খাল ও নদী তারা কীভাবে উদ্ধার করবে? পাহাড়কাটা বন্ধ করাও তাদের দায়িত্ব নয়, এটা সিডিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের। তাদের দক্ষতা ও নির্মাণ সক্ষমতা থাকলেও কর্ণফুলী দখলসহ বহু অবৈধ দখলের মামলাবাজির অভিজ্ঞতাওতো নেই। তো...?

রেলের বিপুল সম্পত্তির অর্ধেকের বেশি বিএনপি সরকারের দু-মেযাদে বিলি বন্টন হয়ে গেছে, ফ্রি অথবা টোকেন দামে। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, কর্নেল অলি, আলোচিত এপিএস সালাহউদ্দিন (এখন ভারতের সিলং হিজরতে) যোগাযোগ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং মীর নাসির মেয়র ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় এসব বন্টননামা হয়ে যায়। এরশাদ জমানায়ও প্রচুর! কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন তখন হয়নি। পাহাড়তলি, ফয়েজ লেকজুড়ে আরণ্যক বিশাল জমি, হ্রদ, পাহাড় বিপুল গাছপালাসহ চলে গেছে রাক্ষসের পেটে। সেই রেল এখন সিআরবি’র ঔষধি বৃক্ষ ও লতাগুল্মের প্রাকৃতিক হাসপাতাল পুরোই গায়েব করে দিতে মরিয়া। নগরকেন্দ্রে সিআরবি আঙিনায় নামমাত্র দামে বিলিয়ে দেয়া প্রায় হাজার কোটি টাকার ৬ একর জমির ওপর বেসরকারি অভিজাত হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইন্সটিটিউটের মতো অতিকায় স্থাপনা হবে ১২ বছর ধরে! গড়ে উঠবে আরো অসংখ্য ব্যাকআপ সাপোর্ট স্থাপনার ইট-কংক্রিট জঙ্গল। পিপিপি চুক্তির নামে রাক্ষস-দানব গিলে নেবে সিআরবি’র বিশাল ঔষধি ভাণ্ডার তথা প্রাকৃতিক হাসপাতাল। এটা রোগীর গলাকেটে হাতের রগে টাটকা রক্ত পুশ করার মতো মস্করা ছাড়া আর কী!

বাকি রইল সিটি কর্পোরেশন ও ওয়া..! সিটি কর্পোরেশন নগর রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্বে। গত মেয়াদে সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান ধারণাটি পাল্টে দিয়েছেন। কীভাবে, তা আগে বলা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন রাস্তা-ঘাট সংস্কার, নালা নর্দমা পরিস্কার, মশক নিধন, ময়লা অপসারণসহ রুটিন কাজগুলো ঢিমেতালে করছে। আয়ের উৎস-হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ সরকারি বরাদ্দ। মেদবহুল অতিকায় প্রশাসনিক কাঠামো, লোকবল, বেতন, ভাতা, যানবাহন, জ্বালানি বাবদ তাদের ব্যয়ের খাতও বিশাল। এসব সামাল দিয়ে নালা নর্দমা পরিস্কার, মশক নিধন ও আবর্জনা অপসারণের মতো রুটিন কাজে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়। খাতগুলোয় খরচ শুধুই বাড়ছে। আবার সড়ক সংস্কার, নালা-নর্দমা পরিস্কারেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাথে তাদের সমন্বয়ের অভাবও তীব্র। কিছু করা হলেও দ্রুত কাটা পড়ে রাস্তা, নর্দমাগুলো পলি বর্জ্যর ভাগাড় হয়ে যায় আরো দ্রুত। এতে জলযট, যানজটসহ সব জট আরো বেশি গিট্টু পাকায় শুধুই। মানে পুরোই অসহায় সিটি কর্পোরেশন! আধুনিক নাগরিক দায় ও সচেতনতা মোটেই তৈরি হয়নি নগরে! আরও মজার বিষয়, বৈশ্বিক উঞ্চায়নে জোয়ারের জল এবং বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় প্রথম ডোবে খোদ বর্তমান মেয়রের বাড়িসহ চারপাশের সব।

চট্টগ্রাম ওয়া...'তে স্যুয়ারেজ সিস্টেম নেই তাই ইংরেজি 'এস'টাও অচল! বেশ ক'বছর আগে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বহু হাজার কোটি টাকার স্যুয়ারেজ প্রকল্প উদ্বোধন করলেও কাজের হালনাগাদ কোনো হদিস নেই। মিডিয়াও চুপ! বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের নাম ঝুলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশ'কটি পানি শোধনাগার এবং সরবরাহ মহাপ্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে ওয়া..'। দফায় দফায় দাম বাড়লেও নগরের বহু অংশে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সঙ্কট এখনো তীব্র। ঘোলা ও নোনা জলতো বোনাস প্রাপ্তি! যথেচ্ছ রাস্তা কাটাকুটিও বাদ। ওখানে টানা ১২ বছর ধরে এক ভাগ্যবান অবঃ এর চুক্তির পর চুক্তি নবায়ন হয়! তিনি নির্বাহীর মূল দায়িত্বে বসে আছেনতো আছেনই! নট নড়ন চড়ন, যেন মৌরসী পাট্টা! তিনি এমন এক মহান ব্যক্তি, যার অতীত-বর্তমান নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের ঝাঁঝালো মশলা প্রচুর। কিন্তু ৮০+ এর এই অটলকে টলানো অসম্ভব। ঠেশ দিতে আছে, দৃশ্য-অদৃশ্য শুভাকাঙ্ক্ষী প্রভুবাবা ও পোষা খাদেমের বহর। তারা তাকে ধুয়েও দেয়, শুদ্ধতার সোনা-রূপা ধোয়া কেওড়া জলে! তো, স্যুয়ারেজ বা ভূতলে আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু হলেও কিছুটা দিশা পেত নগরবাসী। এখন শুধু, আল্লাহ ভরসা!

হ্যা, ঘোড়ার আন্ডা ফুটে বাচ্চা বেরুবে। যদি দল, মত, ক্ষমতা, প্রভাব, পদবি নির্বিশেষে সব বড় খাদককে চিহ্নিত করে প্রকাশ্যে শাস্তির আওতায় আনা যায়। অন্তত ডজন খানেকের যদি নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে সব সম্পদ বাজেয়াপ্তসহ কঠিন শাস্তি নিশ্চিত হয়, বাকিরা আপনাই সমঝে যাবে। সব দখল, আত্মসাৎ উগলে দিয়ে শুদ্ধ হতে বাধ্য হবেই। 'Chittagong to the forth' মহাত্মা গান্ধীর উক্তি। এই উক্তির সত্যতা বারবার প্রমাণ করে দেখিয়েছে চট্টগ্রাম। তাই শুদ্ধির কাজটাও চট্টগ্রাম থেকে শুরু হলে পুরো দেশে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। জানি, শব্দ বাচ্চাগুলো টাকি মাছের পোনা। জন্মায় লাখে লাখ। সব টাকির ভাই বেরাদারের পেটেই চালান হয়। বাঁচে ডজনেরও কম। রচনার ক'টি শব্দ পুস্পাঘাতে সংশ্লিষ্টদের ভোগ তৃপ্তির গভীর সুখনিদ্রা যদি টুটে, পরিশ্রম সার্থক। অবশ্য- ‘ধন্য আশা কুহকিনী’!

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত