ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

প্রিয়নেত্রী: সময়ক্ষেপ নয় প্লিজ

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:০৭  
আপডেট :
 ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:০৯

প্রিয়নেত্রী: সময়ক্ষেপ নয় প্লিজ

‘দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়াই-কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছি, আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মসংযম করো-আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা।’

আজকে নতুন ও পুরানো যে সিস্টেমে আমাদের দেশ চলছে, তা নিয়ে আমাদের আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। আত্মসমালোচনা ছাড়া আত্মশুদ্ধি হয় না। আমরা ভুল করেছিলাম, আমাদের বলতে হবে, ভুল করেছি। আমি যদি ভুল করে না শিখি তো ভুল করে শিখবই না! আমি ভুল করলে অন্য সকলে খারাপ কাজ করবে, তা হতে পারে না। আমি ভুল নিশ্চয়ই করবো, আমি ফেরেস্তা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, আমি ভুল করবোই। ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবে, ‘আই ক্যান রেক্টিফাই মাইসেলফ।’ আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গোঁ ধরে বসে থাকি, না আমি যেটা করেছি সেটাই উত্তম, ‘দ্যাট ক্যান নট বি হিউম্যান বিয়িং।’

উপরের উদ্ধৃতি দুটো কার, আশা করি অনুমান করে নিয়েছেন। না পারলেও কপাল চুলকানো বা নখ কামড়ানোর দরকার নেই। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। প্রথম উদ্ধৃতি ১৯৭৪ এর ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী এবং দ্বিতীয়টি ১৯৭৫ এর ১৯ জুন বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দেয়া ভাষনের অংশ বিশেষ।

সমকালীন রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতায় তার এই উধৃতি নতুন করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের আত্মস্থ করা জরুরি মনে হওয়ায় টানা হয়েছে। প্রায় ১৩ বছর তথা যুগের বেশি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ক্ষমতার দীর্ঘ মৌতাত ও উপভোগজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি ও আত্মশ্লাঘার শ্যাওলা জমে গেছে। তাদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ কাজ ও বক্তব্যে প্রায়ই ফুটে উঠছে। এ ধরণের অহং দল ও দেশের জন্য বড় বিপদ হতে পারে। সমকালে সরকার, সরকারি দল ও নতুন নতুন সুবিধাভোগীর বহর মিলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করছে। বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও ত্যাগের দীক্ষা থেকে দেশ ও রাজনীতিকে অনেক দূরে হঠিয়ে দিচ্ছে উঠতি ভাগ্যশিকারীর দল। বঙ্গবন্ধুকে এরা অপকর্ম চাপা দেয়ার দুর্ভেদ্য ঢাল হিসাবে অপব্যবহার করছে যত্রতত্র! সাম্প্রতিক উদাহরণ প্রচুর, উল্লেখ অনাবশ্যক।

শীর্ষ থেকে অধঃ বঙ্গবন্ধুকে ধারণ ও অনুশীলন খুব কম নেতাই করছেন। অনেকের অযৌক্তিক ও বাহুল্য কথনে তা স্পষ্ট। বিলাসী জীবনযাপন, রাজকীয় প্রটোকল, চারপাশে সার্বক্ষণিক চামচা ও সুবিধা শিকারির দুর্ভেদ্য বলয়, কথায়-আচরণে আত্মম্ভরিতার গরম ভাপ দেখলে ভাবতে কষ্ট হয়, এরা কী আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের খাদেম নাকি মধ্যযুগের সামন্ত প্রভু? বঙ্গবন্ধুু এবং দলের আদর্শে নিবেদিত ঘামের নোনায় ভেজা মাঠকর্মীদের নেতাদের ধারে-কাছে ভেড়ার ন্যূনতম স্পেস নেই। নিজস্ব বলয়ের বাইরে (প্রায় সবাই নতুন আগন্তুক) কাউকে পাত্তা দেয়ার গরজ মাননীয়দের নেই। কঠিন প্রটোকল বা বলয় ভেদ করে স্থানীয় বা দলীয় সমস্যা জানানোর সাধ্যও মাঠকর্মীর নেই।

অথচ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল বাঙলার গণমানুষের জন্য নিবেদিত। বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলার প্রতি বর্গসেন্টিমিটার মাটিজুড়ে বিস্তৃত বিশাল নেতার সুকৃতি ধারণ ও বহনের সামর্থ্য-যোগ্যতা অনেক নেতার নেই। উন্নয়নের ফেনানো ফিরিস্তি আর বিএনপির মতো পচা-গলা বচনের গার্বেজ ছিটানোর বাইরে কোনো ইস্যুই খুঁজে পান না! কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর তজবীহ জপেন সত্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি ও ঐতিহ্যের স্মারক কালো মুজিব কোট বাদ দিয়ে কোটের বহুরঙা ডিজিটাল সংস্করণ বের করে গায়ে চাপাচ্ছেন, বড় নেতায়ও! চব্বিশ ঘণ্টা বঙ্গবন্ধু নাম জপ করে বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও মূল পথনক্সা মুছে ফেলছেন। উপরের উদ্ধৃতির সাথে নেতাদের কথা ও কর্ম মিলালে সত্য সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিএনপিতো মিডিয়া ও সাইবার নির্ভর দল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিদিন নানা মাত্রার অপকর্ম ও সমালোচনার ডিশ সাজিয়ে বিকল্পের অভাবে বিএনপি’র মরা লাশের প্রতি মানুষের মনোযোগ ও আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছে! মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে বিএনপি ও সুশীলরা দাবি করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মিডিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেতারাই সচলও তাজা রেখেছে দলটিকে। বিএনপির এজেন্ডা ও কর্মসূচি পালনের দীনতা দেখলে তারা যে লাশ, প্রমাণ খুঁজতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দরকার নেই।

দেশ কোভিড-১৯ নামের ভাইরাসে আক্রান্ত। পুরো পৃথিবীজুড়ে ভাইরাসটি টানা দেড় বছরের বেশি রাজত্ব করছে। দেশের অর্থনীতিও কোভিড-১৯ প্রভাবে সংক্রমিত। রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছলেও আয়বৈষম্য ভয়ঙ্কর। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে আরো প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ। বিপরীতে গত ক’বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে সুইস ব্যাংকের গোপন অ্যাকাউন্টে। ব্যাংকিং সেক্টরও ভালো নেই। লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ উদ্ধারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। কোভিড-১৯ মোকাবিলাসহ স্বাস্থ্য দপ্তরের কেনাকাটা, কিট ও আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম সংগ্রহে অবিশ্বাস্য দুর্নীতিতে জড়িত কিছু ভূঁইফোড় ধরা পড়লেও হাঙর-কুমিরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

আবার করোনাকালে সরকার, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও প্রশাসনকে প্রণোদনাসহ বহুমুখী সুবিধা দেয়া হলেও সাধারণ মানুষ ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মাঝে ধুঁকছে। সরকার শুধু এলিট-ধনী আর সরকারি ঘরানার মাত্র কোটিখানেক মানুষের নয়, সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। তাহলে কেনো এই বৈষম্য!

দেশে কার্যকর বিরোধী দল না থাকলেও সরকার ও দল কোনোভাবেই স্বস্তিতে নেই। দেশজুড়েই সরকারি দলে দৃশ্য-অদৃশ্য অস্থিরতা। ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্র, সবখানেই ভয়াল গ্রুপিং। যুগ যুগ ধরে সম্মেলন কাউন্সিল নেই। দৈবাৎ হলেও কমিটি গড়া যায় না- ঝুলে থাকে। ছোট্ট প্রমাণ, চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের দু’মাস আগে অনুষ্ঠিত সম্মেলন। কেন্দ্রীয় নেতার বহরসহ বিশাল নেতাকর্মী সম্মিলনী হলেও কমিটি নেই আজও। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সংঘাতে আটকে আছে। দেশের নানা স্থানে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের হানাহানিতে হতাহত হয় প্রচুর নেতাকর্মী। ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠন এমনকি সরকার ঘনিষ্ঠ পেশাজীবী সংগঠনগুলোতেও বিভক্তির অসংখ্য ফাটল।

যুগের বেশি সরকারে থাকার সুবিধা ব্যবহার করে পুরানো-নয়া মিলে প্রচুর নব্য ধনী তৈরি হয়েছে। এরা অনেকে দলের নীতিনির্ধারকদের ওপর টাকাসহ নানা অনৈতিক টোপের জোরে প্রভাব তৈরি করছে। অনেকে এখন রাতারাতি ভিআইপি, যা ইচ্ছে তা করার লাইসেন্স আছে এদের! করোনাকালেও বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর নামে দোকান সাজানো হচ্ছে ‘নেত্রী ঘনিষ্টতা’র স্টিকার টাঙিয়ে! বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ থেকে দূরে ছিটকে পড়া আওয়ামী লীগ মাঠে প্রতিপক্ষের অভাবে নিজের ছায়ার বিরুদ্ধে লড়ছে! আইসোলেশনে থাকা দলের কিছু শীর্ষ নেতা মাঝে মাঝে এমন সব বাণী ছাড়েন, যা ‘গবুমন্ত্রীর’ কথা মনে করিয়ে দেয়। পরিস্থিতি কঠোরভাবে সামাল না দিলে দল ও সরকারের নাজুক অবস্থান কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য আপদ-বালাই ডেকে আনতেও পারে।

সঙ্কট মুক্তির এলাজ একটাই, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ প্রকাশিত তিন বই আবশ্যিকভাবে নেতাকর্মীদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত এবং অনুশীলনের কঠোর তাগিদ। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই তা পারেন। ইতিহাস সাক্ষী, জ্ঞান-মেধার ক্ষয়রোগের মহামারি লালন করে কোনো জাতি তার অর্জন ধরে রাখতে পারেনি। প্রশাসনেও মেধার ক্ষয় স্পষ্ট। তাই প্রশাসনের সব স্তরসহ দল ও সরকারি অর্থকরি কাজে পূর্বশর্ত হিসাবে বঙ্গবন্ধু পাঠ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ব্যক্তিজীবনে চর্চাকারীদের গুরুত্ব দিলে অন্তত সঙ্কট সমাধানের একটা টেকসই সমাধান বের হবেই।

লেখাটি প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগে যাবে, ভরসা কম। যদি যায়, দলের সাইনবোর্ড অপব্যবহারকারী হাঙর-কুমিরের প্রাদুর্ভাব থামাতে টোটকাটি একবার পরীক্ষা করার জন্য সর্বংসহা জননেত্রীর প্রতি সবিনয় নিবেদন রইল।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত